কার হাত ধরে চলছে দেশ? ক্ষমতার শীর্ষে থাকা প্রধানমন্ত্রী? তা কিন্তু একেবারেই নয়। ভারত চালানোর আসল চাবিকাঠি রয়েছে গুটি কয়েক আমলার হাতে। স্বাধীনতার পর দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তি থেকে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধ বা হালফিলের ‘গুড্স অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ বা জিএসটি চালু করা। দেশের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিটা ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকে সরকারের পদস্থ আধিকারিক তথা আমলাদের। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের হাত ধরেই শক্ত ভিতের উপর মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তথা নির্বাচন।
ভারত গঠনে আমলাদের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের উদাহরণ দিতে গেলে প্রথমেই আসবে ভাপাল্লা পাঙ্গুন্নি মেননের কথা। তাঁর বাবা ছিলেন কেরলের স্কুলশিক্ষক। ব্রিটিশ ভারতে ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেল তাঁকে ক্যাবিনেট সচিব হিসাবে নিয়োগ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাড়ে ৫০০-র বেশি দেশীয় রাজ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে তৈরি হয় বিশেষ একটি দফতর, যার সচিবের দায়িত্ব পান ভিপি মেনন।
গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকের শেষ দিকে সাড়ে ৫০০-র বেশি দেশীয় রাজ্যকে সদ্য স্বাধীন দেশের অন্তর্ভুক্ত করার কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। নতুন দফতরের মাথায় ছিলেন উপ-প্রধানমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল। মেননের উপর পূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর। দক্ষিণী আমলাও প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাতে কোনও ভুল করেননি। ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হন তিনি।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতীয় সেনার হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তান। লড়াই শেষে পূর্ব দিকে সম্পূর্ণ জমি হারায় ইসলামাবাদ। সেখানে নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ৯১ হাজার পাক সৈনিককে যুদ্ধবন্দি করতেও সক্ষম হয়েছিল এ দেশের ফৌজ। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এ-হেন সাফল্যের নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল দুই আমলার। তাঁরা হলেন, পরমেশ্বর নারায়ণ হাকসার এবং রামেশ্বর নাথ কাও।
কাশ্মীরি পণ্ডিত হাকসার ১৯৭১-’৭৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর প্রধান সচিব। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রীকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন তিনি। ওই সময়ে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের’ কারণে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মুখোমুখি ছিল আমেরিকা। ভারত কিছুটা মস্কোর দিকে ঝুঁকে থাকায় পাকিস্তানকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এতে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়ছিল। কিন্তু হাকসারের পরামর্শমতো কাজ করে যাবতীয় খেলা ঘুরিয়ে দেন নেহরু-কন্যা।
অন্য দিকে, উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্ম হওয়া রামেশ্বর নাথ কাও সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়ে কানপুরের অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনিও ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের সন্তান। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বহির্শত্রুদের মোকাবিলার জন্য বিশেষ একটি গুপ্তচরবাহিনী তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ইন্দিরা গান্ধী। আর সেই দায়িত্ব পান ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার কাও। ১৯৬৮ সালে তাঁর হাত ধরে জন্ম হয় ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানিলিসিস উইং’ বা র-এর। কাও ছিলেন তার প্রথম সেক্রেটারি।
র তৈরির মাত্র তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ যুদ্ধে পাক ফৌজের মুখোমুখি হয় ভারত। কিন্তু, তত দিনে ইসলামাবাদের যাবতীয় হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করে ফেলেছিলেন গুপ্তচরবাহিনীর প্রধান কাও। সেইমতো ভারতীয় সেনাকে আক্রমণের দিনক্ষণ পর্যন্ত জানিয়ে দেন তিনি। পাশাপাশি, পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা বাঙালিদের নিয়ে বিশেষ একটি বিদ্রোহী সেনাদলও তৈরি হয়েছিল তাঁরই নির্দেশে। কাও এর নামকরণ করেন ‘মুক্তিবাহিনী’। ’৭১-এর যুদ্ধে ভারতীয় সেনার সঙ্গে সমান তালে লড়েছিলেন এই দলের সদস্যরাও।
ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় সিকিম ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু অচিরেই সেখানে পা জমাতে শুরু করে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী সিআইএ (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি)। উদ্দেশ্য, সোভিয়েতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলা নয়াদিল্লির উপর নজরদারি। ’৬২-র চিন যুদ্ধের পর আরও খারাপ হতে থাকে পরিস্থিতি। হিমালয়ের কোলের ওই এলাকা দিয়ে যখন-তখন লালফৌজ ঢুকে পড়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। ফলে প্রমাদ গোনেন ইন্দিরা গান্ধী। আর তখনই সিকিমকে দেশের অন্তর্ভুক্ত করতে ডাক পড়ে ১৯৬৮-র কেরল ক্যাডারের এক ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস বা আইপিএস অফিসারের, নাম অজিত ডোভাল।
ওই সময়ে সিকিমের গদিতে ছিলেন চোগিয়াল বংশের রাজা পালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোয় জন্ম নেওয়া হোপ কুককে বিয়ে করেন তিনি। গুপ্তচর মারফত ইন্দিরা খবর পান এই বিয়েতে হাত রয়েছে সিআইএ-র। এর পর কালবিলম্ব না করে ডোভালকে যাবতীয় দায়িত্ব দেন তিনি। ফলস্বরূপ সেখানকার আমজনতার সঙ্গে মিশে ভারতের হয়ে প্রচার চালান ওই তরুণ আইপিএস। এর জেরে ১৯৭৫ সালে গণভোটের মাধ্যমে এ দেশের সঙ্গে জুড়ে যায় সিকিম। গোটা প্রক্রিয়া শেষ করতে ডোভাল সময় নিয়েছিলেন মাত্র দু’বছর।
সিকিমের ভারতভুক্তিকে কৌশলগত দিক থেকে বিরাট সাফল্য বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। এর জেরে চিরতরে ভারতীয় ফৌজের হাতে চলে আসে নাথু লা। তিব্বতের দিক দিয়ে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র পক্ষে এ দেশের ভিতরে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি। ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অবসরে চলে যাওয়া ডোভালকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ-র (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) দায়িত্ব দেন।
১৯৯৮ সালে রাজস্থানের পোখরানে ভূগর্ভস্থ তিনটি পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষা চালায় ভারত। ঠিক তার পরেই নয়াদিল্লির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক চাপ কাটাতে আসরে নামেন বিদেশ মন্ত্রকের দুঁদে আমলা এস জয়শঙ্কর। তাঁর কূটনৈতিক চালে কিছু দিনের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় ওয়াশিংটন। শুধু তা-ই নয়, ২০০৮ সালে ভারতের সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তিতে সই করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।
২০১৯ সালের ৫ অগস্ট সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ (এ) ধারা বাতিল করে মোদী সরকার। এর ফলে শেষ হয়ে যায় বিশেষ অধিকার। ওই সময়ে পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলি এর প্রবল বিরোধিতা করবে বলে মনে করা হয়েছিল। তত দিনে অবশ্য রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিদেশমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন জয়শঙ্কর। ফের দাবার চালে সব কিছু উল্টে দেন তিনি। উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে ভূস্বর্গে আসা শুরু হয় বিপুল লগ্নির। পাশাপাশি, সম্পর্ক মজুবত করতে সেখানকার অধিকাংশ রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে।
ভারতীয় অর্থনীতির যুগান্তকারী পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হল জিএসটির প্রবর্তন। ২০১৭ সালের আগে সারা দেশে চালু ছিল ২০টির বেশি কর। সেগুলিকে একসঙ্গে এনে জিএসটিতে বদলে ফেলার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন যে আমলা, তার নাম হাসমুখ আধিয়া। ১৯৮১ সালের গুজরাত ক্যাডারের এই আধিকারিককে অর্থসচিব নিয়োগ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। জিএসটির জেরে বর্তমানে সরকারি কোষাগারে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ আট লক্ষ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছে।
অর্থসচিব হাসমুখের আরও কিছু সাফল্য রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা, জীবন জ্যোতি বিমা যোজনা এবং অটল পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পের মূল কারিগর ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের কেরল ক্যাডারের অফিসার বিনোদ রাই আবার ছিলেন ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’ বা ক্যাগ। টুজি স্পেক্ট্রাম কেলেঙ্কারির সময়ে তাঁর জন্য এক মন্ত্রীর জেলযাত্রা নিশ্চিত হয়েছিল।
আধুনিক ভারত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরও একজন আমলার কথা বলতেই হবে। তিনি হলেন বাঙালি অফিসার সুকুমার সেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫১-’৫২ সালের প্রথম নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করাতে সক্ষম হন তিনি। এতে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা পায় গণতন্ত্র। পরবর্তী কালে এ দেশের ভোটব্যবস্থায় বড় বদল আনেন ১৯৫৪ সালের তামিলনাড়ু ক্যাডারের অফিসার তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার সেশন।
ঘরোয়া অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চাল। কখনও আবার জাতীয় নিরাপত্তা বা কোভিড টিকার সমবণ্টন। সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারকে পদ দেখিয়ে থাকেন আইএএস (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস) এবং আইপিএস (ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস) অফিসারেরা। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কেবলমাত্র প্রশাসনের মুখ হিসাবে কাজ করছেন বলা যেতে পারে।
সরকার পরিচালনায় এই অফিসারদের ভূমিকা কতখানি তা দু’-একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ২০১৪ সালে নৃপেন্দ্র মিশ্রকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে নিয়ে আসতে বিশেষ অর্ডিন্যান্স পাস করেন মোদী। ২০১৭ সালে বিদেশ মন্ত্রকের সচিব হিসাবে জয়শঙ্করের অবসরের বয়স এক বছরে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সদ্য ৮০-তে পা দেওয়া ডোভালকে এনএসএ-র দায়িত্বভার থেকে মুক্তি দেয়নি কেন্দ্র। ক্যাবিনেট সেক্রেটারির মর্যাদা পাচ্ছেন তিনি।
দেশের যুব সমাজের মধ্যে থেকে সেরাদের আমলা হিসাবে বেছে নেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে ‘ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন’ বা ইউপিএসসির কাঁধে। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) মতো উঁচু সরকারি পদে যোগ্যদের নিয়োগ করে থাকে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। চলতি বছরের জুনে ইউপিএসসির সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় আবেদনের সংখ্যা ছিল ১৩ লক্ষ। এর মধ্যে নিয়োগপত্র পাবেন মাত্র ১০৫৬ জন।
এই কারণেই ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাকে দেশের অন্যতম কঠিন পরীক্ষা বলা হয়। নিয়োগ হওয়া ১০৫৬ জনের মধ্যে মাত্র ৩০০ জন সরকারের সর্বোচ্চ পদে যেতে পারবেন। রাজ্যের মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসারেরা আইএএস পদমর্যাদার হয়ে থাকেন। অন্য দিকে, দেশের সমস্ত আধা সেনা এবং রাজ্য পুলিশের ডিজিরা আইপিএস পদাধিকারী। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ (আইবি) এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) মতো সংস্থার নেতৃত্বে রয়েছেন ইউপিএসসি উত্তীর্ণ অফিসারেরা।
এ-হেন দুঁদে আমলা ও পুলিশের বড়কর্তাদের জন্য মোটা টাকা খরচ করে থাকে সরকার। মাসে আড়াই লক্ষ টাকার কাছাকাছি বেতন পান তাঁরা। সর্ব ক্ষণের জন্য রয়েছে গাড়ি, সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী, বিলাসবহুল বাংলো, ফোন, বিদ্যুৎ, রাঁধুনি এবং মালি। তবে এঁদের কাজ অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর মতো ১০টা-৫টায় সীমাবদ্ধ নয়। যে কোনও কঠিন পরিস্থিতিতে তলব পড়তে পারে তাঁদের। সর্দার পটেল এই কারণে আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের দেশের শাসনব্যবস্থার ‘ইস্পাতের কাঠামো’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।