পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার বদলা নিতে ক্রমেই ধৈর্য হারাচ্ছে আমজনতা। অন্য দিকে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে জল-স্থল-বিমানবাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছে নয়াদিল্লি। পাকিস্তানে ঢুকে ফৌজি অভিযান চালাতে কেন এত সময় নিচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার? বিশ্লেষকদের একাংশ এর জন্য দায়ী করেছে বিশ্বের অন্যতম ‘সুপার পাওয়ার’কে। দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের বৈশরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের গুলিতে ২৬ জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই ঘটনার নিন্দা করে বিবৃতি দেয় আমেরিকা। জঙ্গি হামলার পর থেকেই পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চড়তে থাকে উত্তেজনার পারদ। তাতে অবশ্য কোনও পক্ষকে সমর্থন করেনি ওয়াশিংটন। উল্টে সংঘাত এড়াতে সংযত হওয়ার বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।
১ মে ফক্স নিউজ়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে মুখ খোলেন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। ভারত যে পহেলগাঁও নাশকতার ‘জবাব’ দেবে, সেখানে তা স্পষ্ট করে দেন তিনি। কিন্তু সেই সঙ্গেই নয়াদিল্লিকে ‘বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাত’ এড়ানোর বার্তাও দেন ভান্স। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তাঁর ভারত সফর চলাকালীনই বৈশরন উপত্যকায় নরহত্যার ঘটনা ঘটায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা।
ফক্স নিউজ়ের সাক্ষাৎকারে ভান্স বলেন, ‘‘আমাদের আশা, ভারত এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাব এমন ভাবে দেবে, যাতে বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের সৃষ্টি না হয়।’’ শুধু তা-ই নয়, পহেলগাঁও কাণ্ডের জন্য ইসলামাবাদকে সরাসরি দায়ী করেননি তিনি। তবে পাকিস্তানের মাটিতে জঙ্গিদের তৎপরতার অভিযোগ কার্যত মেনে নিয়েছেন।
ওই সাক্ষাৎকারে ইসলামাবাদকে একটি বিশেষ বার্তা দেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভান্স বলেন, ‘‘আমরা আশা করি, দায়বদ্ধ পাকিস্তানের সহযোগিতা পাবে ভারত। তাদের মাটিতে সক্রিয় সন্ত্রাসবাদীদের খুঁজে বার করে মোকাবিলায় সাহায্য করবে।’’ তাঁর এই মন্তব্যে আমেরিকার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রত্যাঘাতের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সময় নেওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ঐতিহাসিক ভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে অবশ্য ইসলামাবাদের ‘চিন প্রেম’ তাতে কিছুটা চিড় ধরিয়েছে। কূটনীতিকদের একাংশ মনে করেন, আমেরিকা জানে পহেলগাঁওয়ের ঘটনাকে নিয়ে সরাসরি ভারতের পক্ষ নিলে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ আরও বেশি করে চিনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। শুল্কযুদ্ধের মধ্যে সেই ঝুঁকি নিতে চাইছে না ওয়াশিংটন।
আর এখানেই নয়াদিল্লির মনে রয়েছে খটকা। পাকিস্তানকে ‘শিক্ষা’ দিতে আমেরিকাকে সঙ্গে নিয়ে চলার পক্ষপাতী কেন্দ্রের মোদী সরকার। কারণ, ইতিমধ্যেই যুদ্ধের জিগির তুলেছে ইসলামাবাদ। ফলে পহেলগাঁওয়ের প্রতিশোধকে কেন্দ্র করে দুই দেশের পুরোদস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই। আর তখন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে ইউ টার্ন নিলে বিপদে পড়বে নয়াদিল্লি, মত কূটনীতিকদের।
অতীতে যত বার লড়াইয়ের ময়দানে মুখোমুখি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান, প্রতিটা ক্ষেত্রেই রাশিয়ার ‘নিরঙ্কুশ’ সমর্থন পেয়েছে নয়াদিল্লি। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। গত তিন বছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় কিছুটা শক্তিক্ষয় হয়েছে মস্কোর। ফলে হাতিয়ার পাঠিয়ে ক্রেমলিন যে ভারতকে সাহায্য করতে পারবে, এমনটা নয়। যদিও জঙ্গি হামলার নিন্দা করে ইতিমধ্যেই মোদী সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
জেডি ভান্সের আগে ৩০ এপ্রিল রাতে ফোনে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিও। ওই সময়ে দুই দেশকেই সংঘাতমূলক পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন তিনি। পহেলগাঁও কাণ্ডের জন্য সরাসরি ইসলামাবাদকে দায়ী করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশসচিব। ফলে তখন থেকেই মেপে পা ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে এই ইস্যুতে কথা বলেছেন মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ। রাজনাথকে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, নয়াদিল্লির ‘আত্মরক্ষার অধিকার’কে সমর্থন করলেও সংঘাতের এই আবহে ‘নিরপেক্ষ অবস্থান’ নেবে ট্রাম্প সরকার। প্রায় একই সুর শোনা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের গলায়ও।
গত ২৬ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ব্যাপারে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেন। পহেলগাঁও-পরবর্তী পর্যায়ে ভারত-পাক সীমান্ত এবং জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এলওসি) উত্তেজনা তাঁর কাছে অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত এবং পাকিস্তান কোনও না কোনও ভাবে বিষয়টির সমাধান করবে, তা আমি নিশ্চিত।’’
পাশাপাশি, মোদী ও শাহবাজ়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের কথাও জানাতে ভোলেননি ট্রাম্প। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘দুই নেতাকেই আমি দীর্ঘ দিন ধরে চিনি। আপনারা জানেন, আমি ভারতের খুব কাছের। আমি পাকিস্তানেরও খুব কাছের।’’
আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন পাওয়া না গেলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। ইসলামাবাদের উপর আর্থিক চাপ বৃদ্ধি করতে নয়াদিল্লি সক্রিয় হয়েছে বলে বেশ কিছু রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে। এতে শাহবাজ় সরকারের বিপদ বাড়বে বলেই মনে করছেন কূটনীতিকেরা।
দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান বিভিন্ন সময়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য বা ঋণ পেয়ে থাকে। ভারতের অভিযোগ, সেই অর্থ দেশের উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে সন্ত্রাসবাদের পিছনে ব্যয় করে ইসলামাবাদ। পহেলগাঁও-পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও এক বার জোরালো ভাবে তুলতে চাইছে নয়াদিল্লি, খবর সূত্রের।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যাপারে দ্বিমুখী পন্থা অবলম্বন করার পরিকল্পনা রয়েছে মোদী সরকারের। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারে (ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) পাকিস্তান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করবে ভারত। এই সংস্থার থেকে ইসলামাবাদের ৭০০ কোটি ডলার (প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা) অর্থসাহায্য পাওয়ার কথা। গত বছরের জুলাই মাসে তিন বছরের জন্য এই সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
ভারতের অভিযোগ, আইএমএফের অর্থের অপব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদকে মদত দিয়েছে পাকিস্তান। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নয়াদিল্লি চাপ তৈরি করলে বাকি টাকা পেতে সমস্যায় পড়বে ইসলামাবাদ। দ্বিতীয়ত, ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) ধূসর তালিকায় (গ্রে লিস্ট) পাকিস্তানের নাম পুনরায় যোগ করার মরিয়া চেষ্টা চালাতে পারে নয়াদিল্লি।
এফএটিএফের ধূসর তালিকায় গেলে পাকিস্তানের উপর বৃদ্ধি পাবে আন্তর্জাতিক নজরদারি। পাশাপাশি, বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বা আর্থিক সাহায্য পাওয়া জটিল হবে ইসলামাবাদের পক্ষে। অতীতে বেশ কয়েক বার এফএটিএফের ধূসর তালিকায় নাম ছিল পাকিস্তানের। ২০২২ সালে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে শাহবাজ় শরিফ সরকার।
পহেলগাঁও কাণ্ডের পর ভারত-পাক সম্পর্কের অবনতি অবশ্য অব্যাহত রয়েছে। বন্ধ হয়েছে দুই দেশের বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং আকাশসীমা। পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। নদীর জল বন্ধ হলে তাকে যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েছে শরিফ সরকার।
এ ছাড়া ভারতকে পরমাণু হামলার হুমকিও দিয়েছেন পাকিস্তানের একাধিক নেতা-মন্ত্রী। পাশাপাশি, নিয়ন্ত্রণরেখায় লাগাতার গুলিবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদের ফৌজ। সেখানে অবশ্য পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতীয় সেনা। তবে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে ভারত আক্রমণ চালাবে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা অবশ্য মনে করেন, আমেরিকা ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিলেও পাকিস্তানকে চরম শাস্তি দেবে কেন্দ্র। এর দায়িত্ব অবশ্য জল, স্থল এবং বায়ুসেনার উপরেই ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ফৌজি অভিযানের পর ‘আত্মরক্ষার্থে’ সেটা করা হয়েছে বলে আমেরিকার সামনে যুক্তি সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়ায়, সেটাই এখন দেখার।