নয়াদিল্লির হাত শক্ত করতে কয়েক দিন আগেই অত্যাধুনিক ‘ইগলা-এস’ ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছিল মস্কো। পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের আবহে ভারতে আসামাত্রই দায়িত্ব পালনে নামল ক্ষেপণাস্ত্রটি।
পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই পশ্চিম সীমান্তে ‘ইগলা-এস’ বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করল ভারত। ভারতীয় বায়ুসেনার সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমানগুলি ‘বিভিআর’ (বিয়ন্ড ভিস্যুয়াল রেঞ্জ) ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিতও করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর যোগ্য জবাব দেওয়ার বার্তা দিয়েছে ইসলামাবাদ। এই পরিস্থিতিতে ‘ক্রেমলিনের পাহারাদার’কে সীমান্তে মোতায়েন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
রুশ ‘ইগলা-এস’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকৃতপক্ষে স্বল্পপাল্লার বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (ভেরি শর্ট রেঞ্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সেগুলির নতুন একটি ব্যাচ ভারতীয় ফৌজের কাছে পাঠিয়েছে মস্কো। এর সাহায্যে মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করা যাবে ড্রোন এবং যুদ্ধকপ্টার। এককথায় ক্রেমলিনের অস্ত্রে বাড়তি সুরক্ষাকবচ তৈরি করতেও সক্ষম হবে সেনা।
জরুরি ভিত্তিতে ‘ইগলা-এস’ ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে ২৬০ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এর পরই স্বল্পপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিকে ভারতীয় সেনার কাছে পাঠিয়ে দেয় মস্কো।
অত্যাধুনিক ওই হাতিয়ারের দু’টি অংশ রয়েছে। একটি ফানেলের মতো দেখতে লঞ্চার এবং অপরটি তার ভিতরে থাকা রকেট আকৃতির ক্ষেপণাস্ত্র।
‘ইগলা-এস’ ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সেটি ‘ম্যান পোর্টেবল’। অর্থাৎ, পদাতিক সেনারা সহজেই এই ক্ষেপণাস্ত্রকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র বয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এর জন্য কোনও গাড়ি বা ট্রাকের প্রয়োজন নেই। হামলার সময়ে লঞ্চার কাঁধে রেখে ‘ভূমি থেকে আকাশ’ (সারফেস টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্রটিকে নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে ছুড়তে হয়।
মস্কোর স্বল্পপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিতে রয়েছে ‘ইনফ্রারেড হোমিং’ প্রযুক্তি। তাপ চিহ্নিত করে আকাশের লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করে থাকে ‘ইগলা-এস’। লঞ্চার থেকে ছোড়ার পর যুদ্ধকপ্টার এবং ড্রোন খুঁজে নিয়ে তার উপর হামলা করার ক্ষমতা রয়েছে রাশিয়ার তৈরি এই অত্যাধুনিক অস্ত্রের।
‘ইগলা-এস’-এর পাল্লা ছয় কিলোমিটার। তাই বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, এর পর থেকে সহজেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার উচ্চতায় উড়তে থাকা কপ্টার বা ড্রোনকে ধ্বংস করতে পারবে ভারতীয় সেনা।
সমর বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনার আবহে ঠিক এই ধরনেরই একটি ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন ছিল ভারতের বিমানবাহিনীর। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তথ্য বলছে, ১৯৯০ সাল থেকে ‘ইগলা’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে এ দেশের ফৌজ। তবে ক্ষেপণাস্ত্রটির নতুন যে ব্যাচটি বাহিনীর হাতে এসেছে তা পুরনো অস্ত্রগুলির নিরিখে অনেক বেশি উন্নত।
সূত্রের খবর, ‘ইগলা’-র নতুন ব্যাচ হাতে পাওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে আরও ৪৮টি লঞ্চার এবং ৯০টি ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বরাত দিয়েছে ভারতীয় সেনা। স্বল্পপাল্লার লেজ়ার বিম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও সন্ধান চালাচ্ছে ফৌজ। নয়াদিল্লির মূল মাথাব্যথা পাক বাহিনীর ড্রোন। যুদ্ধের সময়ে সেগুলিকে দ্রুত চিহ্নিত এবং ধ্বংস করা যে কতটা জরুরি তা ভালই জানেন এ দেশের সেনাকর্তারা।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ওই ঘটনার বদলা নিয়েছে ভারত। মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ন’টি জঙ্গিঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয় সেনা। সেই ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে হইচই পড়েছে।
পাকিস্তানও ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর জবাব দেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছে। তা নিয়ে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম সীমান্তে তড়িঘড়ি ভারতের ‘ইগলা-এস’ মোতায়েন করার ইঙ্গিতপূর্ণ অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। ‘ইগলা-এস’ অনেক খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে বলেও মনে করছেন সমর বিশ্লেষকদের একাংশ।
উল্লেখ্য, ইসলামাবাদের ড্রোন আটকাতে ইতিমধ্যেই জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) এবং পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি মার্ক-১ নামের একটি হাতিয়ার মোতায়েন করেছে ভারতীয় ফৌজ।
মানববিহীন উড়ুক্কু যান চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে সেগুলি ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে ওই অস্ত্রের। মার্ক-১-এর পাল্লা ৮ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল অত্যাধুনিক লেজ়ার হাতিয়ারের সফল পরীক্ষা চালিয়েছিল ডিআরডিও। অস্ত্রটির পোশাকি নাম ‘এমকে-টু(এ) লেজ়ার’। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ‘ডিরেক্ট এনার্জি ওয়েপন সিস্টেম’ (ডিইডব্লিউ)। বর্তমান বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে আছে এই হাতিয়ার।
‘এমকে-টু(এ)’ পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়ার পর নতুন প্রজন্মের হাতিয়ারটিকে নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল ডিআরডিও। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার তরফে বলা হয়েছিল, ‘‘ভারত এ বার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজ়ার অস্ত্র ব্যবস্থার অধিকারী দেশগুলির ক্লাবে ঢুকে পড়ল।’’
হাতিয়ারটি একসঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ ড্রোন হামলাকে রুখে দিতে পারবে বলে দাবি করেছে ডিআরডিও। পাকিস্তানের কাছে এই ধরনের কোনও অস্ত্র নেই।
দীর্ঘ দিন ধরেই ফাইটার জেটের সমস্যায় ভুগছে ভারতীয় বায়ুসেনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি এখন মস্কোর থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’ স্টেলথ জেট যুদ্ধবিমান কেনার দিকে জোর দিতে পারে বলেও জল্পনা তৈরি হয়েছে।
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) আরও জোরদার করতে গত নভেম্বরে রাশিয়ার সঙ্গে একটি মউ সই করে ভারত। মউ হয়েছে ‘ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড’ ও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র রফতানিকারক সংস্থা ‘রোজ়োবোরাএক্স’-এর মধ্যে। সেখানে ‘পন্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’-এর কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া রাশিয়ার ‘ভোরোনেজ়’ রেডার ব্যবস্থা কেনার ব্যাপারে আগেই আগ্রহ দেখিয়েছে ভারত। গত বছরের ডিসেম্বরে মস্কোয় গিয়ে এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পুতিন ভারতে এলে রেডারটি কিনতে ৪০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ‘ভোরোনেজ়’-এর পাল্লা আনুমানিক আট হাজার কিলোমিটার। একসঙ্গে ৫০০-র বেশি বস্তুকে শনাক্ত করার ক্ষমতা রয়েছে এই রেডারের।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, বিপদের সময়ে ‘ওরেশনিক’ আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) ভারতকে সরবরাহ করতে পারে মস্কো। গত বছরের ২১ নভেম্বর এটির সাহায্যে ইউক্রেনীয় শহর ডেনিপ্রোকে নিশানা করে রাশিয়া। শব্দের চেয়ে ১০ গুণ গতিতে (১০ ম্যাক) উড়ে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে ওরেশনিক। অর্থাৎ, অতি উন্নত ‘হাইপারসোনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র এটি।
পাশাপাশি, পুতিন এ বার ভারতে এলে ‘৩এম২২ জ়ারকন’ হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কথা বলতে পারেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, এর আদলেই ‘ব্রহ্মোস ২’ হাইপারসোনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করবে নয়াদিল্লি। অর্থের অভাবে সেই প্রকল্প কিছুটা থমকে গিয়েছে। উল্লেখ্য, গত তিন বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধে এই হাতিয়ারটিও ব্যবহার করেছে রুশ ফৌজ।