এক দিকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান। অপর দিকে মামুলি কিছু হাতিয়ার হাতে ভারতীয় সেনার অশ্বারোহী বাহিনী। এ-হেন অসম যুদ্ধে প্রথম পক্ষের জয় যেখানে অবশ্যম্ভাবী, ঠিক তখনই সব হিসাব বদলে দিলেন এ দেশের ঘোড়সওয়ার সৈনিকেরা। তাঁদের বীরত্বের সামনে টিকতে না পেরে রণে ভঙ্গ দেয় অটোমান তুরস্কের শক্তিশালী ফৌজ। ফলে ইজ়রায়েলের বন্দর-শহর হাইফাকে তাঁদের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয় ভারতীয় সেনা। শতবর্ষ পেরিয়ে সেই বীরগাথা এ বার স্কুলের পাঠ্য ইতিহাস বইয়ে রাখার কথা ঘোষণা করল ইহুদিভূমির সরকার।
চলতি বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর হাইফায় নিহত ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সেখানকার মেয়র ইয়োনা ইয়াহাভ। এর পরই ইহুদিদের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইগুলি সংশোধন করা হচ্ছে বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন তিনি। বলেন, ‘‘এত দিন আমাদের একটা বিষয় ভুল শেখানো হয়েছে। আমরা জানতাম অটোমান তুর্কিদের হাত থেকে হাইফাকে মুক্ত করেছে ব্রিটিশ বাহিনী। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। এর পুরো কৃতিত্বই ভারতীয় সৈনিকদের। ‘হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি’র গবেষণায় সেই প্রমাণ মিলেছে। আর তাই স্কুলের ইতিহাস বইগুলিকে পরিবর্তন করা হচ্ছে।’’
১৯১৪-’১৮ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিভূমিতে রক্ত ঝরায় ভারতীয় সৈন্যদল। ঔপনিবেশিক শাসনে ব্রিটেনের হয়ে লড়তে হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু সেখানেও বীরত্বের আলাদা ছাপ রাখতে সক্ষম হয় তাঁরা। সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে হাইফার মাউন্ট কারমেল পাহাড়ে আক্রমণ শানাতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি তৎকালীন ভারতীয় ফৌজের অশ্বারোহী রেজিমেন্ট। সেখানে অটোমান বাহিনীকে একরকম নির্মূল করে দেয় এ দেশের ঘোড়সওয়ার যোদ্ধারা। ইতিহাসে যা ‘শেষ মহান অশ্বারোহী’ অভিযান হিসাবে বিখ্যাত হয়ে আছে।
পশ্চিম এশিয়ায় ভারতীয় সেনার এ-হেন বীরত্ব এ দেশের মানুষের কতটা স্মরণে রয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্য দিকে অটোমান তুর্কিদের বিরুদ্ধে ওই যুদ্ধ একেবারেই ভোলেনি ইহুদিরা। হাইফার ভাগ্য বদলে দেওয়া ওই লড়াইয়ের বছরটা ছিল ১৯১৮। অর্থাৎ, বিশ্বযুদ্ধ তখন প্রায় শেষের পথে। ওই অবস্থায় ইজ়রায়েলের বন্দর-শহরটি হাতছাড়া হবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি আঙ্কারা। এতে জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরির পাশাপাশি অটোমান তুরস্কের পতনও একরকম নিশ্চিত হয়ে যায়।
হাইফার মাউন্ট কারমেলের যুদ্ধে অংশ নেয় ব্রিটিশ ভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনীর ১৫ নম্বর ইম্পেরিয়াল সার্ভিস ক্যাভালরি ব্রিগেড। আক্রমণের সময় একেবারে সামনের সারিতে ছিল তিনটি ঘোড়সওয়ার রেজিমেন্ট। সেগুলি হল মহীশূর, হায়দরাবাদ এবং জোধপুর ল্যান্সার্স। ২৩ সেপ্টেম্বর বন্দর-শহরটির পাহাড়ি এলাকা থেকে অটোমান তুর্কি ফৌজকে হটিয়ে দেয় তাঁরা। শুধুমাত্র বর্শা ও তরোয়াল ব্যবহার করে মেশিনগান সজ্জিত বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলেন অসীম সাহসী ভারতীয় সৈনিকেরা।
ইতিহাসবিদদের দাবি, মাউন্ট কারমেলের ঢাল বেশি হওয়ায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিল উপরে থাকা অটোমান তুর্কি বাহিনী। ঘোড়া নিয়ে এই রাস্তায় ভারতীয় সৈনিকেরা উঠে আসতে পারবে না বলে একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল তাঁদের। এই পরিস্থিতিতে পাহাড়ের এক দিক থেকে কামান দাগা শুরু করে ব্রিটিশ গোলন্দাজ ফৌজ। সেই ফাঁকে ধীরে ধীরে ঘোড়া নিয়ে কারমেলের উপরে উঠে হামলা চালায় ভারতীয় অশ্বারোহী সেনা। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে যুদ্ধে হেরে যায় মেশিনগান সজ্জিত তুর্কি সেনা।
