India Russia Oil Ties

ট্রাম্পের হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে ‘বন্ধু’ পুতিনকেই কি ভরসা করা উচিত? রুশ ‘তরল সোনা’ কিনলে কী লাভ ভারতের?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-নিষেধাজ্ঞা এবং জরিমানার হুমকি উড়িয়ে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে দিয়েছে ভারত। কেন মস্কোর ‘তরল সোনা’র সরবরাহ জারি রাখছে নয়াদিল্লি?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৫ ১৬:১০
Share:
০১ ১৮

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-হুমকিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ! রাশিয়ার থেকে খনিজ তেলের আমদানি আপাতত বন্ধ করছে না ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও মস্কোর ‘তরল সোনা’ সরবরাহে ছেদ না টানায় কতটা লাভবান হবে নয়াদিল্লি? ইতিমধ্যেই আর্থিক বিশেষজ্ঞ মহলে শুরু হয়ে গিয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। অধিকাংশেরই মত, ওয়াশিংটনের চাপে মস্কোর তেল কেনা থামিয়ে দেওয়া একেবারেই উচিত হবে না কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের। এর নেপথ্যে একাধিক যুক্তি তুলে ধরেছেন তাঁরা।

০২ ১৮

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ভারতকে অত্যন্ত সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রি করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে ১ অগস্টের মধ্যে ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুড বিক্রি হয়েছে ৬৯.৪৮ ডলারে। অন্য দিকে, ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট বা ডব্লিউটিআই এবং দুবাই ক্রুডের দাম ছিল যথাক্রমে ৬৮.৫৪ ও ৬৯.৩৬ ডলার। এ ছাড়া ডিএমই ওমানের দর ব্যারেলপ্রতি ৭৩.৫৮ ডলারে ঘোরাফেরা করেছে।

Advertisement
০৩ ১৮

রাশিয়ার অপরিশোধিত খনিজ তেলের নাম ‘উরাল্স’। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ৩০ জুন থেকে ১ অগস্টের মধ্যে ওই ‘তরল সোনা’র দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৫.৬৬ ডলারে কিনেছে ভারত। ফলে জ্বালানি বাবদ খরচের ক্ষেত্রে অনেকটাই অর্থ সঞ্চয় করতে পেরেছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তের জেরে ঘরোয়া বাজারে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতির হার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সে ভাবে বাড়েনি।

০৪ ১৮

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে খনিজ তেলের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করে নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারী দেশ হল ভারত। এ বছরের মে মাসে বিদেশ থেকে কেনা ‘তরল সোনা’র ৪০ শতাংশই এ দেশের শোধনাগারগুলিকে সরবরাহ করেছে রাশিয়া। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইরাক এবং সৌদি আরব। পশ্চিম এশিয়ার ওই দুই আরব মুলুকের থেকে যথাক্রমে ২৪.৭ এবং ১২.৬ শতাংশ খনিজ তেল আমদানি করেছে মোদী সরকার।

০৫ ১৮

এই তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে আমদানি করা খনিজ তেলের ১০ এবং ৫.৮ শতাংশ আসে এই দুই দেশ থেকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক সংস্থা ‘কেপলার’-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ার থেকে দিনে ২,২৬২ হাজার ব্যারেল ‘তরল সোনা’ কিনছে নয়াদিল্লি। ইরাক ও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটা যথাক্রমে দৈনিক ৯১৭ এবং ৫২৫ হাজার ব্যারেল।

০৬ ১৮

‘কেপলার’ জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কলম্বিয়া, নাইজ়েরিয়া এবং কুয়েতের থেকে ভারতের দৈনিক খনিজ তেল কেনার পরিমাণও নেহাত কম নয়। এই পাঁচ দেশ থেকে প্রতি দিন নয়াদিল্লির শোধনাগারগুলিতে সরবরাহ হচ্ছে যথাক্রমে ৫১৯, ৪৩৯, ১৩১, ১১৯ এবং ৮৫ হাজার ব্যারেল ‘তরল সোনা’। দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে বাদ দিয়েও নতুন বিকল্পের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র।

০৭ ১৮

পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে রাশিয়ার থেকে সর্বাধিক জীবাশ্ম জ্বালানি কিনেছে চিন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এই তালিকায় ভারত আছে তিন নম্বরে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে খনিজ তেলের পাশাপাশি রয়েছে কয়লাও। শুধু ‘তরল সোনা’ আমদানির নিরিখে এক এবং দু’নম্বরে অবশ্য আছে বেজিং এবং নয়াদিল্লি।

০৮ ১৮

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া থেকে কেনা খনিজ তেলের আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, ‘‘সস্তায় তেল কেনার সুযোগ মেলায় এখানকার একাধিক সংস্থা মস্কোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সেরে ফেলেছে। ফলে সেখান থেকে চট করে সরে আসা বেশ কঠিন। সেই কারণে রুশ তেলের সরবরাহ কমানো বা থামানোর ব্যাপারে সরকারের তরফে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।’’

