এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! আরব মুলুকে হু-হু করে পড়ছে ভারতীয় টাকার দাম। বিষয়টা জানাজানি হতেই আতঙ্কিত অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে শুরু হয়েছে হুড়োহুড়ি। লোকসান ঠেকাতে দ্রুত বাড়িতে টাকা পাঠাচ্ছেন তাঁরা। পশ্চিম এশিয়ায় ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের প্রভাবে এই আর্থিক অস্থিরতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। আপাতত তা কেটে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকায় বাড়ছে উদ্বেগ।
পশ্চিম এশিয়ার জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘গাল্ফ নিউজ়’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় টাকার দাম সবচেয়ে বেশি পড়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। বর্তমানে আবু ধাবিতে এক দিরহামের বিনিময়ে মিলছে ভারতের প্রায় ২৪ টাকা। এই সূচক আরও নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণে প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছে।
এই উপমহাদেশের অনেকে চাকরি বা ব্যবসার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলিতে থাকার কারণে সেখানে রয়েছে একগুচ্ছ বিদেশি মুদ্রা বিনিময় সংস্থা (পড়ুন ফরেন মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টার)। ‘গাল্ফ নিউজ়’-এর দাবি, চলতি বছরের ১৯ জুন থেকে ওই কেন্দ্রগুলিতে অনাবাসী ভারতীয়দের ভিড় বাড়তে শুরু করে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন আমিরশাহির একটি এক্সচেঞ্জের পদস্থ কর্তা। তাঁর কথায়, ‘‘টাকার দামের হেরফের হওয়ার জন্য প্রবাসী ভারতীয়েরা অপেক্ষা করতে রাজি নন। বাড়িতে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে একটা অস্থির ভাব লক্ষ করেছি।’’
সৌদি এবং আমিরশাহির এক্সচেঞ্জগুলির পদস্থ কর্তাদের দাবি, ‘‘প্রতি বছর জুন মাসে সাধারণত বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পায়। কারণ, এই সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকায় প্রবাসী ভারতীয়দের হাতে দিরহাম থাকে কম। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বেড়াতে যাওয়ার জন্য এই সময়টাকে বেছে নেন। কিন্তু, এ বছর চিত্র সম্পূর্ণ অন্য।’’ এর জন্য ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতকেই মূলত দায়ী করেছেন তাঁরা।
আরব মুলুকের আর্থিক বিশ্লেষকদের অনুমান, আগামী জুলাই মাসেও দিরহামের নিরিখে দুর্বল হবে টাকার দাম। সে ক্ষেত্রে বিদেশি মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রগুলির মুনাফার অঙ্ক চড়চড়িয়ে বাড়তে পারে। তবে দু’পক্ষের সংঘাত তীব্র হোক, তা কখনওই চাইছেন না তাঁরা। কারণ, তাতে সার্বিক ভাবে আর্থিক পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সৌদি এবং আমিরশাহির অর্থনীতি মূলত খনিজ তেলের রফতানির উপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, ইহুদি এবং শিয়া মুলুকের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র হলে ফের বিশ্ব জুড়ে বাড়বে সোনা কেনার প্রবণতা। কারণ, লগ্নিকারীদের কাছে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসাবে ‘হলুদ ধাতু’র আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। একটা সময় ডলারের উপরেও ভরসা করতেন তাঁরা। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন মুদ্রার দর নিম্নমুখী থাকায় সেখান থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সে ক্ষেত্রে নিম্নমুখী হতে পারে আরব দুনিয়ায় মুদ্রার মূল্য।
গত ২২ জুন ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইরানের ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান— এই তিন পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনা। ঠিক তার পরেই প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দেয় তেহরান। সাবেক পারস্য দেশের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমেরিকার পালানোর পথ নেই।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, খুব দ্রুত পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলিকে দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নিশানা করবে ইরানি ফৌজ। সে ক্ষেত্রে গোটা আরব দুনিয়ায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সৌদি আরব এবং আমিরশাহি দু’টি জায়গাতেই রয়েছে আমেরিকার সেনাছাউনি। সেখানে আইআরজিসির ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়লে অবশ্যই লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে এই দুই উপসাগরীয় দেশ।
দ্বিতীয়ত, তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে মার্কিন হামলার পর পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করার দিকে এগোচ্ছে ইরান। ইতিমধ্যেই সেই প্রস্তাবে সিলমোহর দিয়েছে তেহরানের পার্লামেন্ট। যদিও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সেখানকার সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইআরজিসির কমান্ডার ইসমাইল কোসারি বলেছেন, ‘‘ওই প্রণালী বন্ধ করা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। নির্দেশ এলেই সেটা কার্যকর করা হবে।’’
পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক বাজারে যত তেল আমদানি-রফতানি করা হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই চলে এই সমুদ্রপথ দিয়ে। তেল রফতানিকারী দেশগুলির জোট ওপেকের (অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়) সদস্য সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কুয়েত, কাতার এবং ইরাক এখান দিয়েই ‘তরল সোনা’ বিদেশে পাঠিয়ে থাকে।
এ ছাড়া বিশ্বের তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস) আমদানি ও রফতানির প্রায় ২০ শতাংশ চলে হরমুজ় প্রণালী দিয়ে। আরব দেশগুলির মধ্যে কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এই জলপথ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস পাঠিয়ে থাকে। যুদ্ধের কারণে শেষ পর্যন্ত ইরান ওই রাস্তা বন্ধ করতে বড়সড় চাপের মুখে পড়তে পারে আরব দেশগুলির অর্থনীতি। আর তাই সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়রা আতঙ্কে দ্রুত দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
পারস্য উপসাগর সংলগ্ন হরমুজ় প্রণালী অত্যন্ত সরু হওয়ায় সেটা বন্ধ করা ইরানের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। সংশ্লিষ্ট প্রণালীটির কোনও কোনও জায়গা মাত্র ৩৩ কিলোমিটার চওড়া। আর তাই তেহরান এটিকে বন্ধ করার ইঙ্গিত দেওয়ায় আরব দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে হইচই পড়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ইরানের হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করা আটকাতে তেহরানের সঙ্গে চিনের কথা বলা উচিত বলে মন্তব্য করেছে আমেরিকা। এ প্রসঙ্গে মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো ‘ফক্স নিউজ়’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘বেজিং তেলের জন্য ওই জলপথের উপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। তাই আমরা চাই এ ব্যাপারে সাবেক পারস্য দেশের সঙ্গে কথা বলুক ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপঙের সরকার।’’
গত ১৩ জুন থেকে চলা ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের মধ্যে এই দুই দেশে আটকে পড়া ভারতীয়দের নিরাপদে বার করে আনতে ‘অপারেশন সিন্ধু’ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। সংঘাত আরব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে সৌদি এবং আমিরশাহির প্রবাসীরাও ঘরে ফিরতে চাইবেন। তাই পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগে তাঁরা দেশে টাকা পাঠিয়ে রাখতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে।