Indian Explosive in Russia

তেলের উপর মার্কিন হুমকিতে ‘শঠে শাঠ্যং’! ভারত থেকে আমদানি করা বিস্ফোরকে ইউক্রেন ধ্বংসের ছক কষছেন ‘বন্ধু’ পুতিন?

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে রাশিয়ায় বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক পাঠিয়েছে ভারত। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে হইচই। ১৪ লক্ষ ডলার মূল্যের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওই বিস্ফোরক হাতে পেয়েছে মস্কোর দু’টি সংস্থা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ০৭:৪৮
Share:
০১ ২০

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার লাল চোখকে বুড়ো আঙুল! ইউক্রেন যুদ্ধে ‘বন্ধু’র হাত শক্ত করতে ফের রাশিয়ার পাশে ভারত। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই লক্ষ্যে মস্কোর গোলা-বারুদের কারখানায় টন টন বিস্ফোরক পাঠাল কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এর জেরে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।

০২ ২০

ভারতীয় শুল্ক দফতরকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে ১৪ লক্ষ ডলার মূল্যের এইচএমএক্স বা অক্টোজ়েন নামের বিস্ফোরক রাশিয়ায় পাঠায় এ দেশের একটি সংস্থা। ওই বিস্ফোরক সরাসরি পৌঁছোয় মস্কোর প্রোমসিনটেজ় নামের একটি কোম্পানির হাতে। কিভের গুপ্তচর সংস্থা ‘সিকিউরিটি সার্ভিস অফ ইউক্রেন’ বা এসবিইউ-এর দাবি, সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির সঙ্গে ক্রেমলিন ফৌজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। আর তাই চলতি বছরের এপ্রিলে ড্রোন হামলায় প্রোমসিনটেজ়ের একটি কারখানা ওড়ানোর চেষ্টা করে তারা।

Advertisement
০৩ ২০

মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের ‘ডিফেন্স টেকনিক্যাল ইনফরমেশন সেন্টার’-এর নথি অনুযায়ী, অত্যন্ত বিপজ্জনক যৌগ বা বিস্ফোরক এইচএমএক্সের যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড, টর্পেডো, রকেট প্রপালশান ইউনিট এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম তৈরির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল অক্টোজ়েন। মস্কোর কাছে যাতে এই ধরনের কোনও উপকরণ না পৌঁছোয়, তার জন্য গত সাড়ে তিন বছরে বহু বার কড়া আর্থিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিতে শোনা গিয়েছে ওয়াশিংটনকে।

০৪ ২০

রয়টার্স জানিয়েছে, ভারত থেকে রাশিয়ায় বিস্ফোরক সরবরাহের বিষয়টি এত দিন গোপন ছিল। এর জেরে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন। বহুজাতিক সংবাদসংস্থাটির করা তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, পূর্ব ইউরোপের দেশটির সেন্ট পিটার্সবার্গে এইচএমএক্স সরবরাহ করে নয়াদিল্লির কোম্পানি ‘আইডিয়াল ডেটোনেটর্স প্রাইভেট লিমিটেড’। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভারতীয় শুল্ক দফতরের এক কর্তা।

০৫ ২০

শুল্ক দফতরের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, প্রোমসিনটেজ় ছাড়া আরও একটি রুশ সংস্থা ভারতের থেকে ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ বিস্ফোরক কিনেছে। তাদের নাম ‘হাই টেকনোলজি ইনিশিয়েশন সিস্টেমস’। এর মধ্যে প্রোমসিনটেজ়কে ১০ লক্ষ ডলার এবং হাই টেকনোলজিকে ৪ লক্ষ ৫ হাজার ২০০ ডলার মূল্যের এইচএমএক্স পাঠিয়েছে নয়াদিল্লির আইডিয়াল ডেটোনেটর্স। মস্কোর এই দুই সংস্থারই দেশের দক্ষিণ প্রান্তে কাজ়াখস্তান সীমান্তের কাছে সামারা ওব্লাস্টে দফতর এবং কারখানা রয়েছে।

০৬ ২০

কেন্দ্রের অবশ্য দাবি, সরকারি নীতি ভেঙে রাশিয়াকে কোনও বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়নি। এই ইস্যুতে রয়টার্সের কাছে মুখ খোলেন নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক শুল্ক দফতরের এক কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘এই যৌগের সামরিক ব্যবহার রয়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু অসামরিক ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার নেহাত কম নয়। সেই কারণেই এটি রফতানি করা হয়েছে।’’ নয়াদিল্লি যে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছে না, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি।

০৭ ২০

এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে বিদেশ মন্ত্রকও। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ভারত পরমাণু হাতিয়ারের সংখ্যাবৃদ্ধি বন্ধ করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা বিবেচনা করে আসছে। আর তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দ্বৈত ব্যবহারের বিভিন্ন সামগ্রী রফতানি করে থাকে। তবে সেটা কখনওই নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর বাইরে গিয়ে নয়। এই ধরনের রফতানির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মানদণ্ডের সামগ্রিক মূল্যায়নও করে থাকে সরকার।’’

০৮ ২০

বিদেশ মন্ত্রকের এ-হেন বিবৃতির পর আমেরিকা যে খুব খুশি হয়েছে এমনটা নয়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘ভারত আমাদের কৌশলগত অংশীদার। নয়াদিল্লির সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে আমাদের কোনও সমস্যা হয় না। তবে মস্কোর প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থাগুলির সঙ্গে ভারতীয় সংস্থাগুলি ব্যবসা শুরু করলে চুপ করে বসে থাকা অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি থাকবে।’’

