প্রতীক্ষার অবসান। অবশেষে ভারতের মাটিতে পা পড়ল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। ‘বন্ধু’কে কাছে পেয়ে কোন কোন হাতিয়ারের চুক্তি সেরে ফেলবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী? ইতিমধ্যেই সেই তালিকা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। আর এই আবহে খবরের শিরোনামে রয়েছে একটাই নাম, ‘এস-৫০০ প্রমিথিউস’। এর সাহায্যে পুরু বর্মে ঢেকে ফেলা যায় গোটা শহরের আকাশ! এ-হেন ‘কর্ণ-কবচ’ নয়াদিল্লির হাতে তুলে দিতে আগ্রহী মস্কো, খবর সূত্রের।
বর্তমানে ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে থাকা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলির (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) মধ্যে অন্যতম হল রুশ নির্মিত ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’। চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষে নিজের জাত চিনিয়েছে মস্কোর এই হাতিয়ার। ‘এস-৫০০ প্রমিথিউস’ কিন্তু শুধুমাত্র এর উত্তরসূরি নয়, বরং আরও অত্যাধুনিক এবং বর্ধিত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ব্যবস্থা। এই বর্মে আটকে যাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রও।
‘এস-৫০০ প্রমিথিউস’-এর নকশা ও নির্মাণকারী সংস্থাটি হল ‘আলমাজ়-আন্তে এয়ার ডিফেন্স কনসার্ন’। সূত্রের খবর, ভারতের সঙ্গে যৌথ ভাবে সংশ্লিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটিকে তৈরি করতে চাইছে তারা। এর জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তরেও আপত্তি নেই তাদের। এই ইস্যুতে সরকারি পর্যায়ে একপ্রস্ত আলোচনা সেরে ফেলেছে নয়াদিল্লি ও মস্কো। ফলে মোদী-পুতিনের বৈঠকে এতে চূড়ান্ত সিলমোহর পড়বে বলেই আশাবাদী এ দেশের সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হাতে থাকা এস-৪০০-এর সঙ্গে রুশ এয়ার ডিফেন্স এস-৫০০-এর বেশ মিল রয়েছে। পূর্বসূরির মতো প্রমিথিউসেও রয়েছে মোট চারটে ইউনিট। সেগুলি হল, অতিশক্তিশালী দূরপাল্লার রেডার, কমান্ড ভেহিকল, লঞ্চার ও ক্ষেপণাস্ত্র এবং এনগেজমেন্ট রেডার। পাক-চিনের লড়াকু জেট থেকে ক্ষেপণাস্ত্রকে তিন থেকে চার সেকেন্ডে মাঝ-আকাশে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে এস-৫০০-এর।
২০২১ সাল থেকে প্রমিথিউস আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে আসছে রুশ মহাকাশ বাহিনী (স্পেস ফোর্স)। সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটিকে মস্কোর ফৌজ অবশ্য চেনে ‘এস-৫০০ ট্রায়াম্ফটর-এম’ নামে। সংঘাত পরিস্থিতিতে প্রথমে শত্রুর লড়াকু জেট বা ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রকে চিনে নেওয়ার কাজটি করে এর অতিশক্তিশালী দূরপাল্লার রেডার। চিহ্নিতকরণ হয়ে গেলে সেই তথ্য যায় কমান্ড ভেহিকলে। সেখান থেকে নিশানা ঠিক করে লঞ্চার থেকে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র।
এস-৫০০-এর ক্ষেপণাস্ত্রকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে ছুটে যেতে সাহায্য করে এনগেজমেন্ট রেডার। এতে রয়েছে ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য মোট তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলি হল, ৪০এন৬এম, ৭৭এন৬ এবং ৭৭এন৬-এন১। প্রথমটির সাহায্যে ধ্বংস করা যায় লড়াকু জেট। পরের দু’টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং শত্রুর কৃত্রিম উপগ্রহকে উড়িয়ে দিতে সক্ষম। প্রয়োজনে লক্ষ্যের দিকে একসঙ্গে দু’টি ক্ষেপণাস্ত্রও ছুড়তে পারে প্রমিথিউসের লঞ্চার।
পূর্বসূরি এস-৪০০-এর সঙ্গে এস-৫০০-এর বেশ কয়েকটি জায়গায় অমিল রয়েছে। প্রথমত, ট্রায়াম্ফের পাল্লা ৪০০ কিলোমিটার। সেখানে কোনও এলাকার সর্বোচ্চ ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আকাশকে সুরক্ষা দিতে পারে প্রমিথিউস। এস-৪০০-এর ক্ষেপণাস্ত্র ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত উপরে উঠে ধ্বংস করতে পারে শত্রুর যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র। এস-৫০০-এর ক্ষেত্রে সেই পাল্লা ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, পৃথিবীর নিম্নকক্ষে পৌঁছোতে পারে এর ক্ষেপণাস্ত্র।
মূলত লড়াকু জেট, ড্রোন এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার লক্ষ্যে এস-৪০০-এর নকশা তৈরি করেছে রুশ প্রতিরক্ষা সংস্থা। এগুলির পাশাপাশি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং যে কোনও হাইপারসনিক হাতিয়ারকে আটকে দিতে পারে এস-৫০০। কৌশলগত দিক থেকে প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি অনেক বেশি শক্তিশালী। সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ট্রায়াম্ফকে মোতায়েন করা যেতে পারে। অন্য দিকে আস্ত একটা শহর বা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পত্তিগুলি বাঁচাতে সক্ষম প্রমিথিউস।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, রাশিয়ার সঙ্গে এস-৫০০-এর চুক্তি হলে একাধিক কারণে লাভবান হবে ভারত। বর্তমানে এস-৪০০ ছাড়াও নয়াদিল্লির হাতে আছে আরও বেশ কয়েকটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময়ে সেগুলির পারফরম্যান্সও ছিল যথেষ্ট ভাল। তার মধ্যে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আকাশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কথা বলা যেতে পারে। পাক ফৌজের ড্রোনের ঝাঁককে আটকে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এই হাতিয়ার।
এ ছাড়া ইজ়রায়েলি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র বা এমআরস্যাম (মিডিয়াম রেঞ্জ সারফেস টু এয়ার মিসাইল) ব্যবহার করে এ দেশের ফৌজ। পাশাপাশি আছে স্পাইডার নামের আরও একটি ইজ়রায়েলি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, এগুলির সঙ্গে মিশে গিয়ে কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে এস-৫০০-এর। সে ক্ষেত্রে সফ্টঅয়্যার সংক্রান্ত কোনও সমস্যার মুখ পড়তে হবে না ভারতীয় বায়ুসেনাকে।
২০১৬ সালে এস-৪০০-এর পাঁচটি রেজিমেন্টের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে একটি আন্তঃসরকারি চুক্তি করে ভারত। ইতিমধ্যেই মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, ট্রায়াম্ফের প্রযুক্তি হস্তান্তর পর্ব সেরে ফেলেছে ক্রেমলিন। এস-৫০০ ট্রায়াম্ফটর-এম-এর ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলা অনুসরণ করার ব্যাপারে একমত হয়েছে দু’পক্ষ। ফলে দু’তরফে বড় চুক্তি হতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
মস্কোর সঙ্গে এস-৪০০ চুক্তির অঙ্ক ছিল ৫৪৩ কোটি ডলার। এর প্রতিটি রেজিমেন্ট দু’টি করে ব্যাটারিতে বিভক্ত। প্রতিটি ব্যাটারিতে রয়েছে ১৬টি করে লঞ্চার, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, নজরদারি এবং এনগেজমেন্ট রেডার। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে রাশিয়ার থেকে আরও পাঁচটি এস-৪০০ কিনতে পারে ভারত। মোদী-পুতিন বৈঠকে এই ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পুতিনের ভারত সফরের আগে ভারতের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক চুক্তিতে অনুমোদন দিয়েছে রুশ পার্লামেন্ট ফেডারেল অ্যাসেম্বলির নিম্নকক্ষ স্টেট ডুমা। দু’দেশের মধ্যে লজিস্টিক সাহায্যের আদানপ্রদানের জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। যার নাম ‘রেসিপ্রোকাল এক্সচেঞ্জ অফ লজিস্টিক সাপোর্ট’, সংক্ষেপে আরইএলওএস। সেই সমঝোতায় সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে স্টেট ডুমা।
ভারত-রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতার দিক থেকে এই চুক্তিটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন স্টেট ডুমার স্পিকার ভ্যাচেস্লভ ভলোদিন। তাঁর কথায়, ‘‘নয়াদিল্লির সঙ্গে আমাদের কৌশলগত এবং সার্বিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা এই সম্পর্কের কদর করি। এই চুক্তির অনুমোদন পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আমাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”
বস্তুত, রুশ প্রেসিডেন্ট এমন এক সময় দিল্লি আসছেন, যখন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে। ফলে এই সফরে দিল্লি এবং মস্কোর মধ্যে বন্ধুত্ব আরও বৃদ্ধি করতে চাইছেন পুতিন। এ ক্ষেত্রে মস্কোর তেলের পাশাপাশি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে সামরিক সরঞ্জাম সংক্রান্ত বিষয়ও। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ভারতকে যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে ক্রেমলিন। এ অবস্থায় পুতিনের সফরের আগে রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে চুক্তিতে অনুমোদন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
আরইএলওএস চুক্তিতে রুশ সামরিক সরঞ্জাম, যুদ্ধজাহাজ এবং যুদ্ধবিমান রাশিয়া থেকে ভারতে সরবরাহের পদ্ধতিগত বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। একই রকম ভাবে ভারতের থেকেও সামরিক সহযোগিতার পদ্ধতিগত দিকও উল্লেখ রয়েছে চুক্তিতে। এটি দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তি। দু’দেশের বাহিনীর যৌথ মহড়া, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সামরিক আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে চুক্তিতে।
পুতিনের ভারত সফরকালে দু’দেশের মধ্যে অসামরিক পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রেও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হতে পারে। অসামরিক পরমাণু শক্তির ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সাহায্যের পথ আরও দৃঢ় করতে একটি সমঝোতা স্মারক (মউ) স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সবার নজর রয়েছে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের দিকে।
২০২১ সালে রুশ মহাকাশ বাহিনীতে এস-৫০০ শামিল হওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন রাশিয়ার তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউরি ইভানোভিচ বোরিসভ। ভারতই এর প্রথম ক্রেতা হতে চলেছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথা সত্যি হলে মস্কোর সঙ্গে রেকর্ড মূল্যের প্রতিরক্ষা চুক্তি করবে নয়াদিল্লি। ‘বন্ধু’ পুতিনের সঙ্গে মোদীর সেই সমঝোতা হয় কি না, সেটাই এখন দেখার।