Copper Crisis in India

আরব মুলুক থেকে বিপুল তামা আমদানি! দেশের বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পেতেই চিনা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে ভারতীয় সংস্থা

দক্ষিণ আমেরিকার তামার খনিগুলির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম এশিয়ার সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে তামা আমদানি বাড়িয়ে চলেছে ভারত। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খলে চাপ আসতে পারে বলে সতর্ক করলেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৫১
Share:
০১ ২০

বিরল খনিজ থেকে ‘তরল সোনা’। দেশের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক সামগ্রীর ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভাবে বিদেশের উপর নির্ভরশীল ভারত। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে তামা। সম্প্রতি এর লাগাতার আমদানি নিয়ে কেন্দ্রকে সতর্ক করল বণিক সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান প্রাইমারি কপার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন’ বা আইপিসিপিএ। আন্তর্জাতিক বাজারে তামার উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। নিঃসন্দেহে এটি নয়াদিল্লির মাথাব্যথার কারণ হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

০২ ২০

কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে তামার চাহিদা কম-বেশি ১৬ লক্ষ টন। এর সিংহভাগই ব্যবহার হয় মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পরিবহণে। চলতি আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৬) এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২ লক্ষ টন তামা আমদানি করেছে ভারত। এ দেশে হাতেগোনা তামার খনি আছে, এমনটা নয়। কিন্তু, সেই তামার গুণগত মান খারাপ হওয়ার জন্য এ ব্যাপারে বিদেশি নির্ভরশীলতা বাড়ছে নয়াদিল্লির। ফলে কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের।

Advertisement
০৩ ২০

২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করে ভারত। এর পোশাকি নাম ‘ইন্ডিয়া-ইউএই কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সিইপিএ। বর্তমানে সেই সমঝোতার আওতায় বিপুল পরিমাণে তামার রড নয়াদিল্লি আমদানি করছে বলে জানিয়েছে আইপিসিএ। এর জেরে তামা পরিশোধনকারী দেশীয় সংস্থাগুলি যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।

০৪ ২০

১৯৯৬ সাল থেকে ঘরের মাটিতে তামা উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে থাকে ভারত। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড। এ ছাড়াও আছে হিন্ডালকো ইন্ডাস্ট্রিজ়, বেদান্ত লিমিটেড এবং শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা কচ্ছ কপার লিমিটেড। কিন্তু এর মধ্যে তামা পরিশোধনকারী বেদান্ত লিমিটেডের কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহ শৃঙ্খলে আসে অস্থিরতা।

০৫ ২০

২০২৫ আর্থিক বছরে তামার চাহিদা সাড়ে আট লক্ষ টন থাকবে বলে মনে করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে সেটা ১২ লক্ষ টন ছাপিয়ে যায়। ফলে তামা পরিশোধনকারী সংস্থাগুলি তাদের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রককে লেখা চিঠিতে বেশ কিছু বিষয়ের দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে আইপিসিপিএ। বণিক গোষ্ঠীটির দাবি, চাহিদা মেটাতে আমিরশাহি থেকে লগাতার তামার রড আমদানি করায় খনন এবং পরিশোধন থেকে মুখ ফেরাচ্ছে অধিকাংশ ঘরোয়া সংস্থা।

০৬ ২০

উপসাগরীয় আরব দেশটির থেকে তামা আমদানির দু’টি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, চুক্তি থাকার কারণে এতে শুল্কের মাত্রা কম। দ্বিতীয়ত, রডের আকারে পাওয়া যাচ্ছে আমিরশাহির তামা। ফলে পরিশোধনের প্রশ্ন নেই। আইপিসিপিএর অবশ্য দাবি, এতে আখেরে লোকসান হচ্ছে ভারতেরই। কারণ, এর জেরে তামা শোধনের বরাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ঘরোয়া সংস্থাগুলি। খনি বা শোধনাগার কিছু না থাকা সত্ত্বেও মুনাফার সুযোগ পাচ্ছে আমিরশাহি।

০৭ ২০

দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, বলিভিয়া বা পেরুর মতো দেশগুলিতে সর্বাধিক তামা পাওয়া যায়। কিন্তু, সেখানকার খনিগুলির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চিনের। আইপিসিপিএ জানিয়েছে, সেখান থেকেই তামা কিনে এনে ভারতকে বিক্রি করছে আমিরশাহি। পরিশোধনের প্রক্রিয়াও অন্য কোনও জায়গায় সম্পন্ন করছে ওই উপসাগরীয় দেশ।

০৮ ২০

আর তাই দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, কাঁচা তামা সেখান থেকে এ দেশের আনতে পারলে পরিশোধনের পুরো বরাতটাই পাবে ঘরোয়া সংস্থা। ফলে এক দিকে যেমন তাদের বাজার চাঙ্গা থাকবে, অপর দিকে আঁচ আসবে না সরবরাহ শৃঙ্খলেও।

০৯ ২০

২০২৩ এবং ২০২৪ আর্থিক বছরে তামার আমদানি অনেকটাই কমিয়েছিল ভারত। কিন্তু, তার পরেই এতে শুল্কের অঙ্ক হ্রাস করে কেন্দ্র। এ বছরের মে মাসে তামার রডের ক্ষেত্রে শুল্কের মাত্রা দুই থেকে কমিয়ে এক শতাংশে নামিয়ে আনে মোদী সরকার। ফলে আমিরশাহি থেকে এর আমদানির অঙ্ক রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়।

