ভারতীয় ধনকুবেরদের স্বর্ণপ্রেমে ভাটা! হলুদ ধাতুর বদলে ক্রিপ্টো মুদ্রায় মন মজেছে তাঁদের। আর তাই বিটকয়েন, ইথেরিয়াম বা সোলানার মতো ডিজিটাল পয়সায় ঘর বোঝাই করছেন তাঁরা। কেন হঠাৎ সোনায় ‘অরুচি’ ধরেছে এ দেশের বিত্তবানদের? যুগের হাওয়া? না কি পরিকল্পনা করে ক্রিপ্টো মুদ্রায় লগ্নি করছেন তাঁরা? দেশের তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকদের কাছে মিলেছে এর ব্যাখ্যা।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে সোনাকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। বহু যুগ ধরে এ দেশে বিয়ে, অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘হলুদ ধাতু’র গয়না উপহার দেওয়ার চল রয়েছে। অনেকে আবার আর্থিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেও সোনা কিনে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বড় পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, দু’দশক আগেও এই বদল সে ভাবে চোখে পড়েনি।
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ক্রিপ্টো মুদ্রায় লগ্নির প্ল্যাটফর্ম ‘মুড্রেক্স’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও এডুল পটেল। তাঁর কথায়, ‘‘গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় থেকে ক্রিপ্টো মুদ্রার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। ফলে বিশ্বব্যাপী বিটকয়েন, ইথেরিয়াম বা সোলানার মতো ডিজিটাল পয়সায় বিনিয়োগের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে পিছিয়ে নেই ভারতের কোটিপতিরাও।’’
পটেল জানিয়েছেন, এ দেশে মূলত উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি বা এইচএনআই (হাই নেটওয়ার্থ ইন্ডিভিজ্যুয়াল) শ্রেণিভুক্তেরা ক্রিপ্টো মুদ্রায় ঢেলে লগ্নি করছেন। এঁদের কাছে পাঁচ কোটি বা তার বেশি মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘‘মুড্রেক্সের মাধ্যমে ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগকারীদের ৩০ শতাংশ উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি। তাঁরা ক্রিপ্টো সম্পদে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত লগ্নি করছেন।’’
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতীয় কোটিপতিদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে মূলত তিনটি ডিজিটাল মুদ্রা। সেগুলি হল বিটকয়েন, ইথেরিয়াম এবং সোলানা। এই তিনটিতে লগ্নির পরিমাণ ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ হচ্ছে অন্যান্য ক্রিপ্টো মুদ্রায়। এর মধ্যে ইউএসডিটি, এক্সআরপি এবং ডজ় উল্লেখযোগ্য। যাবতীয় ডিজিটাল মুদ্রার মধ্যে বিটকয়েনকে অবশ্য আলাদা শ্রেণিতে রেখেছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, এর সূচক ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ভাল রিটার্ন পেয়েছেন লগ্নিকারীরা।
ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগের অ্যাপ ‘কয়েনডিসিএক্স’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সুমিত গুপ্ত আবার মনে করেন, ধনী ভারতীয়দের মধ্যে লগ্নির মানসিকতায় বড় পরিবর্তন এসেছে। সেই কারণেই পোর্টফোলিয়োকে বৈচিত্রপূর্ণ করতে চাইছেন তাঁরা। তা ছাড়া ব্ল্যাকরকের মতো বহুজাতিক সংস্থা বিটকয়েন ইটিএফ চালু করায় আমজনতার ক্রিপ্টো মুদ্রায় ভরসা বেড়েছে। ফলে বর্তমানে অনেকেই একে মূল ধারার লগ্নি বলে মনে করছেন।
বিশ্লেষকদের একাংশ আবার মনে করেন ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগ বেশ লাভজনক হওয়ার কারণেই ধীরে ধীরে সে দিকে ঝুঁকছেন এ দেশের কোটিপতিরা। এর একটা সহজ উদাহরণ দিয়েছেন তাঁরা। বর্তমানে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের প্রথাগত লগ্নিতে মিলছে মাত্র ছয়-সাত শতাংশ রিটার্ন। অন্য দিকে, সোনা ও শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করলে যথাক্রমে ১০ এবং ১২ থেকে ১৬ শতাংশ মুনাফা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম বা সোলানার দাম কিন্তু এক বছরের মধ্যেই অনেকটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এনএসই-র সূচক নিফটি-৫০র প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। গত এক বছরে এটি মাত্র আড়াই শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে এক বছরে বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোমুদ্রার দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। আর দু’বছরের ক্ষেত্রে মুনাফার অঙ্ক ৮৬ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। ১৩ বছরে এই অঙ্ক পৌঁছেছে ১১৩ শতাংশে। ক্রিপ্টো মুদ্রায় এ-হেন লাভের সম্ভাবনা থাকায় এর পিছনে দৌড়তে শুরু করেছেন এ দেশের ধনীরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, ডিজিটাল মুদ্রাগুলির বৃদ্ধির সূচক খুব খারাপ হলে আগামী পাঁচ বছরে (পড়ুন ২০৩০ সাল পর্যন্ত) এতে ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে একটি বিটকয়েনের দাম দাঁড়াবে পাঁচ লক্ষ ডলার। সূচকের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার হার গড়পড়তা হলে এতে ৫৩ শতাংশের বৃদ্ধি দেখতে পাওয়া যেতে পারে। আর খুব ভাল হলে এটি বাড়বে ৭২ শতাংশ। এই হিসাবে একটি বিটকয়েনের দাম পৌঁছোবে যথাক্রমে ১২ লক্ষ এবং ২৪ লক্ষ ডলার।
তবে ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগ যে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, তা ভালই জানেন এ দেশের কোটিপতিরা। সেই কারণে লগ্নির খুব ছোট অংশ খরচ করে বিটকয়েন, ইথেরিয়াম বা সোলানা কিনছেন তাঁরা। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডিজিটাল সম্পত্তির ক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক কম-বেশি হতে পারে। তবে এগুলির সূচক সব সময়েই ঊর্ধ্বমুখী থাকবে।
ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ এবং ২০ বছরে সোনার চেয়ে অনেক বেশি রিটার্ন দিয়েছে নিফটি-৫০। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দেশের শেয়ার বাজার ক্রিপ্টো মুদ্রার ধারেকাছে পৌঁছোতে পারেনি। কারণ ডিজিটাল সম্পত্তির মালিকেরা ৭০ থেকে ১১০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করতে পেরেছেন।
ক্রিপ্টো লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম ‘সিআইএফডিএকিউ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিমাংশু মারাদিয়া মনে করেন, বিটকয়েনের আকর্ষণীয় রিটার্ন উপেক্ষা করা কঠিন। যদিও এর দাম ব্যাপক ভাবে বদলাতে পারে। বিটকয়েনের বার্ষিক উত্থান-পতন সোনার চেয়ে চার গুণ বেশি। ভারতে আবার ক্রিপ্টো মুদ্রায় লাভের উপর দিতে হয় ৩০ শতাংশ কর। এ ছাড়া টিডিএস বাবদ কেটে নেওয়া হয় এক শতাংশ টাকা। এই করকাঠামো এইচএনআইদের লাভের উপর প্রভাব ফেলবে।
সম্পদ সঞ্চয়ের উপর ‘রিচ ড্যাড পুয়োর ড্যাড’ নামের বই লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া মার্কিন শিল্পপতি তথা আর্থিক বিশ্লেষক রবার্ট কিয়োসাকিও বিটকয়েনে লগ্নির উপর জোর দিয়েছেন। সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা একটি পোস্টে বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক নীতির কড়া সমালোচনা করেন তিনি। সেখানে ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের জন্য সোনা, রুপো এবং বিটকয়েনকে বেছে নেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, ভারতের ধনকুবেরদের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টো মুদ্রা কখনওই সোনার বিকল্প হয়ে উঠবে না। বরং হলুদ ধাতুর পাশাপাশি এতে লগ্নি করবেন তাঁরা। কারণ, এ দেশে সোনার সাংস্কৃতিক মূল্য অপরিসীম। সেই জায়গা নেওয়া বিটকয়েন, ইথেরিয়াম বা সোলানার পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি বা এইচএনআইরা আগামী দিনে তাঁদের পোর্টফোলিয়োতে ক্রিপ্টো মুদ্রায় বিনিয়োগের অঙ্ক বৃদ্ধি করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এর জন্য পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত তাঁদের লগ্নি করতে দেখা যেতে পারে। বিটকয়েনের মতো ডিজিটাল মুদ্রায় মুনাফার সূচক আরও বাড়লে সেটা ১২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পটেল মনে করেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের সম্পদ পরিকল্পনার মধ্যে একটা বড় জায়গা নেবে বিটকয়েন। এতে লগ্নির নিয়মে কিছু বদল আসতে পারে। সম্পদশালী প্রগতিশীল পরিবারগুলি একে ডিজিটাল সোনা হিসাবে গণ্য করবে। যদিও হলুদ ধাতুতে বিনিয়োগের প্রবণতা কমে যাবে এমনটা নয়।
ইন্ডিয়া বুলিয়ান অ্যান্ড জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (আইবিজেএ) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ন’বছরে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে সোনার দাম। ২০১৫ সালে এর দর ছিল ২৪ হাজার ৭৪০ টাকা। হলুদ ধাতুতে লগ্নিকে অবশ্য অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়।
বর্তমানে একটি বিটকয়েনের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১.০১ কোটি টাকা। অন্য দিকে, প্রায় ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে একটি সোলানা। একটি ইথেরিয়াম কিনতে খরচ হবে ৩.১৮ লক্ষ টাকা। আর হলমার্কযুক্ত ২২ ক্যারেটের ১০ গ্রামের সোনার দাম ঘোরাফেরা করছে ৯৪ থেকে ৯৫ হাজার টাকার মধ্যে।