Indus Water Treaty Row

সিন্ধুর উপনদী থেকে একাধিক খাল কাটার তোড়জোড়, ভারতের চালে ‘গলা শুকোচ্ছে’ পাকিস্তানের

চলতি বছরের এপ্রিলে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। দু’মাসের মাথায় সিন্ধুর উপনদী থেকে খাল কেটে জল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষার কাজ শুরু করে দিল জলশক্তি মন্ত্রক। ফলে আগামী দিনে পাকিস্তানের জলসঙ্কট বাড়তে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২৫ ১২:২৩
Share:
০১ ১৮

সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়া ইস্তক ভারতকে হুমকি দিয়ে চলেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের সে সব ফাঁকা আওয়াজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এ বার পাল্টা পদক্ষেপ করল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলির সংযোগকারী সম্ভাব্য খাল প্রকল্পের সমীক্ষায় কোমর বেঁধে নেমেছে নয়াদিল্লি। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে আরও তীব্র হল জলের সঙ্কটের আশঙ্কা। এতে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ সরকার এবং রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের রক্তচাপ যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ১৮

সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে সিন্ধুর বাঁ দিকের উপনদী চন্দ্রভাগার জল পাক পঞ্জাব প্রদেশে যাওয়া বন্ধ করতে চাইছে কেন্দ্র। এর জন্য চন্দ্রভাগা, বিপাশা এবং শতদ্রু সংযোগকারী খাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই প্রকল্প বাস্তবে রূপ পেলে দেড় থেকে দু’কোটি একর ফুট জল ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে সরিয়ে নিতে পারবে নয়াদিল্লি। সেই মতো খালটির নীল নকশা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।

Advertisement
০৩ ১৮

ভারতের এই রাজ্যগুলি, বিশেষত রাজস্থানে তীব্র জলসঙ্কট রয়েছে। জলের অভাবেই কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়েন পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং মরু রাজ্যের চাষিরা। তাই বিশ্লেষকদের অনেকেই প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের অর্থনীতিতে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে ইতিমধ্যেই মন্তব্য করেছেন। যদিও এই নিয়ে এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্রের মোদী সরকার।

০৪ ১৮

এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন জলশক্তি মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘আমাদের একটি দল জম্মু, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের খালগুলোর পরিকাঠামো মূল্যায়ন করছে। চন্দ্রভাগার জল সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি পরিকল্পনার উপর সমীক্ষা করা হচ্ছে। এর চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়লে প্রস্তাবিত খাল প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু করা হবে।’’

০৫ ১৮

কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের ওই কর্তা জানিয়েছেন, চন্দ্রভাগার কিছু জল বর্তমানে জম্মু, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের খালগুলিতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন করে কিছু খাল কাটা হবে। সেগুলির মাধ্যমে কোন কোন এলাকার কৃষি উপকৃত হবে, সমীক্ষা রিপোর্টে তারও উল্লেখ থাকবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে তাই কোনও রকমের ফাঁক রাখতে রাজি নয় কেন্দ্র।

০৬ ১৮

সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জলশক্তি মন্ত্রকের ওই কর্তাটি বলেন, ‘‘খাল কেটে চন্দ্রভাগার জল অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কাজ মোটেই সহজ নয়। এর জন্য চাই সঠিন মূল্যায়ন। সেখানে ভুল হলে গোটা পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। এই সমীক্ষার পর বিদ্যমান খালের মধ্যে কোনগুলির সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, তার তালিকা তৈরি করা হবে। সেইমতো অর্থ বরাদ্দ করবে সরকার।’’

০৭ ১৮

সূত্রের খবর, চন্দ্রভাগা-ইরাবতী-বিপাশা-শতদ্রু সংযোগকারী খাল প্রকল্প ছাড়াও সিন্ধুর অববাহিকায় একগুচ্ছ জলাধার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। জলশক্তি মন্ত্রকের দাবি, সিন্ধু জল চুক্তি লঙ্ঘন না করেই এই পদক্ষেপ করতে পারবে সরকার। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট নদীগুলির ২০ শতাংশ জল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে ভারতের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটা বেড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

০৮ ১৮

প্রস্তাবিত প্রকল্পের সমীক্ষা রিপোর্ট কবে জমা পড়বে তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, যে ভাবে সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান সুর চড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ করতে পারে সরকার। ফি বছর বর্ষাকালে জম্মু-কাশ্মীরের এই নদীগুলির ফুঁসে ওঠার প্রবণতা রয়েছে। চন্দ্রভাগা-ইরাবতী-বিপাশা-শতদ্রু সংযোগকারী খাল কাটার সময়ে সেটাও মাথায় রাখতে হবে ইঞ্জিনিয়ারদের। সেই কারণে মৌসুমি বায়ু ভারতে ঢোকার পর এই সমীক্ষা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

০৯ ১৮

অন্য দিকে, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ার পর নয়াদিল্লিকে পর পর চারটি চিঠি পাঠিয়েছে পাকিস্তান। সেখানে চুক্তি স্থগিতের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানো হয়েছে। ইসলামাবাদের জলসম্পদ মন্ত্রকের সচিব সৈয়দ আলি মুর্তাজার কাছ থেকে চিঠিগুলি এসেছে বলে জানা গিয়েছে। চারটে চিঠিই গ্রহণ করেছে কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রক। পরে সেগুলিকে বিদেশ মন্ত্রকে পাঠিয়ে দেয় তারা। যদিও এ ব্যাপারে পুরনো অবস্থানে অনড় মোদী সরকার।

১০ ১৮

চলতি বছরের এপ্রিলে পাকিস্তানের সঙ্গে হওয়া ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। প্রথম দিন থেকেই কেন্দ্রের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছে ইসলামাবাদ। সম্প্রতি, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় বলেন, ‘‘এই চুক্তির উপরে ২৪ কোটি পাকিস্তানবাসীর জীবন নির্ভর করছে। সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।’’ এ বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছেন তিনি।

১১ ১৮

শরিফের দাবি, সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে ভারত জলকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী মোদী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জল এবং রক্ত পাশাপাশি বইতে পারে না। ইসলামাবাদ সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ করলে তবেই এই চুক্তির বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে নয়াদিল্লি।

১২ ১৮

এই ইস্যুতে ফের এক বার ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন সাবেক পাক বিদেশমন্ত্রী তথা ‘পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টি’ বা পিপিপির নেতা বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারি। আমেরিকা সফরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জল বন্ধ করে দক্ষিণ এশিয়াকে পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে নয়াদিল্লি।’’ মোদী সরকারের এই কার্যকলাপ ‘আগ্রাসন’ বলে অভিহিত করে বিশ্বের বড় রাষ্ট্রগুলিকে কার্যকরী পদক্ষেপ করার আর্জিও জানিয়েছেন তিনি।

১৩ ১৮

গত ৫ জুন ওয়াশিংটনে একটি আলোচনাসভায় যোগ দিয়েছিলেন বিলাবল। সেখানেই তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া যুদ্ধের শামিল। দেশপ্রেমের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এ কথা বলিনি। এটা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট। জল এবং বাঁচার স্বার্থে যে কোনও দেশ লড়াই করতে পারে।” তাঁর ওই মন্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে নয়াদিল্লি।

১৪ ১৮

ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত নিয়ে ইসলামাবাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ সিন্ধু এবং তার দু’টি উপনদী বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা পাকিস্তানমুখী। এই তিন নদীর জলের উপর পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ৮০ শতাংশ কৃষিকাজ নির্ভর করে। সিন্ধুর বাকি তিন উপনদী বিপাশা, শতদ্রু এবং ইরাবতী ভারতের উপর দিয়েই বইছে। শরিফ সরকারের আশঙ্কা, জলবণ্টন চুক্তি ভেঙে গেলে পাকিস্তানমুখী সমস্ত নদীর জলপ্রবাহ অনিয়মিত হয়ে পড়বে।

১৫ ১৮

১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সিন্ধু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি করতে পাকিস্তানে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ইসলামাবাদের তরফে এতে সই করেন ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। ওই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন তিনি। চুক্তি হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে কাশ্মীরে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেন আয়ুব, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’।

১৬ ১৮

সিন্ধু জল চুক্তি হওয়ার পর মোট তিন বার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় পাকিস্তান। লড়াইয়ের বছরগুলি হল ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯। প্রতি বারই নয়াদিল্লির কাছে পর্যুদস্ত হয় ইসলামাবাদ। রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের এ হেন আগ্রাসী মনোভাবের পরেও সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি কখনওই স্থগিত করেনি এ দেশের সরকার। পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর কেন্দ্র সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হল বলেই মনে করা হচ্ছে।

১৭ ১৮

গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় পর্যটক-সহ প্রাণ হারান ২৬ জন। এর পরই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার কথা ঘোষণা করে ভারত। নদীর জল আটকালে তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে হুমকি দিয়েছিল ইসলামাবাদ। যদিও সেই হুঁশিয়ারির পরোয়া করেনি নয়াদিল্লি।

১৮ ১৮

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, প্রাথমিক ভাবে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির উপর খাল প্রকল্পের কাজ করলেও ভবিষ্যতে সেগুলিতে বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। এই অববাহিকায় একাধিক জলবিদ্যুৎকেন্দ্রও গড়ে তুলতে আগ্রহী কেন্দ্র। মোদী সরকার সেই রাস্তায় হাঁটলে চুপ করে বসে না-ও থাকতে পারে পাকিস্তান। সে ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement