ভারতীয় কামানে মন মজেছে আর্মেনিয়ার। আর তাই বাহিনীর হাত শক্ত করতে আরও ৮০টি ‘অ্যাডভান্স টোয়েড আর্টিলারি গান সিস্টেম’ বা এটিএজিএসের বরাত দিতে চলেছে সেখানকার সরকার। এই ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। তাঁদের দাবি, বিশ্ববাজারে ধীরে ধীরে বাড়ছে নয়াদিল্লির হাতিয়ারের চাহিদা। ফলে আগামী দিনে সেখানে এ দেশের প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি যে ‘গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়’ হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।
এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) অন্তর্গত আর্মেনিয়ায় ভারতীয় অস্ত্রের বেশ ভাল চাহিদা রয়েছে। বছর কয়েক আগে ১২টি এটিএজিএসের জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে চুক্তি করে ইয়েরেভান। ২০২৩ সালে সেগুলি হাতে পায় আর্মেনীয় গোলন্দাজ বাহিনী। পরবর্তী সময়ে একাধিক মহড়ায় সেগুলির দুর্দান্ত পারফরম্যান্স লক্ষ করে এই শ্রেণির আরও ৮০টি কামান কেনার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা করে ফেলেছে মধ্য এশিয়ার ওই দেশ।
৫২ ক্যালিবারের হাউৎজ়ার শ্রেণির এটিএজিএসের নকশা তৈরি করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন) ‘আর্মামেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট’ শাখা। এর সাহায্যে ১৫৫ মিলিমিটারের গোলা নিখুঁত নিশানায় ছুড়তে পারে বাহিনী। মাত্র এক মিনিটে পাঁচটি গোলা নিক্ষেপের সক্ষমতা রয়েছে কামানের। হাতিয়ারটির পাল্লা ৪৫ থেকে ৪৮ কিলোমিটার।
‘অ্যাডভান্স টোয়েড আর্টিলারি গান সিস্টেম’-এর নকশা তৈরি করতে ডিআরডিও-র সময় লেগে গিয়েছিল পাঁচ বছর। এর জন্য ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যান প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এই কাজে তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল টাটা অ্যাডভান্স সিস্টেম এবং ভারত ফোর্জ়ের মতো বেসরকারি সংস্থা। ২০১৯ সাল থেকে ভারতীয় সেনার জন্য শুরু হয় এর উৎপাদন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ভারতীয় সেনার গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য এটিএজিএস নির্মাণের অনুমতি রয়েছে দু’টি সংস্থার। তারা হল, কল্যাণী স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম্স লিমিটেড (কেএসএসএল) এবং টাটা অ্যাডভান্স সিস্টেম্স। এর মধ্যে প্রথম সংস্থাটি ২০২৩ সালে আর্মেনীয় ফৌজকে ১২টি কামান সরবরাহ করেছিল। ফলে আগামী দিনে ইয়েরেভান ফের বরাত দিলে পুণের প্রতিরক্ষা সংস্থাটি যে মোটা অঙ্কের মুনাফার সুযোগ পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর্মেনীয় সেনাবাহিনী সূত্রে খবর, কামানটি হাতে পাওয়ার পর সুউচ্চ পাহাড়ি এলাকা, মালভূমি এবং সমতলভূমিতে এর লাগাতার পরীক্ষা চালায় তারা। ইয়েরেভানের গোলন্দাজরা জানিয়েছেন, কঠিন ভূপ্রাকৃতিক এলাকাতেও নিজের জাত চিনিয়েছে ভারতের এটিএজিএস। তাদের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, মহড়ার সময়ে এক বারের জন্যও নিশানা ভুল করেনি কল্যাণী গ্রুপের তৈরি এই মারণাস্ত্র। একে ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্স বলে উল্লেখ করেছে তারা।
আর্মেনীয় বাহিনীর ভারতীয় কামানটিকে নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, নির্মাণকারী সংস্থা কেএসএসএল ইয়েরেভান ফৌজের চাহিদার কথা মাথায় রেখে কামানটিকে তৈরি করেছে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির ‘ট্র্যাজিক্টরি কম্পিউটেশন মডিউল’ বা টিসিএমে বড় বদল করেছে তারা। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে আর্মেনীয় ভাষা। ফলে এ দেশের মাটিতে তৈরি এটিএজিএসটিকে ব্যবহার করতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না মধ্য এশিয়ার দেশটির গোলন্দাজদের।
মধ্য এশিয়ার ককেসাস পাহাড়ের দক্ষিণ কোলের কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী দেশ হল আর্মেনিয়া। প্রতিবেশী আজ়ারবাইজানের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তাদের। বিতর্কিত নাগর্নো-কারাবাখের দখলকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের সাহায্য পাওয়া বাকুকে শায়েস্তা করতে ভারতের দ্বারস্থ হয়েছে ইয়েরেভান। গত কয়েক বছর ধরে তাই নয়াদিল্লির থেকে একের পর এক মারণাস্ত্র কিনছে তারা। সেই তালিকায় কামান ছাড়াও রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এবং দূরপাল্লার রকেট।
২০২২ সালে ‘আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার জন্য ভারতের সঙ্গে ছ’হাজার কোটি টাকার চুক্তি করে আর্মেনিয়া। এই হাতিয়ারের মোট ১৫টি ইউনিট ইয়েরেভানকে সরবরাহের কথা রয়েছে নয়াদিল্লির। গত বছরের নভেম্বরে ‘আকাশ’-এর দ্বিতীয় ইউনিট আর্মেনীয় সেনার হাতে তুলে দিয়েছে মোদী সরকার। এই হাতিয়ারের সব ক’টি ইউনিট সরবরাহ করতে ৪-৫ বছর সময় লেগে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানের ছোড়া প্রায় সমস্ত ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করে খবরের শিরোনামে চলে আসে ‘আকাশ’। এটি প্রকৃতপক্ষে একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যাতে রয়েছে ভূমি থেকে আকাশে হামলা চালানোর ক্ষেপণাস্ত্র। শত্রুর যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই হাতিয়ারের। এর পাল্লা ২৫ কিলোমিটার।
২০২২ সালেই নয়াদিল্লির থেকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’ কেনে আর্মেনিয়া। এর নকশা তৈরি করেছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। মাত্র ৪৪ সেকেন্ডের মধ্যে ১২টি করে রকেট নিখুঁত নিশানায় ছোড়ার ক্ষমতা রয়েছে পিনাকার। সাধারণ ভাবে এর পাল্লা ৪০ কিলোমিটার। তবে হাতিয়ারটির নতুন সংস্করণের বর্ধিত পাল্লা ৬০ কিলোমিটার বলে জানা গিয়েছে।
গত বছরের নভেম্বর থেকে আর্মেনিয়াকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’ সরবরাহ শুরু করেছে ভারত। এই হাতিয়ারটির জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে ২৫ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে ইয়েরেভান। এ ছাড়া মধ্য এশিয়ার দেশটিকে বেশ কিছু অ্যান্টি ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেডার সিস্টেম পাঠানোর কথা রয়েছে কেন্দ্রের।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ঘরের মাটিতে তৈরি একাধিক হাতিয়ার চমৎকার পারফরম্যান্স করায় বিশ্ব বাজারে বেড়েছে ভারতীয় অস্ত্রের চাহিদা। সম্প্রতি, ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ হিসাবে পরিচিত তুরস্কে ছড়িয়ে পড়ে নয়াদিল্লি এবং গ্রিসের মধ্যে হতে চলা প্রতিরক্ষা চুক্তি সংক্রান্ত খবর। আঙ্কারার গণমাধ্যমগুলির দাবি, নয়াদিল্লির থেকে দূরপাল্লার ভূমি থেকে আক্রমণকারী ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বা এলআর-এলএসিএম (লং রেঞ্জ-ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ় মিসাইল) কিনতে চলেছে আথেন্স। এজ়িয়ান সাগর সংলগ্ন এলাকায় সেগুলিকে মোতায়েন করবে গ্রিক ফৌজ।
গত বছরের নভেম্বরে এলআর-এলএসিএমের সফল পরীক্ষা করে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। টার্বোফ্যান ইঞ্জিন পরিচালিত ওই ক্ষেপণাস্ত্রটির অনুমানিক পাল্লা ১,৫০০ কিলোমিটার। মূলত রেডার স্টেশন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এবং কৌশলগত সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করতে এর নকশা তৈরি করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
ডিআরডিওর তৈরি এ-হেন এলআর-এলএসিএম প্রচলিত এবং পরমাণু— দু’ধরনের বিস্ফোরক বহনেই সক্ষম। এর গতিবেগ ‘সাবসনিক’। অর্থাৎ, প্রায় শব্দের গতিতে ছুটতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র। বর্তমানে এর উৎপাদনকারী দু’টি সংস্থা হল হায়দরাবাদের ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড এবং বেঙ্গালুরুর ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড।
২০২২ সালে ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য ভারতের সঙ্গে ৩৭ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের চুক্তি করে ফিলিপিন্স। গত বছরের এপ্রিলে হাতিয়ারটির প্রথম ব্যাচ হাতে পায় ম্যানিলা। উল্লেখ্য, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাক বায়ুসেনার একাধিক ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নয়াদিল্লি। ‘ব্রহ্মস’-এর আঘাতে রহিম ইয়ার খান, সরগোধা, জেকোবাবাদ এবং নূর খান ছাউনি-সহ ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সেই ছবি প্রকাশ্য আসতেই দুনিয়ার অস্ত্রের বাজারে ‘ব্রহ্মস’-এর চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি নয়াদিল্লির ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের চারটি মূল শ্রেণি রয়েছে। যুদ্ধজাহাজ, ডুবোজাহাজ, যুদ্ধবিমান এবং স্থলবাহিনীর লঞ্চার থেকে একে শত্রুর উপর ছুড়তে পারে সেনা। এর নির্মাণকারী সংস্থার নাম ‘ব্রহ্মস অ্যারোস্পেস লিমিটেড’। শব্দের প্রায় তিন গুণ বেশি গতিতে ছুটে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে পারে এই ক্ষেপণাস্ত্র।
প্রায় সাড়ে আট মিটার লম্বা ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র ৩০০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। এর সাহায্যে পরমাণু হামলাও চালানো যেতে পারে। এক একটি ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের ওজন তিন হাজার কেজি। বর্তমানে একে ‘হাইপারসনিক শ্রেণি’তে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন ভারত ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। সে ক্ষেত্রে শব্দের আট গুণ বেশি গতিতে ছুটতে পারবে ‘ব্রহ্মস’। এর পাল্লা বেড়ে দাঁড়াবে দেড় হাজার কিলোমিটার।
বর্তমানে ভারতীয় সেনা এবং নৌবাহিনী যে ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, তার পাল্লা ৮০০ কিলোমিটার। অন্য দিকে, এ দেশের বিমানবাহিনীর হাতে থাকা এই হাতিয়ার ৪৫০-৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। যদিও রফতানির ক্ষেত্রে ২৯০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার শ্রেণির ‘ব্রহ্মস’ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি।
সূত্রের খবর, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারত-রুশ যৌথ উদ্যোগে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটির তাণ্ডব দেখে ইতিমধ্যেই ১৫টি দেশ নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ‘ব্রহ্মস’ কেনার ব্যাপারে ৪৫ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে পারে ইন্দোনেশিয়া। প্রসঙ্গত, এর আগে কখনও এত বড় প্রতিরক্ষা চুক্তি করেনি ভারত। এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে ভিয়েতনাম, তাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাতার, ওমান, ব্রাজ়িল, আর্জেন্টিনা এবং চিলি।
গত ২৬ মার্চ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের থেকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য ৩০৭টি এটিএজিএস তৈরির বরাত পায় কল্যাণী স্ট্র্যাটেজিক সিস্টেম্স লিমিটেড। কামানগুলির মোট দাম ৮৩ কোটি ডলার ধার্য করা হয়েছে। পুণেয় সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির ব্যাপক উৎপাদন শুরু হওয়ার মুখে আর্মেনিয়া প্রতিরক্ষা চুক্তি করলে প্রতি ইউনিটে কিছুটা ছাড় দিতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার, খবর সূত্রের।