হাইফার যুদ্ধে বীরত্বের স্বীকৃতি হিসাবে ক্যাপ্টেন আমান সিংহ বাহাদুর ও দফাদার জোর সিংহকে ‘ইন্ডিয়ান অর্ডার অফ মেরিট’-এ সম্মানিত করে ব্রিটিশ সরকার। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সগত সিংহ পান ‘মিলিটারি ক্রস’। সংশ্লিষ্ট লড়াইয়ের মূল নায়ক ছিলেন মেজর দলপত সিংহ। তাঁকেও ‘মিলিটারি ক্রস’-এ সম্মানিত করেছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকার। সংঘর্ষে জোধপুর ল্যান্সার্সের আট জন সৈনিক নিহত হন, আহত ছিলেন আরও ৩৪ জন। অন্য দিকে তুরস্কের ৭০০-র বেশি ফৌজিকে বন্দি করেন তাঁরা। দখলে আসে ১৭টি ফিল্ডগান ও ১১টি মেশিনগান।
ইজ়রায়েলের ইতিহাসে হাইফার যুদ্ধ অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা লর্ড লিওনার্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে একটি বিশেষ প্রতিশ্রুতির কথা লেখা ছিল। সংশ্লিষ্ট চিঠিতে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তিকে হারাতে ইহুদিদের সাহায্য চান বেলফোর। বিনিময়ে লড়াই শেষে পশ্চিম এশিয়ায় ইহুদি রাষ্ট্র তৈরির একরকম আশ্বাস দেন তিনি। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘বেলফোর ঘোষণা’ (বেলফোর ডিক্লারেশন) নামে খ্যাত।
ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী যখন রথচাইন্ডকে এই চিঠি পাঠাচ্ছেন তখন যুদ্ধের ময়দানে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি। এই সামরিক জোটের অংশ হিসাবে অটোমান তুর্কিরা ভূমধ্যসাগরের দিক থেকে ব্রিটিশ এবং ফরাসি বাহিনীর উপর ক্রমাগত চাপ তৈরি করে যাচ্ছিল। কিন্তু বছর ঘুরতেই পাল্টে যায় যাবতীয় হিসেব-নিকেশ। আচমকা হাইফা হাতছাড়া হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে আঙ্কারা। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় তাদের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে শুধুমাত্র হাইফাতেই ভারতীয় সৈনিকেরা লড়েছিলেন এমনটা নয়। ইজ়রায়েলি শহর জেরুজ়ালেম এবং রামাল্লাতেও রয়েছে এ দেশের শহিদ ফৌজিদের স্মৃতিসৌধ। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত। বর্তমানে ইজ়রায়েলে মোট ৯০০ ভারতীয় সেনার সমাধি রয়েছে। প্রতি বছর ২৩ সেপ্টেম্বর হাইফায় তাঁদের স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নয়াদিল্লির দূতাবাস।
এ বছরের অনুষ্ঠানে ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের কথা বলতে গিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ইজ়রায়েলে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জেপি সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘একটা সুরক্ষিত শহর অশ্বারোহী সেনাবাহিনী দখল করছে, এই নজির প্রথম বিশ্বযুদ্ধে দ্বিতীয়টি নেই। মনে রাখতে হবে এই লড়াইয়ে ব্রিটিশদের জয়ের ষোলো আনা কৃতিত্ব হল আমাদের দেশের সৈনিকদের। কারণ, ৭৪ হাজারের বেশি ভারতীয় সেনা ওই সংঘর্ষে জীবন উৎসর্গ করেন। এর মধ্যে পশ্চিম এশিয়ায় নিহতের সংখ্যা ছিল চার হাজার।’’
ইজ়রায়েলি স্কুলের ইতিহাস বইগুলিতে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত হাইফা যুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে। এত দিন এই অভিযানের নেপথ্যে ব্রিটিশ সেনা অফিসারদের সাহসিকতাকে অনেকটাই বড় করে দেখানো হচ্ছিল। কিন্তু, স্থানীয় ‘হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি’র গবেষণা প্রকাশিত হতেই ভুল বুঝতে পারে সেখানকার প্রশাসন। আর তাই গত ৮-১০ বছর ধরে স্কুলে স্কুলে ঘুরে ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের প্রচার করছিল ওই সংস্থা। এ বার সঠিক ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা করলেন হাইফার মেয়র।
