ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধে’ আপাতত ইতি। সংঘর্ষবিরতির কথা ঘোষণা করল দুই দেশ। যদিও লড়াই থামার তিন ঘণ্টার মধ্যেই সীমান্তে গোলাবর্ষণ করে ইসলামাবাদের বাহিনী। জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থান এবং গুজরাতে চালায় ড্রোন হামলা। সেগুলিকে অবশ্য মাঝ-আকাশেই ধ্বংস করেছে ভারতীয় সেনা। উল্লেখ্য, সংঘর্ষবিরতির আগে পাকিস্তানের একের পর এক বায়ুসেনা ঘাঁটিকে একরকম গুঁড়িয়ে দেয় এ দেশের বিমানবাহিনী।
ভারতের প্রত্যাঘাতে একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করে নিয়েছে ইসালামাবাদ। বেশ কিছু গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে হামলার সময়কার ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। সেখানে পাক বায়ুসেনা ছাউনিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখা গিয়েছে। যদিও ওই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম।
শনিবার, ১০ মে এই ইস্যুতে বিবৃতি দেন ভারতীয় সেনার কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। তাঁরা বলেন, পাকিস্তানের রফিকি, মুরিদ, চাকলালা এবং রহিম ইয়ার খান বায়ুসেনা ঘাঁটিতে আকাশপথে হামলা চালানো হয়েছে। এ ছাড়া নিশানা করা হয় সুক্কুর এবং চুনিয়ায় পাক সেনাঘাঁটি, পসরুর এবং সিয়ালকোটের বিমানঘাঁটি। যুদ্ধবিমান থেকে এই আক্রমণ শানানো হয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
তবে নয়াদিল্লির তরফে এই বিবৃতি জারি করার আগেই বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলার বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলে ইসলামাবাদ। পাক সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখার (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন বা আইএসপিআর) মুখপাত্র আহমেদ শরিফ চৌধরি জানিয়েছেন, রাওয়ালপিন্ডির নুর খান, চালওয়ালের মুরিদ এবং পঞ্জাব প্রদেশের ঝাং জেলার রফিকি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হেনেছে ভারত।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এ ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের বক্তব্যে যথেষ্ট মিল পাওয়া গিয়েছে। ফলে পাক বিমানবাহিনীর যে যথেষ্ট লোকসান হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কর্নেল কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা অবশ্য রাওয়ালপিন্ডির নুর খানে হামলার তথ্য দেননি। অন্য দিকে, চাকলালা, রহিম ইয়ার খান, পসরুর এবং সিয়ালকোটের বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় প্রত্যাঘাতের কথা স্বীকার করেনি পাকিস্তান।
বিশ্লেষকদের দাবি, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে বেছে বেছে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটিগুলিকে নিশানা করেছে ভারত। উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই নুর খান ছাউনিটির কথা বলা যেতে পারে। পাক সেনাবাহিনীর সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডির এই ঘাঁটি থেকে রাজধানী ইসলামাবাদের দূরত্ব মেরেকেটে ১০ কিলোমিটার। বিমানবাহিনীর বড় অংশকে এখান থেকেই পরিচালনা করে তারা।
কৌশলগত দিক থেকে নুর খান ঘাঁটির গুরুত্ব অপরিসীম। বেনজির ভুট্টো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিকে ঘিরে রেখেছে এটি। সংশ্লিষ্ট ছাউনির ভিতরে রয়েছে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কলেজ। ইসলামাবাদের অধিকাংশ অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এই ঘাঁটিতে থাকার সম্ভাবনা প্রবল, বলছেন সাবেক সেনা অফিসারেরা।
বিশ্লেষকদের কথায়, পাক বায়ুসেনার রসদ সরবরাহের প্রাণকেন্দ্র হল নুর খান বিমানঘাঁটি। সারা বছর এখানে মোতায়েন থাকে সি-১৩০ হারকিউলিস এবং সিএন-২৩৫-এর মতো মালবাহী ফৌজি বিমান। এগুলির মাধ্যমে এখান থেকেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) রসদ এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী।
পাশাপাশি আকাশপথে নজরদারি ও প্রত্যাঘাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘এয়ার মোবিলিটি উইং’ এবং ‘এয়ার ডিফেন্স কমান্ড’-এর সদর দফতরও রয়েছে নুর খান বিমানঘাঁটিতে। পাক পঞ্জাব প্রদেশের চাকওয়াল জেলায় অবস্থিত মুরিদ বায়ুসেনা ছাউনি থেকে ভারতের আন্তর্জাতিক সীমান্ত একেবারেই দূরে নয়। মূলত, ড্রোন ঘাঁটি হিসাবে এটিকে ব্যবহার করেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি অফিসারেরা।
সূত্রের খবর, তুরস্কের অত্যাধুনিক বের্যাক্টার টিবি-২-এর মতো অত্যাধুনিক ড্রোন মুরিদ ঘাঁটিতে রেখেছে পাকিস্তান। রাজস্থান লাগোয়া পাকিস্তানের শোরকোটের রফিকি বায়ুসেনা ঘাঁটির গুরুত্বও অপরিসীম। ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ৩৩৭ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই ছাউনিতে রয়েছে ১০ হাজার ফুট লম্বা অতিরিক্ত রানওয়ে। যুদ্ধবিমানের জরুরি অবতরণের জন্য এটিকে ব্যবহার করে পাক বিমানবাহিনী।
অটারী-ওয়াঘা সীমান্তের অদূরে রফিকি বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন রয়েছে পাক বিমানবাহিনীর চিনের তৈরি জেএফ-১৭ এবং ফ্রান্সের মিরাজ় ৫পিএ নামের যুদ্ধবিমানের বহর। এ ছাড়া সেখানে আছে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং কয়েকটি হেলিকপ্টার ইউনিটও। অতীতে সংঘাতের সময় বহু বার এই বিমান ছাউনি থেকে বড় আকারের আক্রমণ পরিচালনা করতে দেখা গিয়েছে পাক বায়ুসেনাকে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে প্রাণ দেন পাক বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সরফরাজ আহমদ রফিকি। পরবর্তী কালে তার নামানুসারে শোরকোট ঘাঁটির নতুন নামকরণ করে ইসলামাবাদ। এতে আঘাত হেনে কৌশলগত দিক থেকে ভারত এগিয়ে থাকল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
মুরিদের অবস্থান আবার পাক অধিকৃত কাশ্মীরের (পিওকে) একেবারে গায়ে। এই বিমানঘাঁটির পাঁচটি ড্রোন স্কোয়াড্রনই গত তিন দিন ধরে নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) ও সীমান্ত লঙ্ঘন করে ধারাবাহিক হামলা চালাচ্ছে বলে সেনা সূত্রের খবর। সেই কারণেই ইসলামাবাদের এই ছাউনিকে নিশানা করে ভারতীয় বিমানবাহিনী।
অন্য দিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলায় রহিম ইয়ার খান বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে ‘ডন’ এবং ‘পিটিভি’র মতো পাক সংবাদমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘ইসলামাবাদ এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির বন্ধুত্বের চিহ্নকে নিশানা করেছে ভারত।’’
উল্লেখ্য, পাক পঞ্জাবের দক্ষিণে অবস্থিত রহিম ইয়ার খান বিমানবন্দর শেখ জ়ায়েদ বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। রাজস্থান সীমান্তের খুব কাছে হওয়ায় বিমানঘাঁটিটির ভৌগোলিক গুরুত্ব অপরিসীম। লড়াকু জেটের পাশাপাশি এখান থেকে অসামরিক বিমান পরিষেবাও পরিচালনা করে শাহবাজ় শরিফের সরকার।
সংঘাত চলাকালীন ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে পাকিস্তান। এ প্রসঙ্গে কর্নেল কুরেশি এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা বলেছেন, ‘‘ইসলামাবাদের বাহিনীর আক্রমণাত্মক ভঙ্গি রয়েছে।’’ সংঘর্ষবিরতির পর ওই বাহিনীকে ইসলামাবাদ পিছনে সরিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
সংঘর্ষবিরতির আগে জম্মু-কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে লাগাতার গোলাবর্ষণ চালায় পাক সেনা। ইচ্ছাকৃত ভাবে জনবহুল এলাকা এবং ধর্মীয় স্থানগুলিকে নিশানা করে তারা। শনিবার, ১০ মে, সকালে জম্মুর শম্ভু মন্দিরে পাক গোলা এসে পড়ে। এর আগে ভূস্বর্গের একটি গুরুদ্বারকে নিশানা করেছিল পাক ফৌজ।
ইসলামাবাদের এই গোলাবর্ষণে প্রাণ হারিয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরের রাজৌরী জেলার এক পদস্থ আধিকারিক। বছর ৫৫-র ওই ব্যক্তির নাম রাজকুমার থাপ্পা। রাজৌরীর অতিরিক্ত জেলা উন্নয়ন কমিশনার ছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৮ মে রাতে ভারতের একাধিক জায়গায় ড্রোন হামলা চালায় ইসলামাবাদ। ওই দিনই ভোরে পাল্টা ড্রোন দিয়ে প্রত্যাঘাত হানে ভারতীয় ফৌজ। তাতে ধ্বংস হয়ে যায় পাকিস্তানের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সূত্রের খবর, এতে চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের এয়ার ডিফেন্স হারায় পশ্চিমের প্রতিবেশী।
কিন্তু, এতে দমে না গিয়ে আক্রমণ বজায় রেখেছিল পাকিস্তান। ফলে মুহুর্মুহু প্রত্যাঘাত হানতে বাধ্য হয়েছে নয়াদিল্লি। এতে চিনের তৈরি দু’টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান হারিয়েছে ইসলামাবাদ। উ়ড়ে গিয়েছে আরও একটি রেডার স্টেশন। তবে বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ইসলামাবাদকে ভারতীয় বিমানবাহিনী সবচেয়ে বড় আঘাত দেয়। সংঘর্ষবিরতির জন্য একে অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।