১০ ২০

২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে ভারতীয় সংস্থাগুলিকে ৪৩.৪৫ কিলো টন তামা সরবরাহ করে আবু ধাবি। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক বেড়ে ৮৬.০৬ কিলো টনে গিয়ে পৌঁছোয়। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) প্রথম চার মাসেই প্রায় ৪৩ কিলো টন তামা আমিরশাহি থেকে আমদানি করেছে নয়াদিল্লি।

১১ ২০

সূত্রের খবর, ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে তামায় শুল্কের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম এশিয়া থেকে সংশ্লিষ্ট ধাতুটির এ দেশের মাটিতে আগমনের মাত্রা যে বৃদ্ধি পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই প্রবণতা সরবরাহ শৃঙ্খলে ধাক্কা দিতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১২ ২০

ভারতের তামা শিল্পে এত দিন বিপুল লগ্নি করে এসেছে জাপান-সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ। আইপিসিপিএ জানিয়েছে, আমিরশাহির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির জেরে সেই বিনিয়োগ কমতে শুরু করেছে। ফলে তামা কেনার ব্যাপারে বৈচিত্র রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে নয়াদিল্লি। এই একমুখী কারবার বিপদ ডাকতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা।

১৩ ২০

গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) মার্চ মাসে গুজরাতের মুন্দ্রায় একটি তামা শোধনাগারের প্রথম ইউনিট চালু করে আদানি এন্টারপ্রাইজ়ের একটি শাখা সংস্থা। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির নাম ‘কচ্ছ কপার’ রেখেছেন শিল্পপতি গৌতম। মোট দু’টি পর্যায়ে শোধনাগারটিকে গড়ে তুলছেন তিনি। আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে, ২০২৯ সালের মধ্যে ‘কচ্ছ কপার’ থেকে পরিশোধিত তামা উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০ লক্ষ টন।

১৪ ২০

প্রথম পর্যায়ের তাম্র শোধনাগারের ইউনিটটি চালু করতে ১২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন শিল্পপতি গৌতম আদানি। বর্তমানে ‘কচ্ছ কপার’-এর মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টন পরিশোধিত তামা তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন তিনি। একে বিশ্বের বৃহত্তম তাম্র উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

১৫ ২০

আদানি গোষ্ঠী জানিয়েছে, তাদের উচ্চাভিলাষী ‘সবুজ শক্তি’র (গ্রিন এনার্জি) ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিপুল পরিমাণে পরিশোধিত তামার প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে মুন্দ্রায় ‘কচ্ছ কপার’ গড়ে তুলছে তারা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি এবং পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সংস্থার শক্তিশালী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তামা ব্যবসায় সারা দুনিয়ায় নিজের জায়গা পাকা করার স্বপ্ন দেখছে তারা।

১৬ ২০

সূত্রের খবর, তামা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে অস্ট্রেলিয়ার খনি সংস্থা বিএইচপির সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরে ফেলেছে ‘কচ্ছ কপার’। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির থেকে মুন্দ্রার কারখানার জন্য বছরে ১০ লক্ষ ৬০ হাজার টন তামা আমদানি করতে পারে আদানি গোষ্ঠী। বর্তমান বাজারমূল্যে এই চুক্তি বার্ষিক ৩০ হাজার কোটি টাকার হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও এই নিয়ে আদানি গোষ্ঠী বা অস্ট্রেলীয় সংস্থাটির তরফে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

১৭ ২০

বিশেষজ্ঞদের আবার দাবি, তামা শিল্পে আদানিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দিতে পারে আদিত্য বিড়লা গ্রুপের সংস্থা ‘হিন্দালকো’। এ ছাড়াও রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হিন্দুস্তান কপার’। এ দেশের খনি থেকে তাম্র উত্তোলনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই দুই সংস্থা। মুন্দ্রার ধাঁচে আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীও তামা শোধনাগার চালু করলে শিল্পপতি গৌতম যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন, তা বলাই বাহুল্য।

১৮ ২০

আদানি হোক বা বিড়লা, দেশের দুই নামী শিল্প সংস্থার তামা শিল্পের পিছনে দৌড়োনোর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তামার চাহিদা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ, ব্যাটারিচালিত গাড়ি, মহাকাশ গবেষণা বা উন্নত হাতিয়ার নির্মাণে এই ধাতুটির প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে।

১৯ ২০

‘ইন্টারন্যাশনাল কপার অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ বা আইসিএআইয়ের করা সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ আর্থিক বছরে এ দেশের বাজারে তামার চাহিদা ছিল ৯৭৮ কিলো টন। ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে সেই অঙ্ক বেড়ে ১,৭১৮ কিলো টনে পৌঁছে গিয়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর (পড়ুন ২০২৪) ভারতে তামার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৩ শতাংশ।

২০ ২০

এই পরিস্থিতিতে ভারত শুধুই আমিরশাহি থেকে তামা আমদানি করায় দামের নিরিখে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে। বর্তমানে এর জন্য ১০ হাজার কোটির বেশি টাকার খরচ হচ্ছে কেন্দ্রের। পর্দার আড়ালে থেকে চিন কৃত্রিম ভাবে এর অভাব তৈরি করলে জটিল হবে পরিস্থিতি। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে তামা আমদানিতে সরকারি খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ হাজার কোটি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement