পাকিস্তান মদতপুষ্ট দুই জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবা এবং জইশ-ই-মহম্মদের সঙ্গে প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ‘মহাজোট’। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) এক মঞ্চে দেখা গেল তিন সংগঠনের শীর্ষনেতাদের। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্কে কাঁপছে উপত্যকা। বিষয়টিতে কপালে ভাঁজ পড়েছে এ দেশের দুঁদে গোয়েন্দা অফিসারদের।
প্রতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ‘কাশ্মীর সংহতি দিবস’ পালন করে ইসলামাবাদ। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। সেই উপলক্ষে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে লস্কর ও জইশ জঙ্গিরা। সেখানেই মুখ্য অতিথি হিসাবে প্রথম বার হাজির ছিলেন হামাসের এক শীর্ষনেতা।
চলতি মাসের ৫ তারিখে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাউলাকোট এলাকার সাবির স্টেডিয়ামে লস্কর এবং জইশ জঙ্গিদের একত্রিত হতে দেখা গিয়েছে। এ বারের অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়, ‘কাশ্মীর সংহতি এবং আল আকসা ফ্লাড সম্মেলন’। এই নামের সঙ্গে গত দেড় বছর ধরে চলা ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, প্যালেস্টাইনের গাজ়া স্ট্রিপ থেকে ইজ়রায়েলের উপর তিন দিক থেকে হামলা চালায় হামাস। সেই আক্রমণে প্রাণ হারান প্রায় ১,২০০ নিরীহ মানুষ। পাশাপাশি ইহুদি-সহ একাধিক দেশের নাগরিকদের অপহরণ করে গাজ়ায় নিয়ে গিয়েছিল হামাস।
ইহুদিভূমির উপর এই আক্রমণের পোশাকি নাম ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ রাখেন হামাস নেতারা। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ‘কাশ্মীর সংহতি দিবসে’র অনুষ্ঠানে ওই নাম ব্যবহার করাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন গোয়েন্দাকর্তারা।
পিওকের সাবির স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন জইশপ্রধান মাসুদ আজ়হারের ভাই তাল্হা সইফ এবং জইশ কম্যান্ডার আজ়গর খান কাশ্মিরি এবং মাসুদ ইলিয়াস। এ ছাড়াও লস্কর-ই-তৈবার একাধিক জঙ্গিনেতাকে সেখানে দেখা গিয়েছে।
হামাসের তরফে অনুষ্ঠানে যোগ দেন ইরানের প্রতিনিধি খালিদ আল-কাদুমি। তিনি ছাড়া সশস্ত্র সংগঠনটির আরও তিন থেকে চার জন সেখানে ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। পিওকে যাওয়ার আগে পাকিস্তানের কট্টরপন্থী দল জামিয়াত উলেমা-ই-ইসলাম (এফ)-এর প্রধান মৌলানা ফজলুর রহমানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন আল-কাদুমি।
পাক মদতপুষ্ট জইশ ও লস্কর ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে, ২০০১ সালের সংসদ ভবনে জঙ্গি হামলা, ২০০৮ সালের মুম্বই হামলা এবং ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে আত্মঘাতী হামলা। এর মধ্যে রাষ্ট্রপুঞ্জের সন্ত্রাসী তকমা রয়েছে জইশ-ই-মহম্মদের গায়ে।
২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর জইশের কোমর ভাঙতে আসরে নামে ভারতীয় বায়ুসেনা। জঙ্গি নাশকতার কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোটে বিমানহানা চালায় নয়াদিল্লি। জইশ সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে এর মাধ্যমে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় বায়ুসেনা।
গোয়েন্দাদের দাবি, বালাকোটে বিমান হামলার পর থেকে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে জইশ-ই-মহম্মদ। লস্করের অবস্থাও তথৈবচ। সেই কারণেই হামাসের সাহায্যে সংগঠন মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে এই দুই পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী।
বিশ্লেষকদের অনুমান, আগামী দিনে হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর কায়দায় উপত্যকায় বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে এই দুই জঙ্গি গোষ্ঠী। সে ক্ষেত্রে একসঙ্গে বিপুল সংখ্যায় রকেট হামলার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভূস্বর্গে সন্ত্রাসবাদী ঢোকানোর পরিকল্পনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে পাল্টা ঘুঁটি সাজাতে তৎপর হয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। গত ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তা নিয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পরে তিনি বলেন, ‘‘অনুপ্রবেশকে শূন্যে নামিয়ে আনার লাগাতার চেষ্টা চলছে। উপত্যকা থেকে সন্ত্রাসবাদীদের আমরা উপড়ে ফেলতে চাই।’’
কাশ্মীর নিয়ে শাহকে পর পর দু’দিন বৈঠক করতে এ যাবৎ কালের মধ্যে দেখা যায়নি। সূত্রের খবর, ‘কাশ্মীর সংহতি দিবস’-এর অনুষ্ঠানে হামাস নেতাদের আসার বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করেছেন তিনি। বৈঠকে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব গোবিন্দ মোহন, ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর অধিকর্তা তপন ডেকা, জম্মু-কাশ্মীরের ডিজ়িপি নলিন প্রভাত এবং সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী।
প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে জঙ্গি সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করতে দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতকে চাপ দিয়ে চলেছে ইজ়রায়েল। তেল আভিভের সেই ডাকে এখনও সাড়া দেয়নি নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ‘কাশ্মীর সংহতি দিবসে’ সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের জইশ ও লস্কর নেতাদের সঙ্গে মোলাকাত সেই নীতিতে বদল আনতে পারে।
জন্মলগ্ন থেকেই প্যালেস্টাইনকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে পাকিস্তান। ইজ়রায়েলকে এখনও পর্যন্ত কোনও দেশ হিসাবে মান্যতাই দেয়নি ইসলামাবাদ। অন্য দিকে পশ্চিম এশিয়ার সমস্যা সমাধানে দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বে জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইজ়রায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক বেশি মজবুত হয়েছে। এ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইহুদিভূমি সফর করেছেন। সংসদে তেল আভিভের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা শোনা গিয়েছে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের গলাতেও।
সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়ে গাজ়াবাসী প্যালেস্টাইনিদের প্রতি সহাভূতিশীল মন্তব্য করেন অল ইন্ডিয়া মজ়লিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইআইএম) নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি বলেন, ‘‘এঁদের জন্য ভারতের দরজা উন্মুক্ত করুক সরকার। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলিতে প্যালেস্টাইনিদের যোগ দেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।’’
পিওকেতে জইশ ও লস্কর জঙ্গিদের সঙ্গে হামাস নেতার এক মঞ্চে থাকার ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় ওই মন্তব্যের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ওয়াইসি। প্রসঙ্গত, দীর্ঘ দিন ধরেই গাজ়ায় ‘মানবিক সাহায্য’ পাঠিয়ে চলেছে নয়াদিল্লি। ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের সময়েও তা বন্ধ করেনি কেন্দ্র।
চলতি মাসে আমেরিকা সফরে গিয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। এর পরই গাজ়া নিয়ে বিস্ফোরক ঘোষণা করেছেন আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট।
রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ঐহিত্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘গাজ়া পুরোপুরি কব্জা করবে আমেরিকা। ওই এলাকার পুনর্গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।’’ আর তাই আপাতত প্যালেস্টাইনিদের প্রতিবেশী জর্ডন বা মিশরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে গাজ়ায় লাগাতার বিমান হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স। ফলে ভূমধ্যসাগরের কোলের লম্বাটে ভূখণ্ডটি বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এর পুনর্গঠনে ওয়াশিংটন এবং তেল আভিভ ভারতকে পাশে চাইতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।