২০১৮ সালে ভারত সফরে আসেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ওই সময় ১৯২২ সালে তৈরি নয়াদিল্লির একটি স্মৃতিস্তম্ভের নতুন নামকরণ করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট স্তম্ভটির নতুন নাম দেওয়া হয় ‘তিন মূর্তি হাইফা চক’। ২০১৭ সালে ইজ়রায়েল সফরে গিয়ে ভারতীয় সৈনিকদের সমাধিস্থল পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই সময় মেজর দলপত সিংহের স্মরণে একটি ফলক উদ্বোধন করেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সেনার আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে অশ্বারোহী বাহিনীর একীকরণ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। নতুন ইউনিটের নাম দেওয়া হয় ‘৬১ ক্যাভালরি’। ২০১৮ সালে এই ঘোড়সওয়ার বাহিনীর শতবর্ষে একটি দলকে ইহুদি ভূমিতে পাঠায় কেন্দ্র। সেখানে তাঁদের নামে একটি ডাকটিকিট উদ্বোধন করে ইহুদি সরকার।
পাকিস্তান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীর বা সীমান্তে চিনের চোখরাঙানি— প্রতিটা ক্ষেত্রে বিপদের সময় ভারতের পাশে থেকেছে ইজ়রায়েল। এর সর্বশেষ নিদর্শন হল ইয়েমেনের রাস আল-ইসা বন্দরে নোঙর করা ইসলামাবাদের মালবাহী জাহাজে ইহুদিদের ড্রোন হামলা। জলযানটিতে ছিল তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি)। সেখানে তেল আভিভের মানববিহীন উড়ুক্কু যান আছড়ে পড়ায় জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়।
ইসলামাবাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট ট্যাঙ্কারটিতে নাবিক-সহ মোট ২৭ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২৪ জনই পাক নাগরিক। বাকিদের মধ্যে দু’জন শ্রীলঙ্কা এবং একজন নেপালের বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন তাঁরা। ড্রোন হামলার অন্তত ১০ দিন পর এই নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি পোস্ট করেন ইসলামাবাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর আগে কখনও কোনও পাক জাহাজকে এ ভাবে নিশানা করেনি ইজ়রায়েল। ফলে বিশ্লেষকদের অনেকেই এই ঘটনাকে ইসলামাবাদের উপরে প্রথম ইহুদি হামলা হিসাবে দেখছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাকিস্তান। ঠিক ওই দিনই ইসলামাবাদের মালবাহী জাহাজে ইহুদি ড্রোন হামলার আলাদা তাৎপর্য রয়েছে, বলছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সদ্য সই হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বলা হয়েছে, দু’জনের মধ্যে যে কোনও একটি দেশ অপর কোনও রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হলে দু’পক্ষই তাকে যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করবে। ঠিক তার পরেই সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটি নিয়ে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ। ‘জিয়ো নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রিয়াধকে ‘আণবিক নিরাপত্তা’র আশ্বাস দেন তিনি।
ইসলামাবাদ ও রিয়াধের মধ্যে হওয়া এই চুক্তিতে প্রমাদ গুনেছে ইজ়রায়েল। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এর জেরে আগামী দিনে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি করবে তেল আভিভ। দু’তরফে হাতিয়ার সংক্রান্ত একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাহিনি স্কুলপাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইহুদি সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার অন্য তাৎপর্য রয়েছে মনে বলে করা হচ্ছে।