বিত্তবানদের দেশত্যাগের হিড়িক! মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশকেই আপন করে নিচ্ছেন ধনকুবেররা! যত সময় গড়াচ্ছে, দুনিয়া জুড়ে বাড়ছে সেই প্রবণতা। এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই ভারতের সম্পদশালী উদ্যোগপতি থেকে লগ্নিকারীরাও। ফলে দ্বিমুখী সমস্যার মুখে পড়ছে দেশ। প্রথমত, বিপুল হারে হচ্ছে সম্পদের বহির্গমন। দ্বিতীয়ত, আর্থিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পড়ছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। কিন্তু কেন হঠাৎ জন্মস্থল ছাড়তে চাইছেন ধনকুবেররা?
সম্প্রতি, বিত্তবানদের স্বদেশত্যাগের উপর ‘হেনলি প্রাইভেট ওয়েলথ মাইগ্রেশন রিপোর্ট ২০২৫’ শীর্ষক একটি সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশিত হতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। সেখানে ভারতীয় ধনকুবেরদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছে ব্রিটিশ সমীক্ষক সংস্থা ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’। তাদের দাবি, চলতি বছরে এ দেশের অন্তত সাড়ে তিন হাজার সম্পদশালীর পাকাপাকি ভাবে বিদেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে গত দু’বছরের নিরিখে এই সূচক কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে।
ব্রিটিশ সংস্থা ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’-এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে ১০ লক্ষ ডলার লগ্নির ক্ষমতাসম্পন্ন বিত্তবানদের উপরে এই সমীক্ষা করা হয়েছে। তাদের প্রকাশ করা তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে চিন। অর্থাৎ, দেশত্যাগের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী বেজিঙের ধনকুবেররা। তালিকায় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে যথাক্রমে ব্রিটেন এবং ভারত। এর পর নাম রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ব্রাজ়িল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, নাইজ়েরিয়া এবং ভিয়েতনামের।
‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’ জানিয়েছে, এ বছর সারা বিশ্বের মোট ১ লক্ষ ৪২ হাজার সম্পদশালী দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের এই চিন্তাভাবনার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। সমীক্ষকদের দাবি, মূলত উচ্চ করকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপশাসন, অনুন্নত আইনশৃঙ্খলা এবং আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের ক্ষেত্রে সুযোগের অভাবের কারণে স্বদেশ ছাড়তে চাইছেন ধনকুবের লগ্নিকারী ও উদ্যোগপতিরা। চিন, ব্রিটেন এবং ভারতের ক্ষেত্রে যুদ্ধের আশঙ্কা ও রাজনৈতিক মতাদর্শও অনুঘটকের কাজ করছে।
উদাহরণ হিসাবে ব্রিটেনের কথা বলা যেতে পারে। বর্তমানে আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্রের রয়েছে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন লেবার পার্টির সরকার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির উপরে কর বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এতে একেবারেই খুশি নয় পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া বিপুল সম্পত্তির মালিক বিত্তবান ইংরেজ পরিবারগুলির একাংশ। সেই কারণে বিকল্প দেশ খুঁজে নিতে চাইছেন তাঁরা। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য পরিকাঠামোযুক্ত ভিন্রাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
ব্রিটিশ সমীক্ষকদের দাবি, গত বছর ভারত ছাড়েন প্রায় ৪,৩০০ জন ধনকুবের। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,১০০। এই বিত্তবানদের দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরোয়া বাজার থেকে সম্পদের বহির্গমনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২,৬২০ কোটি ডলার। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির তুলনায় ভারতে সম্পদশালীদের অনেকটাই বেশি কর দিতে হয়। তা ছাড়া এখানে যোগ্যতা অনুসারে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো এবং বিনিয়োগের সুযোগ অনেকটাই কম বলে মনে করেন সম্পদশালীদের একাংশ। সেই কারণে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাঁরা।
ভারতীয় ধনকুবেরদের অধিকাংশের অভিযোগ, এ দেশে লগ্নির ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জনরোষ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, এমনকি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। এখানে সরকারি নীতিও দ্রুত পরিবর্তনশীল। রয়েছে বাম রাজনৈতিক দলগুলির মদতপুষ্ট শ্রমিক সংগঠনগুলির জঙ্গি আন্দোলন। ফলে ভারতের মতো দেশে বিনিয়োগ মোটেই সহজ নয়।
ব্রিটিশ সমীক্ষক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে দেশত্যাগী বিত্তবানদের বড় অংশই সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করতে ইচ্ছুক। চলতি বছরে প্রায় ৯,৮০০ জন ধনকুবেরকে পেতে পারে ওই আরব মুলুক। সূত্রের খবর, এঁদের বেশির ভাগ আবু ধাবি, দুবাই বা শারজায় থাকতে পছন্দ করছেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বছরে আমেরিকায় যেতে পারেন ৭,৫০০ জন সম্পদশালী। ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রে এই সূচকের ৭৮ শতাংশের বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে।
দেশত্যাগী বিত্তবানদের পছন্দের তালিকায় এর পর রয়েছে ইটালি, পর্তুগাল এবং গ্রিস। ইউরোপের এই তিন দেশে এ বছরে পাকাপাকি ভাবে পাড়ি জমাতে পারেন যথাক্রমে ৩৬০০, ১৪০০ এবং ১২০০ জন। এ ছাড়া সৌদি আরব এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডকেও বসবাসের উপযুক্ত বলে মনে করেন স্বদেশত্যাগী ধনকুবেররা। কম আয়কর, লগ্নির সুবিধা, ঢিলেঢালা অভিবাসী আইন, উন্নত জীবনধারা, উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং সামাজিক সুরক্ষায় সুবিধা থাকার কারণে তাঁরা এই দেশগুলি বেছে নিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে।
বিদেশি ধনকুবেরদের জন্য দরজা হাট করে খুলে দেওয়ার নেপথ্যে আবার আমিরশাহি সরকারের অন্য অঙ্ক রয়েছে। প্রথমত, মরু এলাকা হওয়ায় আরব দেশটির জনসংখ্যা খুবই কম। ফলে দ্রুত গতিতে উন্নয়নমূলক কাজ করা আবু ধাবির পক্ষে কঠিন। আর তাই ক্রমাগত ইউরোপের লগ্নি পেতে চাইছেন সেখানকার সুলতান। বিদেশি সম্পদশালীরা এলে তাঁদের হাত ধরে সেই বিনিয়োগ যে সহজেই আসবে, তা ভালই জানেন তিনি। সেই কারণে দেশত্যাগী বিত্তবানদের সুবিধার্থে কড়া আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা চালু রেখেছে আবু ধাবি।
সমীক্ষকদের দাবি, ব্রিটেন ত্যাগ করতে পারেন ১৬ হাজার ৫০০ জন ধনকুবের। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যায় আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্র। এই বিচ্ছেদের পোশাকি নাম ‘ব্রেক্সিট’। বিশ্লেষকদের দাবি, ইইউ ছাড়ার ক্ষতিকর আর্থিক প্রভাব এ বার ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে সেখানে। বাড়ছে আর্থিক অনিশ্চয়তা। শেয়ার সূচকের সে ভাবে হচ্ছে না কোনও বৃদ্ধি। ফলে দিন দিন সম্পত্তি কমছে বিত্তবান লগ্নিকারী ও উদ্যোগপতিদের।
ধনকুবের ব্রিটিশদের স্বদেশত্যাগের দ্বিতীয় কারণ হল শরণার্থী সমস্যা। আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্রটির একাংশে একরকম অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে বেআইনি ভাবে পাকিস্তান থেকে যাওয়া নাগরিকেরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সিরিয়া, বাংলাদেশ এবং আফ্রিকার কিছু দেশের শরণার্থীরা। সেখানে শরিয়া আদালত খুলে ফেলার মতো অভিযোগ রয়েছে এই সমস্ত বিদেশিদের বিরুদ্ধে। ফলে বার্মিংহামের মতো শহরে শান্তিতে বাস করা সেখানকার ভূমিপুত্র ইংরেজদের পক্ষে কঠিন হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে রদারহ্যাম কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে চড়ে রাজনীতির পারদ। এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের পদত্যাগের চেয়ে সুর চড়াতে দেখা গিয়েছে বিরোধী রক্ষণশীলদের। পাশাপাশি, পাক ‘গ্রুমিং গ্যাং’কে নিশানা করেন তাঁরা। এদের ধর্ষক ছাড়া আর কিছুই বলতে রাজি ছিলেন না যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক।
ব্রিটিশ পুলিশ পাক ‘গ্রুমিং গ্যাং’গুলিকে সংগঠিত অপরাধীদের দল বলে চিহ্নিত করেছে। তদন্তকারীদের দাবি, এই গ্যাংয়ের সদস্যদের নিশানায় থাকে মূলত স্কুল বা শিশু আবাসিক কেন্দ্র। সেখানেই গাড়ি এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন তাঁরা। ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের মধ্যে এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা কথাবার্তায় বেশ পটু। নাবালক-নাবালিকাদের সঙ্গে দ্রুত বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে পারেন তাঁরা।
এর পর চকোলেট এবং বিভিন্ন উপহার দিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে এই ‘গ্রুমিং গ্যাং’। শেষে ওই কিশোর বা কিশোরীকে মদ-সিগারেট এবং অন্যান্য মাদকের নেশা ধরায় তারা। শেষ ধাপে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে চলে যৌন নির্যাতন। এর পাশাপাশি ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্মান্তরণের অভিযোগও। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই অপরাধচক্রের সকল সদস্যই পুরুষ। পাশাপাশি, এদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পাক নাগরিক। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী।
ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের রদারহ্যাম শহরে এই ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের হদিস পেয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, ১৯৯৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১,৪০০টি শিশু। এই সংখ্যা ৪০ হাজারে পৌঁছোতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের হাত থেকে নিস্তার পায়নি ১১ বছরের কিশোরীও। মানবপাচারের সঙ্গেও এই দুষ্কৃতীরা জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে খবর।
ব্রিটেনের মতোই চলতি বছরে চিন ছাড়তে পারেন ৭,৮০০ জন মান্দারিনভাষী ধনকুবের। অন্য দিকে, ২,৪০০ জন বিত্তবানের গন্তব্য সৌদি আরব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বদেশত্যাগী সম্পদশালীদের নিজেদের ঘরে জায়গা দিতে সোনালি ভিসা (গোল্ডেন ভিসা) চালু করেছে আমিরশাহি সরকার। এতে বিদেশি কোটিপতিদের জন্য রয়েছে একগুচ্ছ সুযোগ-সুবিধা। তাই আরব দুনিয়ার এই দুই দেশে যাওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে স্পষ্ট করেছেন সমীক্ষকেরা।
এ প্রসঙ্গে ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’-এর সিইও জুয়ার্গ স্টিফেন বলেছেন, ‘‘২০২৫ সালে স্বদেশত্যাগী বিত্তবানদের মধ্যে একটা নতুন প্রবণতা দেখা গিয়েছে। এত দিন পর্যন্ত এই ধনকুবেরদের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসাবে অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু এ বার চিত্রটা পুরোপুরি উল্টে গিয়েছে। সেখান থেকেই সম্পদশালীদের বড় অংশ পশ্চিম এশিয়া বা আমেরিকায় চলে যেতে চাইছেন।’’ ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও চিত্রটা একই রকম বলে জানিয়েছেন তিনি।
বড় সংখ্যায় বিত্তবানেরা পাকাপাকি ভাবে বিদেশে চলে যাওয়ায় ফ্রান্স, জার্মানি এবং স্পেনের অর্থনীতির উপর প্রভাব পড়তে চলেছে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’। এই তিন দেশ থেকে ৮০০, ৪০০ এবং ৫০০ কোটি ডলার বহির্গমনের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
পাশাপাশি, এ বছর সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং নিউজ়িল্যান্ডের মতো দেশে স্থায়ী বসতি করতে চলা বিত্তবানদের সংখ্যা কমতে চলেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ সমীক্ষক সংস্থা। ২০২৫ সালে সিঙ্গাপুরে ১৬০০, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় ১০০০ এবং নিউজ়িল্যান্ডে ১৫০ জন স্বদেশত্যাগী ধনকুবের পাড়ি জমাতে পারেন বলে জানিয়েছে ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’।