মাথার উপর রাশিয়া, পায়ের তলায় চিন, দক্ষিণ-পূর্বে গোবি মরুভূমি আর পশ্চিমে আলতাই পর্বতমালা। বেজিঙের পিঠে কুঁজের মতো স্থলবেষ্টিত দেশটিতে ধীরে ধীরে পা জমাচ্ছে ভারত। সেই লক্ষ্যে ওই এলাকার সীমান্তরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি। পরিকল্পনা রয়েছে সেখানকার খনিজ সম্পদকে এ দেশে নিয়ে আসার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কৌশলগত এই পদক্ষেপকে তাই ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসাবে গণ্য করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।
নয়াদিল্লির বিদেশনীতিতে গুরুত্ব পাওয়া দেশটি হল মঙ্গোলিয়া। একে মস্কো ও বেজিঙের মাঝে একটি ‘বাফার’ রাষ্ট্র বললে অত্যুক্তি হবে না। একসময় সেখানকার রাজা চেঙ্গিজ় খানের আতঙ্কে কাঁপত গোটা দুনিয়া। পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীর পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। এর আওতায় ছিল মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপের কিছু অংশ এবং প্রায় গোটা চিন। এ-হেন মঙ্গোলদের ভারতের কাছে সীমান্তরক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে চাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ।
ইতিহাসের পাতায় বিরাট কীর্তি লেখা থাকলেও বহু দিন আগেই মঙ্গোলদের সৌভাগ্যের সূর্য অস্ত গিয়েছে। বর্তমানে তাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হল সীমিত জনসংখ্যা। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ থাকে রাজধানী উলানবাটোরে। সেনাবাহিনীও যে বিরাট বড়, এমনটা নয়। এ-হেন পরিস্থিতিতে প্রায়ই ‘আগ্রাসী’ চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র দৌরাত্ম্য সহ্য করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে চেঙ্গিজ়ের উত্তরসূরিদের।
মঙ্গোলিয়ার শীর্ষকর্তাদের দাবি, মূলত গোবি মরুভূমির দিক থেকে তাদের জমি কব্জা করার চেষ্টা চালাচ্ছে পিএলএ। দুই দেশের সীমান্ত প্রায় ৪,৬৩০ কিলোমিটার লম্বা। এর মধ্যে গোবির দিক দিয়ে তিন দেশের একটি সংযোগস্থল রয়েছে। সেখানে পৌঁছোতে পারলে বেজিঙের সীমান্ত এগিয়ে যাবে রাশিয়া পর্যন্ত। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত দিক থেকে একটা বিরাট সুবিধা পাবেন মান্দারিনভাষীরা। এই সমস্যাই উলানবাটোরের কপালের ভাঁজ চওড়া করেছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
অন্য দিকে স্থলসীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের হাতে রয়েছে চারটি বিশেষ বাহিনী। সেগুলি হল, সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ), ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ বা আইটিবিপি), সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) এবং অসম রাইফেল্স। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীনে থাকা সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলির মধ্যে সংখ্যার নিরিখে এগিয়ে আছে বিএসএফ। এর মধ্যে অসম রাইফেল্সের নেতৃত্বে রয়েছে ভারতীয় সেনা। বাকিগুলির মাথায় রয়েছেন আইপিএস অফিসারেরা।
মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত সুরক্ষায় এ দেশের কোন বাহিনী প্রশিক্ষণ দেবে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তবে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, এ ক্ষেত্রে পাল্লা ভারী বিএসএফের দিকে। কারণ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন থাকা এই রক্ষীদের হাতে আছে গোলন্দাজ এবং হামলাকারী ড্রোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্তেরা। এ ছাড়া মানববিহীন উড়ুক্কু যান ধ্বংসকারী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, টহলদারি জলযান এবং কপ্টার ব্যবহার করে থাকে তারা।
এর পাশাপাশি যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও রয়েছে বিএসএফের। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক সংঘাত থামার তিন মাসের মাথায় (পড়ুন ১ ডিসেম্বর) জন্ম হয় এই বাহিনীর। মাত্র ছ’বছরের মধ্যে ফের মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই প্রতিবেশী। আর সেখানে ভারতীয় সেনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে দেখা গিয়েছিল বিএসএফকে। ফলস্বরূপ ’৭১-এর যুদ্ধে ইসলামাবাদের ৯৩ হাজার ফৌজিকে বন্দি করতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি। বদলে যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্র। পাকিস্তান ভেঙে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ।
বর্তমানে ইসলামাবাদের সঙ্গে ৩,৩২৩ কিলোমিটার এবং ঢাকার সঙ্গে ৪,০৯৬ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে বিএসএফের কাঁধে। পশ্চিম দিকে পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) লাগোয়া নিয়ন্ত্রণরেখাতেও (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) এই বাহিনীকে মোতায়েন রেখেছে কেন্দ্র। ফলে সীমান্তপার সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় জঙ্গিদের সঙ্গে প্রায়ই গুলির লড়াই হয় তাদের। এ ছাড়া গুজরাতের কচ্ছ এলাকার স্যর ক্রিক খাঁড়ি নিয়েও বিবাদ রয়েছে দুই দেশের।
দীর্ঘ দিন ধরেই স্যর ক্রিক খাঁড়িকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে আসছে পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, ওই এলাকার আশপাশে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা সামরিক পরিকাঠামো বৃদ্ধি করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্তে আবার বিএসএফের সামনে রয়েছে অন্য চ্যালেঞ্জ। সেখানে গরু, সোনা, জাল নোট এবং মাদক পাচারের রমরমা। আর তাই অনুপ্রবেশ আটকাতে এই দুই সীমান্তের অধিকাংশ জায়গাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরেছে বিএসএফ।
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের হাতে বাজে ভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার পর আইটিবিপি তৈরি করে কেন্দ্র। বেজিং অধিকৃত তিব্বত সীমান্তে মোতায়েন রয়েছে তারা। এর দু’টি অংশ রয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) এবং ম্যাকমোহন লাইন। এলএসির ওপারের আকসাই চিন এলাকাটি আসলে লাদাখের অংশ। কিন্তু, ১৯৬২-র যুদ্ধে তা দখল করে নেয় পিএলএ, আজও যা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি নয়াদিল্লি। অন্য দিকে ব্রিটিশ আমলের ম্যাকমোহন লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসাবে মানতে নারাজ ড্রাগন সরকার।
ভারত ও তিব্বতের অন্তর্বর্তী ৩,৪৮৮ কিলোমিটার লম্বা সীমান্তের প্রায় পুরোটা নিয়েই নয়াদিল্লি ও বেজিঙের মধ্যে রয়েছে বিবাদ। অরুণাচল প্রদেশকে দক্ষিণ তিব্বতের অংশ বলে মনে করে ড্রাগন সরকার। আর তাই উত্তর-পূর্বের রাজ্যটির উপর লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে ড্রাগনের। ফলে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তরক্ষীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব আইটিবিপির হাতে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের একাংশ। ভারতীয় সেনার সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের।
নেপালের ১,৭৫১ কিলোমিটার এবং ভুটানের ৬৯৯ কিলোমিটার সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে এসএসবি। ভারত-মায়ানমারের (সাবেক বর্মা) ১,৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্তে আবার অসম রাইফেল্সকে মোতায়েন রেখেছে কেন্দ্র। এই তিন দেশের সঙ্গেই খোলা সীমান্ত বা ওপেন বর্ডার রয়েছে নয়াদিল্লির। এখানে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন হয় না। মায়ানমার সীমান্তে অবশ্য মাদকের রমরমা রয়েছে। খোলা সীমান্তের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মাঝেমধ্যেই হামলা চালিয়ে থাকে স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর ভারত সফর করেন মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্ট খুরেলসুখ উখনা। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর ১০টি চুক্তিতে সই করতে দেখা যায় তাঁকে। এর মধ্যে রয়েছে উলানবাটোরের বাহিনীকে সীমান্তরক্ষার প্রশিক্ষণ। এ ছাড়া চেঙ্গিজ়ের দেশে একটি তেল শোধনাগার তৈরির জন্য লগ্নিতে সম্মত হয়েছে ভারত। পাশাপাশি, মঙ্গোলদের বিনামূল্যে ই-ভিসা এবং লাদাখে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন স্থাপনের ব্যাপারেও অনুমতি দিয়েছে নয়াদিল্লি।
মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে একটি বটগাছের চারা রোপণ করেন মঙ্গোল প্রেসিডেন্ট। প্রয়াত মায়ের সম্মানে গাছটি লাগানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন উখমা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৭০তম বর্ষ পালন করছে ভারত ও মঙ্গোলিয়া। ২০২৩ সালে দু’তরফে বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ছ’কোটি ডলার। ২০২৪ সালে সেটাই বেড়ে ১১ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়। অর্থাৎ, মাত্র এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দিল্লি ও উলানবাটোরের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য।
মঙ্গোল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘‘উলানবাটোরের জ্বালানি নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করতে ১৭ কোটি ডলারের ঋণ দিয়েছি আমরা। ওই অর্থে তৈরি হবে তেল শোধনাগার প্রকল্প। বিদেশের মাটিতে এটাই ভারতের বৃহত্তম অংশীদারি, যেখানে কাজ করবেন এ দেশের ২,৫০০ জনের বেশি পেশাদার।’’ এর মাধ্যমে রাশিয়া ও চিনের মধ্যবর্তী ‘বাফার’ রাষ্ট্রটির সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং অন্যান্য কৌশলগত সহযোগিতা মজবুত হবে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গোলিয়ায় বিরল খনিজের বিপুল ভান্ডারের খোঁজ মেলার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সে ব্যাপারেও উলানবাটোরের দিকে নয়াদিল্লি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। বৌদ্ধ ধর্মের দিক থেকে দুই দেশের সম্পর্ককে ‘আধ্যাত্মিক ভাইবোন’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। আর তাই লাদাখ স্বায়ত্তশাসিত পাহাড়ি উন্নয়ন পরিষদ এবং মঙ্গোলিয়ার আরখাঙ্গাই প্রদেশের মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারকের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
মোদী জানিয়েছেন, খুব দ্রুত ১০ লক্ষ প্রাচীন বৌদ্ধ পাণ্ডুলিপির ডিজিটালাইজ়েশন পদ্ধতি সম্পন্ন করার জন্য একটি প্রকল্প শুরু করবে কেন্দ্র। মঙ্গোলিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার এবং প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের। আর তাই উলানবাটোরের গণ্ডন মঠের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন করেছে বিহারের এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চেঙ্গিজ় খানের ভূমিতে সংস্কৃত শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা যে নয়াদিল্লির রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
মঙ্গোলিয়ার বাহিনীকে সীমান্ত সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দিতে সেখানকার দূতাবাসে বিশেষ অফিসার নিয়োগ করেছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করতে পারলে সেখানে সামরিক ছাউনি তৈরির অনুমতি পেতে পারে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে চিনের উপর চাপ তৈরি করা অনেকটাই সহজ হবে। উলানবাটোর সেই অনুমতি দেবে কি না, তার উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু দিন।