Indian Rupees Fall

১১ মাসে পতন ৪.৩%, বাংলাদেশের থেকেও খারাপ হাল! ৯০-এর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ‘এশিয়ার সবচেয়ে খারাপ মুদ্রা’র তকমা পেল রুপি

কমতে কমতে ডলারের নিরিখে ৮৯ টাকায় নেমে এসেছে ভারতীয় রুপির দাম। কেন ক্রমাগত দর কমছে নয়াদিল্লির মুদ্রার? টাকার দাম কমায় বিপদ কোথায়?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:
০১ ২০

ভারতীয় মুদ্রার শনির দশা! ডলারের নিরিখে হু-হু করে নামছে দাম। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে এ দেশের রুপির (পড়ুন টাকা) অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪.৩ শতাংশ। ফলে এশিয়ার ‘সর্বাধিক খারাপ পারফরম্যান্স’ করা মুদ্রার তকমা জুটেছে কপালে। আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, অচিরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি না হলে আরও খারাপ হবে পরিস্থিতি। সে ক্ষেত্রে ডলারের দর ৯০ রুপিতে নামতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তাঁরা।

০২ ২০

চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর এক ডলারের দাম দাঁড়ায় ৮৯.২৭ রুপি। ভারতীয় মুদ্রায় এ-হেন দর পতনে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে লোকসভার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। পাল্টা জবাব দিতে দেরি করেনি বিজেপিও। অন্য দিকে ডলারের নিরিখে রুপির দামের অস্বাভাবিক পতনের কোনও প্রভাবই মুম্বইয়ের শেয়ার বাজারে দেখা যায়নি।

Advertisement
০৩ ২০

এ দেশের ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এশিয়ার মুদ্রাগুলির মধ্যে ডলারের সামনে ক্রমাগত মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে মালয়েশিয়ার রিঙ্গিত, রিপাবলিক অফ চায়না বা আরওসির তাইওয়ানিজ় ডলার, তাইল্যান্ডের ভাট এবং চিনের রেনমিনবি (ইউয়ান)। অন্য দিকে ভারতের মতোই খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের টাকা, ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়াহ, ফিলিপিন্সের পেশো ও ভিয়েতনামের ডঙের। তবে সংশ্লিষ্ট তালিকায় সবার শেষে নাম রয়েছে নয়াদিল্লির রুপির।

০৪ ২০

ডলারের নিরিখে ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। এর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতিকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। এ বছরের এপ্রিল থেকে শুরু করে দু’টি ধাপে নয়াদিল্লির পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। ফলে আমেরিকার সঙ্গে তীব্র হয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বাণিজ্যিক সংঘাত।

০৫ ২০

বিশেষজ্ঞদের দাবি, হঠাৎ করে শুল্কের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এত দিন রফতানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল আমেরিকা। নয়াদিল্লির সামগ্রী বিপুল পরিমাণে কিনত ওয়াশিংটন। এর জেরে সেখান থেকে রাশি রাশি ডলার আসছিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) কোষাগারে। ট্রাম্পের নীতিতে সেই সূচক অনেকটাই নিম্নমুখী হয়েছে।

০৬ ২০

আমেরিকার সঙ্গে শুল্ক সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিকল্প বাজারের খোঁজ চালাচ্ছে ভারত। কিন্তু বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্যও প্রয়োজন হবে ডলারের। কারণ, বর্তমানে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ৮৫ শতাংশই মার্কিন মুদ্রায় হয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বিদেশি মুদ্রা ভান্ডারকে ঠিক রাখতে ডলার এবং সোনা কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে আরবিআই। এতে বাজারে চাহিদা তৈরি হওয়ায় লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে ওয়াশিংটনের মুদ্রাটির দাম।

০৭ ২০

যে কোনও দেশের কাছে ডলার রোজগারের দু’টি উপায় রয়েছে। একটি হল বিপুল রফতানি। আর দ্বিতীয়টি সরাসরি মার্কিন মুদ্রা কিনে নেওয়া। আমেরিকার বাজারে এ দেশের পণ্যের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় কিছুটা বাধ্য হয়েই ডলার কেনার পরিমাণ বাড়িয়েছে আরবিআই। অন্য দিকে আমেরিকার মুদ্রাটির দাম পুরোপুরি বাজারনির্ভর হওয়ায় এর সূচক ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। ফলে ডলারের সামনে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে টাকা।

০৮ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-’৪৫) পর আন্তর্জাতিক বাজারে আধিপত্য তৈরি করে ডলার। ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলনে মার্কিন মুদ্রাটিকে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যম হিসাবে মেনে নেয় পৃথিবীর সব দেশ। ওই সময় ডলারের দামকে সোনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী কালে অবশ্য সেই ব্যবস্থার বদল আনে ওয়াশিংটন। অপরিশোধিত খনিজ তেলের দরের সঙ্গে একে সম্পৃক্ত করে আমেরিকা। ফলে পেট্রো-ডলার হিসাবে নতুন পরিচিতি পায় ওই মুদ্রা।

০৯ ২০

বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের আর্থিক অবস্থা ঠিক রাখতে জন্ম হয় দু’টি প্রতিষ্ঠানের। সেগুলি হল আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার ও বিশ্ব ব্যাঙ্ক। এর মধ্যে প্রথম সংস্থাটি পরবর্তী দশকগুলিতে মোট পাঁচটি মুদ্রাকে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য বেছে নেয়। সেই তালিকায় ডলারের পাশাপাশি রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ইউরো, চিনের রেনমিনবি, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটেনের পাউন্ড-স্টার্লিং। কিন্তু তার পরেও আমেরিকার মুদ্রাটির চাহিদা একেবারেই কমেনি।

১০ ২০

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় মাত্র ৩.৩ রুপিতে পাওয়া যেত এক ডলার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নয়াদিল্লি যত মার্কিন মুদ্রা কিনেছে, ততই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুর্বল হয়েছে এ দেশের টাকা। উল্টো দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়েছে ডলারের। রুপির এ-হেন অবমূল্যায়নের অবশ্য বিশেষ কিছু সুবিধাও রয়েছে। এতে রফতানি বাণিজ্যের সর্বাধিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১১ ২০

একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা বুঝে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে এক ডলারের দর ভারতীয় মুদ্রায় ৮৯ টাকা। সেটা ১০০-তে নেমে গেলে মার্কিন বাজারে এক ডলারের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য কেনার সুযোগ পাবেন সেখানকার বাসিন্দারা। অর্থাৎ, এ দেশের সামগ্রী এক রকম জলের দরে বিক্রি হবে সেখানে। তখন ট্রাম্পের শুল্কবাণ আর সে ভাবে কাজ করবে না। এ দেশের রফতানি ব্যবসায়ীদেরও লাভের হিসাব ঠিক থাকবে।

১২ ২০

বর্তমানে ৩,৫০০ কোটি ডলার মূল্যের কাপড় বিদেশের বাজারে বিক্রি করে ভারত। গত সাত বছর ধরে এই সূচকে দেখা যায়নি কোনও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। ফলে নয়াদিল্লির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে এসেছে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই দুই দেশের উপর শুল্কের মাত্রা কম রেখেছেন ট্রাম্প। ফলে আমেরিকায় তুলনামূলক ভাবে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে তাদের কাপড়। এতে কপাল পুড়েছে এখানকার শিল্পপতি এবং রফতানি ব্যবসায়ীদের।

১৩ ২০

এই পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন হলে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের চেয়ে সস্তায় মার্কিন বাজারে কাপড় বিক্রি করতে পারবে ভারত। কিন্তু, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য অসুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে বহু দেশের সঙ্গেই বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে নয়াদিল্লির। টাকার দাম কমে গেলে সেখান থেকে পণ্য আনতে অনেক বেশি খরচ করতে হবে সরকারকে। শেষ পর্যন্ত সেই চাপ এসে পড়বে আমজনতার ঘাড়েই।

১৪ ২০

তবে সমস্যার জায়গাটা হল, ভারতের আমদানি নির্ভরশীলতা নেহাত কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে অধিকাংশ দেশের সঙ্গেই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ফলে টাকার অবমূল্যায়ন হলে বিদেশি পণ্য কিনতে বেশি অর্থ খরচ করতে হবে কেন্দ্রকে। এতে দেশের বিদেশি মুদ্রা ভান্ডারের উপর ব্যাপক চাপ আসার আশঙ্কা প্রবল।

১৫ ২০

বিদেশ থেকে ভারত সর্বাধিক আমদানি করে অপরিশোধিত খনিজ তেল। দেশের জ্বালানি প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ৮৮ শতাংশ ‘তরল সোনা’ আসে রাশিয়া এবং পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি থেকে। ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে এর জন্য ১৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল কেন্দ্র। টাকার দাম মাত্র এক শতাংশ কমলে এর জন্য অতিরিক্ত ১৩৭ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে কেন্দ্রকে।

১৬ ২০

খনিজ তেল বাদ দিলে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ৬৫ শতাংশ, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশের ৭০ শতাংশ এবং রাসায়নিকের ৪৫ শতাংশ বিদেশ থেকে কিনতে হয় ভারতকে। এ ছাড়া কৃষির ক্ষেত্রে সারের ব্যাপারে পুরোপুরি রাশিয়া এবং চিনের উপরে নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। উপর্যুপরি মুদ্রাস্ফীতির হার ঠিক রাখতে গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণে ডাল এবং ভোজ্যতেলও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়েছে মোদী সরকারকে। টাকার অবমূল্যায়ন হতেই থাকলে এই ক্ষেত্রগুলিতে খরচের অঙ্ক বৃদ্ধি পাবে কয়েক গুণ।

১৭ ২০

তবে টাকার দর কমে যাওয়ার অন্য একটা সুবিধা রয়েছে। এ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বড় অংশ আসে পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে। টাকার অবমূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির সামনে ভারত থেকে সস্তা শ্রমিক পাওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। ফলে এখানকার তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে জোয়ার আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি পর্যটক আসার প্রবণতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

১৮ ২০

ডলারের নিরিখে ভারতীয় রুপির দাম হ্রাস পাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন। ফলে চাঙ্গা হয়েছে সেনসেক্স ও নিফটি। ২৭ নভেম্বর সর্বকালীন উচ্চতায় ওঠে বম্বে এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার সূচক। টাকার দাম আরও পড়তে সূচক আরও উপরের দিকে উঠতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১৯ ২০

ভারতীয় মুদ্রার মূল্য হ্রাস নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের বিজ়নেস অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তনয় দালাল। তাঁর কথায়, ‘‘গত কয়েক মাস ধরেই মূলধনের বহির্গমনের জন্য কমছে রুপির দাম। এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে এ দেশের মুদ্রার মতোই ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়াহের দর ২.৯ শতাংশ এবং ফিলিপিন্সের পেশোর দাম ১.৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।’’

২০ ২০

এ বছরের ৩ থেকে ৫ ডিসেম্বর বৈঠক করবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মুদ্রানীতি কমিটি। সেখানে রেপো রেট বা সুদের হার হ্রাস করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। ইতিমধ্যেই সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন আরবিআইয়ের গভর্নর সঞ্জয় মলহোত্র। সেখানে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে কী সিদ্ধান্ত হয়, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement