মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রামধাক্কা! শুল্কযুদ্ধে ফের ‘বন্ধু’ রাশিয়াকে পাশে পেল নয়াদিল্লি। আমেরিকার লাল চোখ এড়িয়ে ভারতকে আরও সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির কথা ঘোষণা করল মস্কো। পাশাপাশি, এ দেশের পণ্যের জন্য ঘরোয়া বাজার খুলে দেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে ক্রেমলিন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, সব মিলিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার ‘ইটের বদলে পাটকেল’ নীতি নিলে যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচাপ যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ২০ অগস্ট ভারতের সঙ্গে খনিজ তেলের বাণিজ্য নিয়ে ‘মেগা অফার’-এর কথা ঘোষণা করেন এ দেশে কর্মরত রুশ উপ-বাণিজ্য প্রতিনিধি এভজ়েনি গ্রিভা। নয়াদিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের থেকে ‘তরল সোনা’ কেনার ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত ছাড় পাবে ভারত।’’ তবে এ ব্যাপারে দু’তরফে যে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রাখা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি।
গ্রিভার কথায়, ‘‘ভূরাজনৈতিক জটিলতা সত্ত্বেও আগের মতো রাশিয়ার থেকে ‘উরাল ক্রুড’ (মস্কোর খনিজ তেলের নাম) আমদানি করবে ভারত। তাই অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’’ সে ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের ‘তরল সোনা’ কতটা সস্তা হতে চলেছে? এই প্রশ্নের জবাবে গ্রিভা জানিয়েছেন, ‘‘এ দেশের যে সমস্ত সংস্থা তেল কিনছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারটা ঠিক করবে আমাদের কোম্পানি। সেটা পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’’
অন্য দিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কড়া শুল্কনীতি যে নয়াদিল্লির সামনে ‘বাড়তি চ্যালেঞ্জ’ তৈরি করেছে, তা একবাক্যে স্বীকার করেছেন রুশ ডেপুটি চিফ অফ মিশন রোমান বাবুশকিন। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরে মস্কোর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বহিরাগত চাপ সত্ত্বেও এখানকার সরকার যে ক্রেমলিনের থেকে জ্বালানি সংগ্রহ বজায় রাখবে, সেটুকু আত্মবিশ্বাস আমাদের রয়েছে।’’ বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁর এই মন্তব্যকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযান (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি কিভ আক্রমণের নির্দেশ দিতেই মস্কোর উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। গত সাড়ে তিন বছরে বাড়তে বাড়তে ওই নিষেধাজ্ঞার সংখ্যা ১৬ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ক্রেমলিনকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনকারী সংস্থা ‘সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফ্ট থেকেও বার করে দেয় পশ্চিমি বিশ্ব।
এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে বড় সিদ্ধান্ত নেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ‘বন্ধু’ ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির প্রস্তাব দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই প্রস্তাব লুফে নিয়ে মস্কোর ‘উরাল ক্রুড’ আমদানি করতে থাকে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, সেই ‘তরল সোনা’ থেকে উৎপাদিত পেট্রোপণ্য (পেট্রল-ডিজ়েল) পশ্চিম ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে বিপুল অর্থও রোজগার করেছে এ দেশের একাধিক সংস্থা।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি আমেরিকা। কিন্তু, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্প কুর্সি পেতেই সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে নতুন করে শুরু হয় জলঘোলা। গত জুলাইয়ে আচমকাই ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি, ‘‘ভারত লাগাতার রুশ তেল কিনতে থাকায় চাঙ্গা থাকছে মস্কোর অর্থনীতি। এর ফলে ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারছে ক্রেমলিন।’’
জুলাইয়ের গোড়া থেকেই রুশ ‘উরাল ক্রুড’ কেনা নিয়ে ঘন ঘন ভারতকে হুমকি দিতে থাকেন ট্রাম্প। নয়াদিল্লি অবশ্য তাঁকে বিষয়টি বোঝানোর কম চেষ্টা করেনি। এ ক্ষেত্রে মোদী সরকারের পাল্টা যুক্তি হল, জাতীয় স্বার্থে মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি করছে ভারত। তা ছাড়া এই নীতির জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে খনিজ তেলের দর। কিন্তু, কেন্দ্রের যাবতীয় ‘সুপরামর্শে’ কান না দিয়ে অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
জুলাইয়ে ট্রাম্প অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় আমেরিকার বাজারে ভারতীয় পণ্যে মোট করের অঙ্ক দাঁড়াচ্ছে ৫০ শতাংশ। আগামী ২৮ অগস্ট থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি পিছু হটবে বলে আশাবাদী ছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। উল্টে রাশিয়ার থেকে খনিজ তেলের আমদানি হ্রাস করা হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় মোদী সরকার।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের বাড়াবাড়ির মধ্যেই মস্কো সফরে যান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর) অজিত ডোভাল। তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ডোভাল নয়াদিল্লি ফেরার পর তিন দিনের সফরে ক্রেমলিন যান বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি সেখানে পৌঁছোনোর কয়েক ঘণ্টা পরেই ‘তরল সোনা’ বিক্রির ব্যাপারে অতিরিক্ত ছাড়ের কথা ঘোষণা করেন রুশ উপ-বাণিজ্য প্রতিনিধি গ্রিভা।
গত ২০ অগস্ট মস্কোয় ভারত-রাশিয়া ‘বিজ়নেস ফোরাম’-এর আলোচনায় যোগ দেন জয়শঙ্কর। সেখানে ছিলেন রাশিয়ার উপ-বিদেশমন্ত্রী ডেনিস মান্টুরভও। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে নগরায়ন এবং আধুনিকীকরণের জন্য নতুন নতুন জিনিসের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সংস্থাগুলির সঙ্গে রুশ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকেও আমরা এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’’
এর পাশাপাশি ফের এক বার ভারত-রাশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পক্ষে সওয়াল করেন জয়শঙ্কর। এ ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন মস্কোর উপ-বিদেশমন্ত্রী মান্টুরভও। তিনি বলেন, ‘‘নয়াদিল্লিকে আমরা তেল সরবরাহ অব্যাহত রাখছি। প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেলে দূর হবে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা। বর্তমানে ডলারের পরিবর্ত স্থানীয় মুদ্রায় (রুপি ও রুবল) লেনদেন বাড়াচ্ছে ক্রেমলিন ও নয়াদিল্লি।
সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে তেল কেনা শুরু করে এ দেশের দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল ও ভারত পেট্রোলিয়াম। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির পর এ বছরের জুলাইয়ে মস্কো থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি বন্ধ করে তারা। ‘উরাল ক্রুডে’ ছাড় বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সংস্থা দু’টি ক্রেমলিনের থেকে ফের তা বিপুল পরিমাণে কিনছে বলে জানা গিয়েছে।
গত সাড়ে তিন বছরে খনিজ তেলে রাশিয়া সব সময় যে একই রকমের ছাড় দিয়েছে, এমনটা নয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার গোড়ার দিকে দাম অনেকটা কমিয়েছিল মস্কো। পরে ছাড়ের মাত্রা হ্রাস করে ক্রেমলিন। এটি ফের বাড়ানো হবে বলে স্পষ্ট করেছে পুতিন প্রশাসন। ফলে আগামী কয়েক মাসে ‘উরাল ক্রুড’ আমদানির মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে নয়াদিল্লি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ট্রাম্পের শুল্কের জন্য মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্য দামি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সেখানে এ দেশের সামগ্রী বিক্রি করা কঠিন হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির রুশ দূতাবাস জানিয়েছে, এ দেশের পণ্যের জন্য বাজার খুলতে পারে মস্কো। দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বছরে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও জানা গিয়েছে।
ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে দু’টি সমস্যার জায়গা রয়েছে। প্রথমত হাতিয়ার, খনিজ তেল থেকে শুরু করে রাসায়িক এবং সার— মস্কোর থেকে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী আমদানি করে থাকে নয়াদিল্লি। তুলনামূলক ভাবে রুশ বাজারে সে ভাবে বিক্রি হয় না এ দেশের সামগ্রী। দ্বিতীয়ত, রুপি-রুবল বাণিজ্যকে আরও মজবুত করতে দু’তরফে আরও বেশি পরিমাণে উদ্যোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অন্য দিকে, ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে মার্কিন বাজারে এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির যথেষ্ট দাপট রয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য মুখ ঘুরিয়ে তারা মস্কোর দিকে যেতে থাকলে আমেরিকার অর্থনীতিতে পড়বে বিশাল প্রভাব। ইতিমধ্যেই ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে এর ইঙ্গিত মিলছে বলে সতর্ক করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
এ বছরের অগস্টে মাত্র চার দিনে আমেরিকার শেয়ার বাজার থেকে উবে যায় লক্ষ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কটা প্রায় ৮৭ লক্ষ কোটি বলে জানা গিয়েছে। এর জেরে মার্কিন লগ্নিকারীদের মাথায় পড়েছে হাত। যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির স্টকের সূচক নিম্নমুখী রয়েছে। সেই তালিকায় আছে গুগ্ল, অ্যাপ্ল, মেটা, অ্যামাজ়ন এবং এনভিডিয়া।
আমেরিকা অবশ্য ভারতের উপরে শুল্ক চাপানোর অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। ওয়াশিংটনের যুক্তি, দ্রুত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে চাইছেন ট্রাম্প। সেই কারণেই অতিরিক্ত শুল্কের বোঝা নয়াদিল্লির ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, ‘‘মস্কোর উপর পরোক্ষ চাপ তৈরি করতে চাইছেন আমাদের প্রেসিডেন্ট। সেই কারণে নয়াদিল্লির উপরে শুল্ক চাপাতে হয়েছে।’’
আগামী দিনে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে মস্কো সফরে যেতে পারেন ট্রাম্প। সেখানে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবেন তিনি। কিন্তু আলোচনায় ফল না হলে ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে তাঁর সরকার। অন্য দিকে, এ বছরই নয়াদিল্লি আসবেন রুশ প্রেসিডেন্ট। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর। সেখানে একাধিক বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।