০৯ ২০

বিশ্লেষকদের দাবি, এইচএমএক্স বা ওই ধরনের ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ বিস্ফোরক রাশিয়াকে রফতানি করার জন্য ভারতের যে কোনও সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর অধিকার মার্কিন ট্রেজ়ারি বিভাগের রয়েছে। ফলে সেই ক্ষমতা যখন-তখন প্রয়োগ করতে পারে ওয়াশিংটন। যদিও তাতে নয়াদিল্লি সিদ্ধান্ত বদল করবে বলে মনে করছে না ওয়াকিবহাল মহল।

১০ ২০

এ ব্যাপারে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির প্রধান উপদেষ্টা ভ্লাদিস্লাভ ভ্লাসিউক। তিনি বলেন, ‘‘ঐতিহ্যগত ভাবে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে বেআইনি রাস্তা কখনওই অবলম্বন করে না ভারত। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষে বা সুনির্দিষ্ট সংস্থার ক্ষেত্রে এটা বলা অসম্ভব। এর আগেও রুশ সংস্থা প্রোমসিনটেজ় আমাদের রেডারে এসেছে। আমরা দেখেছি যে নয়াদিল্লির একাধিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে তাদের।’’

১১ ২০

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এই ঘটনার জেরে কড়া নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে আইডিয়াল ডেটোনেটর্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের পাশাপাশি এ ব্যাপারে ভারতকে কঠিন সাজা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এগিয়ে আসার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। অতীতে জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বেশ কিছু ভারতীয় সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ওয়াশিংটন। যদিও কূটনৈতিক চালে সেই চ্যালেঞ্জ অনায়াসে টপকে যেতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি।

১২ ২০

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারতীয় সংস্থাগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আমেরিকা। তবে তার পরেও আইডিয়াল ডেটোনেটর্সের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পকে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে একের পর এক মন্তব্য করতে দেখা গিয়েছে। গত জুলাইয়ে রুশ তেল কেনার জন্য বিপুল পরিমাণে শুল্ক চাপানোর হুমকি দেন তিনি।

১৩ ২০

লন্ডনের ল’ফার্ম আকিনের সদস্য এরিক প্রিন্স অবশ্য বলেছেন, মুখে অনেক কথা বললেও এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ করা বেশ কঠিন। কারণ, ট্রাম্পের দ্বিমুখী নীতির জেরে চিন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে নয়াদিল্লি। এতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বিপদে পড়তে পারে ওয়াশিংটন। ফলে সে দিকেও কড়া নজর রয়েছে তাদের।

১৪ ২০

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেন আক্রমণ করে মস্কোর ফৌজ। তার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে চলছে যুদ্ধ। এই লড়াইয়ের শুরুর দিন থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সমর্থন পেয়ে আসছে কিভ। এক কথায় জ়েলেনস্কির ফৌজকে লাগাতার হাতিয়ার সরবরাহ করে আসছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশ।

১৫ ২০

অন্য দিকে, ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের তৈরি ‘আত্মঘাতী’ ড্রোন বহুল পরিমাণে ব্যবহার করেছে মস্কো। লড়াইয়ের মধ্যেই ‘ডেমোক্রেটিক পিপল্‌স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকের (পড়ুন উত্তর কোরিয়া) সুপ্রিম লিডার কিম জং-উনের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেন পুতিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কিভের রণাঙ্গনে বাহিনী পাঠায় পিয়ংইয়ং। এ ছাড়া চিনের তৈরি সামরিক সরঞ্জামের উপরেও মস্কোকে ভরসা রাখতে দেখা গিয়েছে।

১৬ ২০

২০২৩ সালের মার্চে জানা যায়, আর্থিক সঙ্কট দূর করতে ইউক্রেনে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলা-বারুদ পাঠাবে পাকিস্তান। সেই তালিকায় ছিল ৪৪টি ৮০ইউডি মেন ব্যাটল ট্যাঙ্ক (এমবিটি)। তবে সেগুলি শেষ পর্যন্ত কিভের মাটিতে পৌঁছেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে ইসলামাবাদে তৈরি কামানোর গোলা যে এই যুদ্ধে জ়েলেনস্কির বাহিনী ব্যবহার করেছে, তার প্রমাণ মিলেছে।

১৭ ২০

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম দিনে অবশ্য কিছু দিন ইউক্রেনকে হাতিয়ার সরবরাহ বন্ধ রাখেন ট্রাম্প। সংঘর্ষবিরতিতে পুতিনকে রাজি করাতে মরিয়া চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে ফের কিভকে অত্যাধুনিক হাতিয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।

১৮ ২০

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক রাশিয়ার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে আমেরিকা। যদিও তা উড়িয়ে মস্কোর থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনে চলেছে নয়াদিল্লি। মোদী সরকারের যুক্তি, ভারতের এই সিদ্ধান্তের জেরে বিশ্ব বাজারে অগ্নিমূল্য হয়নি ‘তরল সোনা’। এ ব্যাপারে দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকার চাপ অগ্রাহ্য করছে ভারত।

১৯ ২০

এই পরিস্থিতিতে গত ১৪ জুলাই ফের হুঁশিয়ারি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। নেটোর মহাসচিব মার্ক রাটের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি বলেন, ‘‘৫০ দিনের মধ্যে মস্কোকে শান্তি সমঝোতায় আসতে হবে। নইলে রাশিয়ার বাণিজ্যিক বন্ধুদের উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেব আমরা।’’

২০ ২০

ট্রাম্পের ওই হুমকির দু’-তিন দিনের মাথায় ভারতের একটি তেল সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। যদিও তাতে রুশ তেল কেনার সিদ্ধান্ত বাতিল করা হবে না বলে স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি। মস্কোকে বিস্ফোরক সরবরাহকারী আইডিয়াল ডেটোনেটর্সের বিরুদ্ধে একই রকমের কোনও পদক্ষেপ আমেরিকা বা পশ্চিম ইউরোপ করে কি না, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement