চরম আবহাওয়া, শুষ্ক পরিবেশ, যে দিকে চোখ যায় ধু-ধু প্রান্তর। নেই সবুজের চিহ্ন। চাষবাষের হালও তথৈবচ। সামান্য পশুখাদ্য জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় পালকদের। কড়া রোদ আর নোনা জল ছাড়া কিছুই মেলে না। চারদিকে শুধু ধু-ধু করা প্রান্তর। শুধু বালিময় পাথুরে জমি। দূরদূরান্তে তাকালেও জলের হদিস পাওয়া দুষ্কর। সেই ঊষর মরু, শুষ্ক বা আধা শুষ্ক অঞ্চলগুলিতে সবুজের ছোঁয়া লাগতে চলেছে শীঘ্রই।
নামমাত্র বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা কম থাকার কারণে শুষ্ক জীবন ধারণ করা এক সংগ্রামেরই নামান্তর। কৃষিকাজ ভাল করা যায় না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের পশুপালনের উপরই নির্ভর করতে হয় বছরভর। প্রতিটি পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বলে ধরা হয় গবাদি পশুদের।
আর গবাদি পশু পালন করার জন্য যে পরিমাণ খাদ্য প্রয়োজন সেটুকু জোগাড় করতে কালঘাম ছুটে যায় মরুভূমি এলাকার বাসিন্দাদের। বছরে এক বার যে এক-আধ ফোঁটা বৃষ্টি হয় তাতে সারা বছরের পশুখাদ্যের জোগান রাখা সম্ভব হয় না। অথচ জীবিকার জন্য পশুপালন ও দুগ্ধ উৎপাদনের হার বজায় রাখাটা আবশ্যিক।
পশুখাদ্যের অভাব মেটাতে তাই ‘সবুজ সোনা’ ফলাতে আগ্রহী হয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। কৃষি কল্যাণ ও উন্নয়ন বিভাগের পরামর্শে শুষ্ক ও পাথুরে জমিকে সবুজে মুড়িয়ে ফেলতে চাইছেন স্থানীয় পশুপালক ও পশুপালন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা।
কাঁটাবিহীন ক্যাকটাস। ভারতের অনুর্বর জমিগুলিতে বেছে বেছে চাষ করা হচ্ছে এই ক্যাকটাসগুলিকে। উদ্দেশ্যে, এই অঞ্চলের অধিবাসীদের পশুখাদ্যের সমস্যার সুরাহা করা, যাতে পশুপালনভিত্তিক পরিবারগুলিকে টিকিয়ে রাখা যায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সচল থাকে।
মধ্যপ্রদেশের সেওপুর জেলার আমালাহারে বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে একটি প্রকল্পের সূচনা করেছে ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইন ড্রাই এরিয়াস’ বা আইসিএআরডিএ। উদ্ভিদ সুরক্ষা এবং জেনেটিক উদ্ভাবনের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ নেহা তিওয়ারি জানিয়েছেন ভারতের শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডহীন ক্যাকটাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।
কৃষকদের মাঠে বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস পর্যবেক্ষণ করার এবং এর রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার সম্পর্কিত কৌশল শেখার সুযোগ করে দিয়েছেন আইসিএআরডিএ-র কৃষিবিজ্ঞানীরা। কৃষকেরাও প্রায় নিখরচায় নতুন ধরনের ফসল ফলাবার দিকে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কারণ তাঁরা বুঝতে পারছেন খরা বা অনাবৃষ্টির সময় তাঁদের পশুপালন টিকিয়ে রাখতে আগামী দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে এই ‘সবুজ সোনা’।
মূলত পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হলেও, এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেক বেশি। ভারতের শুষ্ক অঞ্চলে, বিশেষ করে গুজরাত ও রাজস্থানের থর মরুভূমিতে এর চাষ করা হয়। এ বার মধ্য ভারতের একটি আধা-শুষ্ক অঞ্চল বুন্দেলখন্ডেও এই ক্যাকটাসটিকে রোপন করার কাজ চলছে।
ওপুন্তিয়া প্রজাতির ‘প্রিকলি পিয়ার’ নামে পরিচিত এই কাঁটাবিহীন গাছটিকে ক্যাকটাস গোত্রের রানি বলে ধরা হয়। কম আর্দ্রতাযুক্ত বা শুষ্ক অঞ্চলের কঠোর জলবায়ুতেও বেড়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে এই ক্যাকটাসটির। এই প্রজাতিটি একটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী ফসল যা শুষ্ক এবং ক্ষয়প্রাপ্ত জমিতে কম বৃষ্টিপাত বা অল্প সেচের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেতে সক্ষম।
শুষ্ক মরসুমে বা খরার সময় যখন খাদ্যের সংস্থান কম থাকে, তখন গবাদি পশুদের জন্য সবুজ খাদ্যের বিকল্প হিসেবে বিশেষ ভাবে কাজে আসবে এই ক্যাকটাসটি। এর গায়ে কোনও কাঁটা না থাকার জন্য খাদ্য হিসাবে এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফসল ফলাবার জন্য বিশেষ কোনও খরচ নেই। শুধুমাত্র বিশেষ কয়েক প্রজাতির বীজ কিনে রোপণ করার সময়টুকু দিতে হবে কৃষকদের।
ক্যাকটাসের নিষ্কণ্টক এই প্রজাতিটি শুধুমাত্র পশুখাদ্য হিসাবে নয়, এর আরও ব্যবহারিক গুরুত্বের কথা কৃষকদের কাছে তুলে ধরেছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা। পশুর খাবার ছাড়াও বায়ো গ্যাস এবং জৈবসার ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে এই উদ্ভিদটির জুড়ি মেলা ভার।
এ ছাড়াও প্রাণিজ চামড়া বা প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে মুক্ত করার জন্য ‘ভেগান লেদার’ বা জৈব চামড়ার ব্যবহার বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে গোটা পৃথিবী জুড়েই। সেই ‘ভেগান লেদার’ তৈরির প্রধান কাঁচামালই হল এই ‘প্রিকলি পিয়ার’।
সম্প্রতি ক্যাকটাস থেকে জৈব চামড়া তৈরির জন্য একটি কর্মসূচি শুরু করেছে আইসিএআরডিএ। কেরলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারডিসিপ্লিনারি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রাথমিক পরীক্ষায় আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাওয়া গেছে। ৩ কেজি ক্যাকটাস থেকে ৩.৩৮ বর্গফুট জৈব চামড়া তৈরি করা সম্ভব। তার থেকে ২ জোড়া জুতো, ৩টি ছোট আকারের ব্যাগ তৈরি করা যেতে পারে।
ঘড়ি, ব্যাগ, জুতো থেকে শুরু করে বিলাসবহুল গাড়ির সিট কভারিং এবং আসবাবপত্র তৈরিতেও চাহিদা বাড়ছে জৈব চামড়ার। শুধু কাণ্ডের ছাল নয়, ক্যাকটাসের ফল পাকলে তার বাণিজ্যিক লাভও যথেষ্ট। আইসিএআরডিএ-র মতে, উদ্ভিদটি ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে।
এক জন কৃষক প্রতি বর্গমিটারে এই ক্যাকটাসটি চাষ করে ৬০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। খরচের তুলনায় তিন গুণ লাভ হয় তাতে।