Andaman and Nicobar Islands

‘গুপ্তচর’ জাহাজে গেঁড়ি-গুগলির মতো দ্বীপমালায় উঁকিঝুঁকি! ‘কালাপানি’তে জব্দ হবে ড্রাগনের বিষ-ফন্দি?

বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবরের জন্য ভারতের সঙ্গে সংঘাত হলে বিপাকে পড়তে পারে চিন। ওই দ্বীপপুঞ্জের কৌশলগত গুরুত্ব দিন দিন রক্তচাপ বাড়াচ্ছে বেজিঙের।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৫ ১৭:৩৮
Share:
০১ ২০

‘কালাপানি’ আতঙ্কে ড্রাগনের দফারফা! আন্দামান-নিকোবরকে কেন্দ্র করে রক্তচাপ বাড়ছে চিনের। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে যে কোনও মুহূর্তে ভারত যে তাদের সামুদ্রিক আধিপত্যের কোমর ভাঙতে পারে, তা ভালই জানে বেজিং। আর তাই সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকায় উঁকিঝুঁকি বেড়েছে মান্দারিনভাষীদের ‘গুপ্তচর’ জাহাজের।

০২ ২০

২০১৬ সালে আন্দামান-নিকোবরকে নিয়ে হঠাৎ করেই ভারতকে হুমকি দিয়ে বসেন নয়াদিল্লির চিনা রাষ্ট্রদূত। হুঁশিয়ারির সুরে তিনি বলেন, ‘‘আগামী দিনে ওই দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা বদলের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।’’ এর পরেই নড়চড়ে বসে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। বঙ্গোপসাগরীয় ওই এলাকায় বাড়ানো হয় নৌবাহিনীর টহলদারি। কিন্তু, তাতে চুপ করে বসে থাকেনি ‘আগ্রাসী’ বেজিঙের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র জলযোদ্ধারা।

Advertisement
০৩ ২০

চিনা রাষ্ট্রদূতের হুমকির কয়েক মাসের মধ্যেই বঙ্গোসাগরীয় এলাকায় ‘গুপ্তচর’ জাহাজ পাঠায় বেজিং। ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে লম্বা সময়ের জন্য নোঙর করেছিল পিএলএ নৌবাহিনীর ওই ধরনের একটি জলযান। চলতি বছরে ফের একই রকমের ‘দৌরাত্ম্য’ করতে দেখা গিয়েছে তাঁদের। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চলাকালীন বঙ্গোসাগরের দিকে আনাগোনা বৃদ্ধি পায় ড্রাগনের ‘গুপ্তচর’ জাহাজ ‘দ্য ইয়াং ই হাও’-এর।

০৪ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে আন্দামান-নিকোবরকে সে ভাবে গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্র। কিন্তু, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময়ে হঠাৎ করে খবরের শিরোনামে চলে আসে বঙ্গোসাগরের ওই দ্বীপপুঞ্জ। কারণ, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দ্বীপমালাটি কব্জা করার ছক ছিল ইন্দোনেশিয়ার। ফলে বাধ্য হয়ে সেখানে বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে নয়াদিল্লি। এতে ক্ষুব্ধ ইন্দোনেশিয়ার সমর্থন ঝুঁকে যায় ইসলামাবাদের দিকে।

০৫ ২০

এ-হেন আন্দামান-নিকোবরকে নিয়ে চিনের মাথাব্যথার কারণ হল সংশ্লিষ্ট দ্বীপপুঞ্জটির কৌশলগত অবস্থান। এর অদূরে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দুই দ্বীপরাষ্ট্রের মাঝে আছে সরু একফালি সামুদ্রিক রাস্তা। নাম মলাক্কা প্রণালী। বেজিঙের সমুদ্র-বাণিজ্যের সিংহভাগই ওই পথ দিয়ে চলাচল করে। আন্দামান-নিকোবরকে ব্যবহার করে প্রয়োজনে যা যে কোনও সময়ে বন্ধ করতে পারে ভারত।

০৬ ২০

পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মলাক্কা প্রণালী ছাড়া চিনের পণ্য আনা-নেওয়ার অন্য কোনও রাস্তা নেই। আমদানি করা খনিজ তেলের ৮০ শতাংশই আরব দেশগুলি থেকে পায় বেজিং। আর সেই ‘তরল সোনা’ হরমুজ় প্রণালী ও আরব সাগর হয়ে মলাক্কা প্রণালী ঘুরে পৌঁছোয় ড্রাগনভূমির বিভিন্ন বন্দরে। বিশ্লেষকদের একাংশ তাই মনে করেন, এই সামুদ্রিক রাস্তা বন্ধ হলে মান্দারিনভাষীদের অর্থনীতি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগবে না।

০৭ ২০

মলাক্কা প্রণালীর ঠিক মুখে রয়েছে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ফলে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারির ক্ষেত্রে এ দেশের নৌবাহিনীর বাড়তি সুবিধা রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণে দীর্ঘ দিন ধরে সামুদ্রিক রাস্তায় ভারতকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। ড্রাগনের এই ষড়যন্ত্রকে ‘মুক্তোর সুতো’ (স্ট্রিং অফ পার্লস) বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা।

০৮ ২০

সামুদ্রিক রাস্তায় ভারতকে ঘিরতে মায়ানমারের কিয়াউকফিউ, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের গ্বদর বন্দরে কৌশলগত প্রভাব রয়েছে বেজিঙের। এই এলাকাগুলিকে প্রয়োজনমতো নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে বেজিং। এ ছাড়া আফ্রিকার জিবুতিতে নৌঘাঁটি খুলেছে লালফৌজ।

০৯ ২০

চিনের ‘মুক্তোর সুতো’ ষড়যন্ত্র টের পেতেই পাল্টা ‘হিরের হার’ নীতিতে (পড়ুন ডায়মন্ড নেকলেস পলিসি) বেজিংকে গলা পেঁচিয়ে ধরার নীলনকশা ছকে ফেলেছে নয়াদিল্লি। আর তাই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রতিটা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে সাউথ ব্লক। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে প্রথমেই বলতে হবে ইরানের চাবাহার বন্দরের কথা। গ্বদর থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১৭০ কিলোমিটার। সাবেক পারস্য দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ওই সমুদ্রবন্দরটি তৈরি করেছে ভারত।

১০ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশই চাবাহারকে নয়াদিল্লির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ ওই সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে ভারত। দ্বিতীয়ত, চাবাহারের মাধ্যমে গ্বদরে চিনের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখার সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের নৌবাহিনী।

১১ ২০

চাবাহারের পাশাপাশি ওমান, ইন্দোনেশিয়া, সেসেলস, মরিশাস এবং ভিয়েতনামে ধীরে ধীরে নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত। সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, ‘ডায়মন্ড নেকলেস’ নীতির সবচেয়ে বড় সাফল্য হল, চিনা প্রভাব যুক্ত প্রতিটা বন্দরকে ঘিরে রাখা। এক কথায় বেজিঙের ‘মুক্তোর সুতো’র উপরে ওই ‘হিরের হার’ নয়াদিল্লি গেঁথে ফেলেছে, এ কথা বলা যেতে পারে।

১২ ২০

আন্দামান-নিকোবরকে কেন্দ্র করে চিনের উপর চাপ বাড়াতে আরও একটি কৌশল নিয়েছে নয়াদিল্লি। এর নাম ‘জোড়া মাছ-বড়শি’ নীতি। এক দিকে বঙ্গোপসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং অন্য দিকে পশ্চিম ভারতীয় নৌসেনা ঘাঁটি, এই দু’য়ের মেলবন্ধনে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় দু’টি মাছ-বড়শির মতো দেখতে ব্যূহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এ দেশের জলযোদ্ধারা। বেজিঙের প্রতিটা রণতরীর উপরে নজরদারির ভার রয়েছে তাঁদের কাঁধে।

১৩ ২০

এ ছাড়া আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গড়ে ওঠা চতুঃশক্তি জোট ‘কোয়াড’-এর সদস্যপদ রয়েছে ভারতের। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা ডুবোজাহাজের উপর নজরদারি করতে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে এই সংগঠন। ফলে সেই তথ্য অনায়াসেই হাতে পাচ্ছে নয়াদিল্লি। এর জেরে সংঘাত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই কয়েক কদম এগিয়ে থাকার সুযোগ চলে এসেছে এ দেশের নৌকমান্ডারদের হাতে।

১৪ ২০

ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আন্দামান-নিকোবরের গুরুত্ব প্রথম টের পেয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের চোল রাজারা। ১০৫০ সালে ওই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে তাঁরা। ফলে কৌশলগত এলাকাটি অনুষ্ঠানিক ভাবে এ দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। মুঘল পরবর্তী জমানায় ওই এলাকা চলে যায় মারাঠা সাম্রাজ্যের আওতায়। ১৭৮৯ সালে যুদ্ধে মারাঠাদের হারিয়ে ওই দ্বীপপুঞ্জ কব্জা করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পরবর্তী ৬৮ বছর সেখানে ছিল কোম্পানির শাসন।

১৫ ২০

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনভার সরাসরি চলে যায় ব্রিটেনের হাতে। ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬ সালের মধ্যে সেখানে ‘সেলুলার জেল’ গড়ে তোলে ইংরেজ সরকার। চলতি কথায়, এরই নাম ছিল ‘কালাপানি’। সংশ্লিষ্ট জেলটি তৈরি করতে গিয়ে বিপুল সংখ্যায় গাছ কাটতে হয়েছিল। সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি স্থানীয় আদিবাসীরা। ফলে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।

১৬ ২০

অনুন্নত হাতিয়ার নিয়ে আন্দামান-নিকোবরের বাসিন্দাদের পক্ষে ওই যুদ্ধে জেতা সম্ভব ছিল না। আর তাই শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনের বশ্যতা স্বীকার করতে হন তাঁরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইংরেজদের থেকে সংশ্লিষ্ট দ্বীপপুঞ্জটি ছিনিয়ে নেয় জাপান। বঙ্গোপসাগরের ওই এলাকা পুনর্দখল করতে ব্রিটিশদের দু’বছর সময় লেগেছিল।

১৭ ২০

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। দেশভাগের ফলে জন্ম হয় পাকিস্তানের। ওই সময়ে কৌশলগত অবস্থানের কারণে আন্দামান-নিকোবরকে হাতছাড়া করতে চায়নি ব্রিটেন। শুধু তা-ই নয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কাছে এই দ্বীপপুঞ্জটিকে লিজ়ে নেওয়ার দাবি পর্যন্ত জানিয়েছিলেন শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন। যদিও তাতে রাজি হননি নেহরু।

১৮ ২০

আন্দামান-নিকোবর ব্রিটেনের হাতছাড়া হচ্ছে বুঝতে পেরে দ্রুত তা কব্জা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান। কিন্তু তাদের সেই দাবি ধোপে টেকেনি। শেষে ইন্দো-বর্মা সীমান্ত কমিটিতে সংশ্লিষ্ট দ্বীপপুঞ্জের ভাগ্য ঠিক করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা আন্দামান-নিকোবরকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা বলে ঘোষণা করে নয়াদিল্লি।

১৯ ২০

জমির নিরিখে ভারতের মাত্র ০.২ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে আন্দামান-নিকোবর। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ইইজ়েডের (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন) ৩০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সংশ্লিষ্ট দ্বীপপুঞ্জটির। এর ৮০ শতাংশ ঘন জঙ্গলে ভরা। আন্দামান-নিকোবরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। এর মাধ্যমে মোটা অর্থ আয় করে সরকার।

২০ ২০

আর তাই বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে আন্দামান-নিকোবরে সেনার তিনটি বিভাগকেই মোতায়েন রেখেছে কেন্দ্র। সেখানকার উপ-রাজ্যপাল পদে আছেন নৌসেনার অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ অফিসার অ্যাডমিরাল দেবেন্দ্রকুমার জোশী। চিনকে চাপে রাখতে প্রায়ই ওই দ্বীপপুঞ্জে মহড়ার মাধ্যমে গা ঘামাতে দেখা যায় ফৌজকে। পাশাপাশি, গুরুত্ব বাড়াতে সেখানে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির কাজও চালাচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement