মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শুল্কযুদ্ধ’র মোকাবিলায় রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে ভারত। পাশাপাশি, আমেরিকান ডলারের পরিবর্তে দেশীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেনে জোর দিয়েছে কেন্দ্র। সেই লক্ষ্যে রুপি (ভারতীয় টাকা) এবং রুবলে ( রুশ টাকা) বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বাড়াতে বড় সিদ্ধান্ত নিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। যা দু’দেশের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে বলে আশাবাদী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের জুলাইয়ের একেবারে শেষে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে এ দেশের সামগ্রীতে মোট ৫০ শতাংশ কর নেবে আমেরিকা। এর পরই ৫ অগস্ট রুপি-রুবলে বাণিজ্যবৃদ্ধিতে নতুন নিয়ম চালু করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আরবিআই অনুমোদিত ডিলার (এডি) ক্যাটেগরি ব্যাঙ্কগুলি পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই তাদের বিদেশি করেসপন্ডেন্ট ব্যাঙ্কগুলির জন্য ‘বিশেষ রুপি ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্ট’ বা এসআরভিএ (স্পেশ্যাল রুপি ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) খুলতে পারবে।
গত ১২ অগস্ট এই নিয়ম আরও কিছুটা শিথিল করে আরবিআই। আরও একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টগুলির অর্থ সরকারি সিকিউরিটিজ় এবং ট্রেজ়ারি বিলে অবাধে লগ্নি করা যাবে। বিশ্লেষকদের দাবি, এসআরভিএ রুশ-ভারত খনিজ তেলের বাণিজ্যকে আরও সহজতর করবে। এর মাধ্যমেই চলবে রুপি এবং রুবলের লেনদেন। সেখানে ডলার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়বে না নয়াদিল্লির।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই ‘ভোস্ট্রো অ্যাকাউন্ট’? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য যে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, তাকেই অর্থনীতির পরিভাষায় বলে ‘ভোস্ট্রো’। এর মাধ্যমে বিদেশি ব্যাঙ্কে অন্য দেশের ব্যাঙ্ক খোলে অ্যাকাউন্ট। স্থানীয় মুদ্রায় সেখানে গচ্ছিত রাখা হয় বিরাট অঙ্কের একটি তহবিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সময়ে সংশ্লিষ্ট তহবিলটি ব্যবহার করে ওই দু’টি দেশ।
আরবিআইয়ের বিজ্ঞপ্তির জেরে, রুশ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি পেয়েছে এ দেশের ব্যাঙ্ক। সেখানে ভারতীয় টাকা গচ্ছিত রাখতে পারবে তারা। আগে এই ধরনের ভেস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে আলাদা করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিতে হত। অনেক সময় লাল ফিতের ফাঁসে বিষয়টি আটকে গেলে মিলত না অনুমোদন। ফলে লেনদেনের ক্ষেত্রে তৈরি হত একাধিক জটিলতা।
বিশ্লেষকদের দাবি, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ঢালাও ভেস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমোদন দেওয়ায় এ দেশের আমদানি ও রফতানি ব্যবসায় জড়িতেরা সেখানে আগাম টাকা গচ্ছিত রাখতে পারবেন। লেনদেনের সময় তাঁদের মুদ্রা রূপান্তরের খরচ বহন করতে হবে না। পাশাপাশি, অর্থপ্রদানের ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে মস্কোর উপরে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। শুধু তা-ই নয়, ‘সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফ্ট সিস্টেম থেকেও বাইরে রাখা হয়েছে ক্রেমলিনকে।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার আর্থিক অবরোধ থেকে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির মেগা অফার দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। সঙ্গে সঙ্গে তাতে রাজি হয়ে যায় নয়াদিল্লি। সমস্যা তৈরি হয় লেনদেন নিয়ে। কারণ, এত দিন সুইফ্ট ব্যবস্থার মাধ্যমেই ডলারে পণ্য কেনাবেচা করছিল দুই দেশ।
এর পরেই রুপি ও রুবলে বাণিজ্য চালানো নিয়ে মস্কো ও নয়াদিল্লির মধ্যে শুরু হয় আলোচনা। ডলারকে এড়িয়ে লেনদেন চালিয়ে যেতে প্রথম থেকেই একটি গতিশীল বিনিময় ব্যবস্থার উপরে জোর দিয়ে আসছেন পুতিন। আরবিআইয়ের নতুন সিদ্ধান্তে সেই লক্ষ্যে কিছুটা এগোনো সম্ভব হল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
নতুন ব্যবস্থায় রুশ সংস্থাগুলিকে দেশের সরকারি সিকিউরিটিজ়, বন্ড, শেয়ার এবং পরিকাঠামো প্রকল্পে ভোস্ট্রোর উদ্বৃত্ত রুপি ব্যালেন্সে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে আরবিআই। এই ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে দুই দেশ। সব কিছু ঠিক থাকলে এ বছরের শেষেই গড়ে উঠবে একটি ত্রিদেশীয় বিনিময় ব্যবস্থা।
অন্য দিকে, স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন জনপ্রিয় হলে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের ‘আধিপত্য’ শেষ হতে পারে বলে মনে করছেন মার্কিন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। এর নেপথ্যে অবশ্য ভারত ও চিনের মতো দেশগুলির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতাকেও দায়ী করেছেন তাঁরা। রুপি-রুবলে বাণিজ্যের সূত্রপাত কি তারই ইঙ্গিত? উঠছে প্রশ্ন।
সম্প্রতি একটি পডকাস্টে ডলারের মাথার উপরে ঝুলতে থাকা বিপদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেরাল্ড সেলেন্ট। তাঁর মতে, ‘ব্রিকস’-ভুক্ত দেশগুলি, বিশেষ করে ব্রাজ়িল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং সাউথ আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার। আমেরিকার বিদেশনীতির বিরুদ্ধে তারা যে ভাবে জোট বাঁধছে তাতে ভবিষ্যতে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখতে বেগ পেতে হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং ওয়াশিংটনের চাপ সত্ত্বেও রাশিয়ার থেকে তেল কেনা চালিয়ে যাওয়া ভারতের সঙ্গে মার্কিন কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুলেছেন জেরাল্ড। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের ফলে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কতটা বাণিজ্যিক ক্ষতি হবে সে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। এর উত্তরে তিনি জানান, ভারতের জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে।
জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক চাপানোর নেপথ্যে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল রাশিয়ার থেকে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল কিনছে ভারত। ফলে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে পাচ্ছে মস্কো। তাই অবিলম্বে ওই বাণিজ্য বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। কিন্তু নয়াদিল্লি জানিয়ে দেয়, এ দেশের আমজনতার স্বার্থে ক্রেমলিনের ‘তরল সোনা’ আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর পরেই শুল্ক-বাণে ভারতকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন ক্ষুব্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু এই ইস্যুতেই জেরাল্ডের সুরে সুর মিলিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মুণ্ডপাত করেছেন আর এক মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাক্সও। ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর অতিরিক্ত বাণিজ্যে নির্ভরতার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন যে, ভারতের উচিত ‘ব্রিকস’-এর অন্য সদস্যদের সঙ্গে যতটা সম্ভব নৈকট্য বৃদ্ধি করা। কারণ ভবিষ্যতে আমেরিকা চিন থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করবে ভারতের সঙ্গে সেই পরিমাণ আমদানিতে রাজি হবে না।
ভারত থেকে রাশিয়ান তেল আমদানির উপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়ে স্যাক্স বলেন, ‘‘ট্রাম্প খুব একটা যুক্তিসঙ্গত ভাবে ভাবতে বা চলতে পছন্দ করেন না। তাঁর আবেগী পরিকল্পনা কোনও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে শ্লথ করে তুলতে পারে।’’ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রভাবই বেশি বলে মত ওই মার্কিন অর্থনীতিবিদের। তাঁর মতে, ট্রাম্প ভেবেছিলেন, শুল্কযুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে ভারত তাঁর দাবিতে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হবে। কিন্তু চাপের মুখে ভারত নতিস্বীকার করেনি। রাশিয়া থেকে তেল কিনেই চলেছে নয়াদিল্লি।
রাশিয়া ইতিমধ্যেই ‘ব্রিকস’ মুদ্রা চালু করার পক্ষপাতী। এ ব্যাপারে চিন এবং ব্রাজ়িলকে পাশে পেয়েছেন পুতিন। তবে ‘ব্রিকস’ মুদ্রার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির। উল্টে ভারতীয় মুদ্রাকেই আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী করতে চাইছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। রুপি-রুবল বাণিজ্যে সেই লক্ষ্য কিছুটা পূরণ হচ্ছে বলেই মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
গত ১৫ অগস্ট ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। যদিও সেখানে কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছোতে পারেননি দুই ‘সুপার পাওয়ার’ রাষ্ট্রনেতা। পরে ফক্স নিউজ়কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘মস্কোর থেকে তেল ক্রয়কারী দেশগুলির ক্ষেত্রে শুল্কের বিষয়টি দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে বিবেচনা করা হবে।” সে ক্ষেত্রে শুল্কের অঙ্ক বাড়বে না কি কমবে, তা স্পষ্ট করেননি তিনি।