ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিতে এ বার আসরে রোলস-রয়েস। নয়াদিল্লির কাছে দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক রণতরীর নকশা প্রস্তুত করার আগ্রহ দেখিয়েছে এই জনপ্রিয় ব্রিটিশ গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা। তাদের থেকে ‘মেরিন গ্যাস টারবাইন’ ইঞ্জিন উপহার পেলে এ দেশের নৌসেনার হাত যে অনেকটা শক্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
চলতি বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুম্বই বন্দরে নোঙর করে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ’-এর একগুচ্ছ রণতরী। এই গোষ্ঠীর প্রধান যুদ্ধপোতটি হল বিমানবাহী ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েল্স’। সংশ্লিষ্ট রণতরীটি ভারতের জলসীমায় প্রবেশ করা ইস্তক বৈদ্যুতিন যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের ব্যাপারে একের পর এক বিবৃতি দেয় রোলস-রয়েস। ফলে এ ব্যাপারে তুঙ্গে ওঠে জল্পনা।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই বৈদ্যুতিক যুদ্ধজাহাজ? কেন এই ধরনের অত্যাধুনিক রণতরীকে বহরে শামিল করতে চাইছে ভারতীয় নৌবাহিনী? প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, যে সমস্ত যুদ্ধজাহাজ বৈদ্যুতিক শক্তিকে ব্যবহার করে সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকে তাদেরই বলা হয় বৈদ্যুতিক রণতরী। ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েল্স’কে এই গোত্রের জলযান বলা যেতে পারে। বিদ্যুৎশক্তি দ্বারা চালিত হওয়ার কারণে এর একাধিক সুবিধা রয়েছে।
বিদ্যুৎশক্তি চালিত যুদ্ধজাহাজে মূলত ‘হাইব্রিড’ ইঞ্জিন ব্যবহার হয়ে থাকে। এর ভিতরে থাকে একটি বৈদ্যুতিক মোটর, যাকে গ্যাস টারবাইন বা ডিজ়েল জেনারেটরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে হয়। রণতরীটি চলতে শুরু করলে ক্রমাগত বিদ্যুতের জোগান দিতে থাকে সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ওই যুদ্ধজাহাজকে সমুদ্রে মোতায়েন রাখতে পারে নৌবাহিনী। বার বার জ্বালানি ভরার জন্য তার বন্দরে ভেড়ারও প্রয়োজন নেই।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েল্স’-এ রয়েছে রোলস-রয়েসের তৈরি ‘এমটি৩০ মেরিন গ্যাস টারবাইন’ ইঞ্জিন। এটি ৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এ ছাড়া বিমানবাহী রণতরীটিতে আছে আরও চারটি মাঝারি গতিসম্পন্ন ডিজ়েল জেনারেটর। অর্থাৎ, ‘হাইব্রিড’ ইঞ্জিনটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১০৯ মেগাওয়াট, যা দিয়ে একটা ছোটখাটো গ্রামকে আলোকিত রাখা যাবে।
ব্রিটেনের বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাটির প্রতিরক্ষা শাখা ঠিক এই ধরনের একটি ইঞ্জিন ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে তুলে দিতে ইচ্ছুক। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন রোলস-রয়েসের ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অভিষেক সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘ইন্টিগ্রেটেড হাইব্রিড ইলেকট্রিক এবং ফুল ইলেকট্রিক প্রপালশান— এই দু’ধরনের ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর রণতরী নির্মাণ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ।’’
রোলস-রয়েসের পদস্থ কর্তাটির দাবি, ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীকে এই ধরনের ইঞ্জিন বহুল পরিমাণে সরবরাহ করেছেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অভিষেক সিংহ বলেন, ‘‘এমটি৩০ ইতিমধ্যেই শক্তি এবং নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হয়েছে। একে ব্যবহার করে অত্যাধুনিক রণতরী নির্মাণ করা সম্ভব। সেই কারণেই আমরা ভারতের নৌ-অফিসার এবং প্রতিরক্ষা গবেষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতে ইচ্ছুক।’’
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, বিদ্যুৎশক্তিচালিত রণতরীর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল গতির পরিবর্তন। ডিজ়েল ইলেকট্রিক চালিত জাহাজগুলির তুলনায় এগুলি মাঝসমুদ্রে অনেকটা বেশি গতি বৃদ্ধি করতে পারে। ফলে শত্রুর রণতরীকে তাড়া করা বা দ্রুত ছুটে গিয়ে আক্রমণ শানানো অনেকটাই সহজ হয়।
দ্বিতীয় সুবিধা হল, এই ধরনের ‘হাইব্রিড’ ইঞ্জিনের সাহায্যে অনেক কম জ্বালানি খরচ করে আকারে বড় বিমানবাহী রণতরী চালানো সম্ভব। এ ব্যাপারে উদাহরণ দিতে গিয়ে সাবেক সেনাকর্তাদের অনেকেই ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘আইএনএস বিক্রান্ত’-এর সঙ্গে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েল্স’-এর তুলনা টেনেছেন। সেখানেই উঠে এসেছে ধারে ও ভারে প্রথমটির তুলনায় কী ভাবে এগিয়ে আছে দ্বিতীয় যুদ্ধজাহাজটি।
ভারতীয় নৌসেনার বিমানবাহী রণতরীর ওজন ৪৫ হাজার টন। প্রায় ২৬৩ মিটার লম্বা সংশ্লিষ্ট যুদ্ধপোতটি ৩৬টি লড়াকু জেট বহনে সক্ষম। মাঝসমুদ্রে ঘণ্টায় ৩০ নটিক্যাল মাইল (৫৬ কিমি/ঘণ্টা) বেগে ছুটতে পারে ‘বিক্রান্ত’। অন্য দিকে ‘এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েল্স’-এর ওজন ৮০ হাজার টন। ৪৮টি যুদ্ধবিমান নিয়ে সমুদ্রে সর্বোচ্চ ৩২ নটিক্যাল মাইল বেগে আক্রমণ করার সক্ষমতা রয়েছে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ’-এর এই রণতরীর।
এ বছরের অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সফর করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। সেখানেই প্রতিরক্ষা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সেরে ফেলে দুই দেশ। গত ৯ অক্টোবর যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের সময় এর ঘোষণা করেন মোদী। বলেন, ‘‘এ বার থেকে ইংরেজদের রয়্যাল এয়ারফোর্সে প্রশিক্ষকের কাজ করবে ভারতীয় বিমানবাহিনী।’’
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এ দেশের বিমানবাহিনীর ‘ফ্লাইং ইনস্ট্রাকটার’ পদমর্যাদার কর্মী বা অফিসারেরা এই দায়িত্ব পাবেন বলে জানিয়েছেন মোদী। তবে কী কী ধরনের প্রশিক্ষণ রয়্যাল এয়ারফোর্সকে দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট নয়। নয়াদিল্লির বায়ুসেনা বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকে। সেই তালিকায় লড়াকু জেট ছাড়াও রয়েছে হামলাকারী হেলিকপ্টার ও ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এবং মালবাহী বিমান ও কপ্টার। এ ছাড়াও আছে ‘গরুড়’ নামের একটি বিশেষ কমান্ডো বাহিনী।
এই ইস্যুতে স্টার্মারের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এ দেশের গতিশীলতা এবং ব্রিটেনের দক্ষতা একত্রিত হয়ে একটি অনন্য সমন্বয় তৈরি করবে। দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারি বিশ্বাস, প্রতিভা এবং প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত।’’ মুম্বইয়ের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শেষে ইংরেজদের সঙ্গে একটি ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তিও সেরে নিয়েছে নয়াদিল্লি।
সেই সমঝোতা অনুযায়ী, ভারতীয় ফৌজকে একটি হালকা ওজনের বহুমুখী ক্ষেপণাস্ত্র (লাইটওয়েট মাল্টিরোল মিসাইল বা এলএমএম) সরবরাহ করবে ব্রিটেন। হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘মার্টলেট’। ইংরেজদের পৌরাণিক কাহিনিতে এই নামের একটি পাখি রয়েছে। পা-বিহীন সেই খেচর কখনও বাসা বাঁধে না। এ-হেন ‘মার্টলেট’ ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পেতে ব্রিটিশ সরকারকে ৩৫ কোটি পাউন্ডের বরাত দিয়েছে নয়াদিল্লি। ডলারের নিরিখে টাকার অঙ্কটা প্রায় ৪৬ কোটি ৮০ লক্ষ। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি কী পরিমাণে নয়াদিল্লির অস্ত্রাগারে জমা হবে, তা জানা যায়নি।
‘মার্টলেট’ প্রকৃতপক্ষে একটি লেজ়ার নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র (লেজ়ার গাইডেড ব্যাটেলফিল্ড মিসাইল)। আক্রমণ এবং রক্ষণ— দু’টি কাজেই একে ব্যবহার করতে পারবে ফৌজ। এর নির্মাণকারী সংস্থা হল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উত্তর দিকের বেলফাস্ট এলাকার ‘থেলস এয়ার ডিফেন্স’। চার ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির ওজন ১৩ কেজি। প্রায় তিন কেজি বিস্ফোরক বহণ করতে পারে ‘মার্টলেট’। শব্দের প্রায় দেড় গুণ গতিতে (১.৫ ম্যাক) ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করার ক্ষমতা রয়েছে এই ব্রিটিশ মারণাস্ত্রের।
বহুমুখী ক্ষমতাসম্পন্ন ‘মার্টলেট’-এর সাহায্যে আকাশ থেকে মাটিতে (এয়ার টু সারফেস), আকাশ থেকে আকাশে (এয়ার টু এয়ার), ভূমি থেকে আকাশে (সারফেস টু এয়ার) এবং ভূমি থেকে ভূমিতে (সারফেস টু সারফেস) আক্রমণ শানাতে পারবে ফৌজ। হামলাকারী কপ্টার, ড্রোন, রণতরী এবং মাটিতে রাখা লঞ্চার থেকে একে উৎক্ষেপণ করার সুবিধা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা অবশ্য খুব বেশি নয়, মাত্র আট কিলোমিটার। তবে মারণাস্ত্রটির একাধিক শ্রেণিবিভাগ রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে ব্রিটিশ স্থল এবং নৌবাহিনীর (পোশাকি নাম রয়্যাল নেভি) বহরে রয়েছে ‘মার্টলেট’।
গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করেছে ব্রিটেনের তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র। ‘মার্টলেট’-এর সাহায্যে একের পর এক ড্রোন এবং বহুমুখী কপ্টারকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করে মস্কোর রক্তচাপ বাড়িয়েছে কিভের ফৌজ। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে, ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির চুক্তি করে ঘরের মাটিতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্টার্মার। এর জেরে ‘থেলস এয়ার ডিফেন্স’-এ সরাসরি চাকরি পাবেন অন্তত ৭০০ জন। অন্য দিকে নয়াদিল্লির দাবি, এই প্রতিরক্ষা চুক্তির জেরে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে আরও মজবুত হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।
স্বাধীনতার পর থেকে রণতরী নির্মাণের ক্ষেত্রে রুশ প্রযুক্তি বেশি ব্যবহার করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী। এ দেশের কিছু যুদ্ধজাহাজে রয়েছে ইউক্রেনের ইঞ্জিন। এ ছাড়া ডুবোজাহাজ নির্মাণ প্রকল্পগুলিতে স্পেন এবং জার্মানির প্রতিরক্ষা সংস্থার অন্তর্ভুক্তি দেখে পাওয়া গিয়েছে। রোলস-রয়েস ‘এমটি৩০ মেরিন গ্যাস টারবাইন’ ইঞ্জিনের বরাত পেলে সেখানে পঞ্চম দেশ হিসাবে অন্তর্ভুক্তি ঘটবে ব্রিটেনের।
এর আগে ভারতীয় বিমানবাহিনীকে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন সরবরাহের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল রোলস-রয়েস। কিন্তু, তাতে সে ভাবে কান দেয়নি মোদী সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। তবে নৌসেনার ক্ষেত্রে অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে কেন্দ্র। এ ক্ষেত্রে আবার অন্য একটি সমস্যা রয়েছে। যুদ্ধজাহাজ তৈরির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনেকটাই অর্জন করতে পেরেছে নয়াদিল্লি। আর তাই রোলস-রয়েসের মেগা অফারে কেন্দ্র কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বর্তমানে ভারতীয় সেনার হাতে রয়েছে দু’টি বিমানবাহী রণতরী। আরও একটি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। সেই যুদ্ধজাহাজ পরমাণু শক্তিচালিত হলে প্রয়োজন হবে না রোলস-রয়েসের ইঞ্জিনের। সে ক্ষেত্রে ‘ডেস্ট্রয়ার’ বা ‘ফ্রিগেট’ শ্রেণির রণতরীগুলির জন্য সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন সরবরাহ করতে পারে ওই ব্রিটিশ বহুজাতিক বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা। এ ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে কি না, সেটাই এখন দেখার।