০৯ ১৮

দ্বিতীয়ত, খনিজ তেলের পরিশোধন প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। সেই কারণে যে পরিকাঠামোয় ব্রেন্ট ক্রুড থেকে পেট্রল-ডিজ়েল বা অন্যান্য পেট্রোপণ্য তৈরি করা সম্ভব, রুশ উরাল্সের ক্ষেত্রে সেই একই ব্যবস্থা কাজে না-ও আসতে পারে। আর তাই ট্রাম্পের শুল্কনীতির চাপে পড়ে হঠাৎ করে মস্কোর ‘তরল সোনা’ আমদানি বন্ধ করলে উল্টে নয়াদিল্লির বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে কেন্দ্রকে।

১০ ১৮

তৃতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে ডলার নয়, টাকা এবং রুবলে বাণিজ্য চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। এর জেরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেড়েছে এ দেশের মুদ্রার গুরুত্ব। ভবিষ্যতে সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে বর্তমানে ৯০ দিনের কৌশলগত তৈলভান্ডার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে কেন্দ্র। তার জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল ‘তরল সোনা’। ফলে মস্কোর থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ করা মোদী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

১১ ১৮

চতুর্থত, গত জুলাইয়ে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়া রুশ অর্থনীতিকে পুরোপুরি ভেঙে দিতে নতুন করে মস্কোর তেলের উপরে চাপিয়ে দেয় নিষেধাজ্ঞা। ক্রেমলিনকে ব্যারেলপ্রতি ৩৫ ডলারে তেল বিক্রিতে বাধ্য করাতে চাইছে তারা। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, এই নিষেধাজ্ঞার জন্য ‘উরাল্স’-এর দর আরও কমাতে পারে রাশিয়া। ফলে আমদানি চালু রাখলে আখেরে লাভই হবে ভারতের।

১২ ১৮

স্বাধীনতার পর দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলি থেকে সবচেয়ে বেশি খনিজ তেল কিনত নয়াদিল্লি। কিন্তু, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং যুদ্ধবিগ্রহের কারণে সব সময়েই অস্থির থাকে ওই এলাকা। আর তাই শেষ এক দশকে সেখান থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানির অঙ্ক কমিয়ে ৬৫ শতাংশ এবং বর্তমানে ৫৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্র।

১৩ ১৮

সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমি দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে সম্প্রতি খনিজ তেলে ছাড়ের পরিমাণ হ্রাস করেছে রাশিয়া। এর জেরে ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম, ভারত পেট্রোলিয়াম এবং ম্যাঙ্গালোর রিফাইনারি পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড— ভারতের এই চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানির পরিমাণ হ্রাস করে। এ বছরের জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ক্রেমলিনের থেকে ২৪ শতাংশ কম তেল আমদানি করেছে তারা। গত বছরের জুলাইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা ২৩.৫ শতাংশ কম। এ দেশের পণ্যে ট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর আগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ওই চার সংস্থা।

১৪ ১৮

এত দিন রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনে তা পরিশোধনের মাধ্যমে উৎপন্ন হওয়া পেট্রোপণ্য ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে বিপুল অর্থ রোজগার করছিল ভারত। কিন্তু ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা এবং শুল্কের ভয়ে সেখানে চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। জুলাইয়ে গুজরাতের তেল পরিশোধনাগার নায়ারা এনার্জির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির ক্ষেত্রে মস্কোর যৌথ মালিকানা রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তিন জাহাজভর্তি খনিজ তেল হাতে পেতে সমস্যার মুখে পড়ছে তারা।

১৫ ১৮

গত ১৪ জুলাই রাশিয়ার থেকে তেল কেনা নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন ট্রাম্প। বলেন, মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ কিনলেই ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেবেন তিনি। সেই হুমকি অগ্রাহ্য করেই ক্রেমলিনের তেল আমদানি অব্যাহত রাখে ভারত। এর জেরে এ দেশের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ৭ অগস্ট থেকে যা কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার থেকে তেল কেনার জন্য নয়াদিল্লিকে জরিমানা দিতে হবে বলেও জানিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প।

১৬ ১৮

বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে ভারত রাশিয়ার থেকে খনিজ তেলের আমদানি কমালে জ্বালানি বাবদ অনেকটা খরচ বৃদ্ধি পাবে নয়াদিল্লির। সে ক্ষেত্রে এই খাতে আমদানি বাবদ ব্যয় বাড়তে পারে বছরে ৯০০ থেকে ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যেটা প্রায় ৭৮ হাজার কোটি থেকে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ঘরোয়া বাজারে এর প্রভাব পেট্রল-ডিজ়েলের দামে দেখা যেতে পারে।

১৭ ১৮

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার গুঁতোয় রাশিয়ার তেল রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে লাফিয়ে বাড়বে ‘তরল সোনা’র দাম। গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানিতে ১৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার খরচ করে ভারত। এ দেশের মুদ্রায় যেটা প্রায় ১১ লক্ষ কোটি ডলার। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে এই অঙ্ক যে অনেকটা বৃদ্ধি পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১৮ ১৮

সূত্রের খবর, বর্তমানে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার রাস্তা খুঁজছে মোদী সরকার। গত ১ অগস্ট ট্রাম্প অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমি শুনেছি ভারত আর রাশিয়ার থেকে তেল কিনবে না।’’ যদিও তাঁর দাবি উড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেয় নয়াদিল্লি। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘‘মস্কোর সঙ্গে আমাদের সময় পরীক্ষিত অংশীদারি রয়েছে। তৃতীয় কোনও দেশের প্রিজ়মে সেটা দেখা উচিত নয়।’’

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement