কথায় আছে, যেমন বুনো ওল, তেমনই বাঘা তেঁতুল! এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়া ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। ইহুদিদের বিমান হামলায় মোটেই হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই তেহরান। উল্টে তাদের ছোড়া হাইপারসনিক (যা শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজ়রায়েলের একাধিক ইমারত। শুধু তা-ই নয়, ইহুদিদের জগদ্বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সদর দফতরেও আছড়ে পড়ে সাবেক পারস্য দেশের ক্ষেপণাস্ত্র। একে ইজ়রায়েলের ‘পাঁজরে আঘাত’ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
ইহুদিদের আর্থিক রাজধানী তেল আভিভের হার্জলিয়ায় রয়েছে মোসাদের সদর দফতর। চলতি বছরের ১৭ জুন সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরানি আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর ভিডিয়োও প্রকাশ করে তেহরান। সেখানে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থার সদর দফতরকে বিধ্বংসী আগুনে পুড়তে দেখা গিয়েছে। ওই দফতর থেকে গলগল করে বার হচ্ছিল ধোঁয়া। শিয়া ফৌজের দাবি, তাঁদের ক্ষেপণাস্ত্র ইহুদি গুপ্তচর সংস্থার বেশ কয়েক জন শীর্ষ আধিকারিকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
মোসাদের সদর দফতরে হামলার পর বিবৃতি দেন ইরানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মুখপাত্র রেজা তালাই-নিক। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘আমরা যে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছি, তা চিহ্নিতই করতে পারেনি ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স)। সেই কারণে সমস্ত সুরক্ষার জাল কেটে নিখুঁত নিশানায় লক্ষ্যে আঘাত করা গিয়েছে। ইহুদিদের দুর্বলতা ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে।’’ মোসাদের পাশাপাশি ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের গোয়েন্দা বিভাগ আমনের একটি কার্যালয় শিয়া সেনার ক্ষেপণাস্ত্রের শিকার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সংঘাতের মধ্যে মোসাদ এবং আমনের দফতরে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঘোরাতে পারে যুদ্ধের মোড়। এই দুই সংস্থাকে ইহুদি বাহিনীর চোখ ও কান বললে অত্যুক্তি হবে না। শিয়া ফৌজের এক আঘাতে সেটা ভেঙে পড়লে সাবেক পারস্য দেশে তাঁদের পক্ষে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ চালানো কঠিন হবে। উল্টে রণক্ষেত্রে ভারী লোকসানের মুখে পড়তে হতে পারে আইডিএফ এবং ইজ়রায়েলি বায়ুসেনাকে। কারণ বেছে বেছে ইহুদি-শত্রুদের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে মোসাদ ও আমনের জুড়ি মেলা ভার।
ইরানি গণমাধ্যমগুলির দাবি, মোসাদের যে দফতরে হামলা চালানো হয়েছে, সেখানে রাত-দিন খুনের পরিকল্পনায় মেতে থাকতেন ইহুদি গুপ্তচরেরা। এ ছাড়া যুদ্ধের মধ্যে কঠিন অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জড়ো করেছিল আমন। সেই লজিস্টিক হাব শিয়া-ক্ষেপণাস্ত্রে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে দুনিয়ার যাবতীয় গুপ্তচর সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান হল আমন এবং মোসাদ। আর তাই তেহরানের এই সাফল্যকে বড় করে দেখা হচ্ছে।
১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে জন্ম হয় মোসাদের। তার পর থেকে একাধিক দুঃসাহসিক অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে ইহুদিদের এই গুপ্তচর সংস্থা। অন্য দিকে, ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত আমনের মূল কাজ হল যুদ্ধের সময় কৌশলগত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সরবরাহ। ইলেকট্রনিক্স নজরদারি, কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ এবং সাইবার যুদ্ধে এই দুই সংস্থা বেশ পটু। গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী গাজ়ার হামাস এবং লেবাননের হিজ়বুল্লার একাধিক শীর্ষনেতাকে নিকেশ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আমন এবং মোসাদের।
গত ১৩ জুন ইরানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ নাম দিয়ে সেনা অভিযানে নামে ইজ়রায়েল। প্রথম দিনে ইহুদিদের সাফল্য ছিল নজরকাড়া। সাবেক পারস্য মুলুকের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায় তাদের বায়ুসেনা। ড্রোন আক্রমণে কেঁপে ওঠে তেহরান। পরে জানা যায়, চোরাপথে মানববিহীন উড়ুক্কু যানের যন্ত্রাংশ ইরানে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে হাত ছিল মোসাদের। ইহুদি গুপ্তচরেরা শিয়া মুলুকে বসে সেগুলি দিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনেছেন। ফলে যথেষ্ট লোকসান হয়েছে ইরানের।
‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’-এর প্রথম দিনেই আইআরজিসির শীর্ষস্থানীয় একগুচ্ছ সেনা অফিসারকে হারিয়ে যথেষ্ট বেকায়দায় পড়ে ইরান। পাশাপাশি, ওই হামলায় প্রাণ গিয়েছে অন্তত ছ’জন পরমাণু বিজ্ঞানীর। তেহরানের গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধের শুরুতে এ ভাবে বেছে বেছে খুনের ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী ছিল মোসাদ। আর তাতে সাফল্যও পান ইহুদি গুপ্তচরেরা। সেই কারণে ইজ়রায়েলকে পুরোপুরি ‘অন্ধ’ করে ফেলতে তেল আভিভের ওই সদর দফতরে হামলার পাল্টা পরিকল্পনা করে আইআরজিসি।
ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা বলে ধরা হয়। সেই বর্ম কী ভাবে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ভেদ করল, ইতিমধ্যেই তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, দ্বিমুখী পরিকল্পনার উপর ভর করে এতে সাফল্য পেয়েছে তেহরান। প্রথমত, ইহুদিদের শহরগুলিকে নিশানা করতে বর্তমানে শুধুমাত্র দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে আইআরজিসি। গতির কারণেই সেগুলিকে চিহ্নিত করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে ইহুদিদের এয়ার ডিফেন্স।
দ্বিতীয়ত, রাতের বেলা আক্রমণ চালিয়ে কিছুতেই সাফল্য পাচ্ছিল না শিয়া ফৌজ। তাই পরিকল্পনা বদলে রাতের পাশাপাশি দিনের বেলাতেও ইহুদিভূমিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে বেশি সফল হয়েছে তারা। এই পরিস্থিতিতে বর্তমানে খুঁজে খুঁজে আইআরজিসির ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চারগুলি ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। সাবেক পারস্য দেশের সেনাবাহিনী সেগুলিকে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে লুকিয়ে রাখছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
গত ১৯ জুন ‘ক্লাস্টার বোমা’য় ইজ়রায়েলি শহরে হামলা চালায় তেহরান। তেল আভিভের আজ়োর শহরতলিতে ওই বোমা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে। ‘ক্লাস্টার বোমা’র মাধ্যমে কোনও একটি জায়গায় নয়, একসঙ্গে একাধিক জায়গায় আক্রমণ শানানো সম্ভব। এতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তুলনামূলক ভাবে বেশি। ইরানের পদক্ষেপে তাই উদ্বেগ বেড়েছে। অন্য দিকে, আমজনতার নিরাপত্তায় বিশেষ সতর্কবার্তা জারি করেছে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।
ইংরেজিতে ‘ক্লাস্টার’ শব্দের অর্থ ‘একগুচ্ছ’। ক্লাস্টার বোমার মধ্যে থাকে একগুচ্ছ ছোট ছোট বোমা। ছোট, কিন্তু শক্তিশালী। একটি বড় ক্ষেপণাস্ত্রের মোড়কে ওই ছোট বোমাগুলি ভরা থাকে। উৎক্ষেপণের পর শূন্যেই খুলে যায় ক্লাস্টার বোমার অস্ত্র-মুখ। ভিতর থেকে ছোট ছোট বোমাগুলি বেরিয়ে আসে এবং বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই কারণে সংশ্লিষ্ট বোমাটি নিয়ে ইহুদিভূমিতে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
ইরানের ‘ক্লাস্টার বোমা’র হামলা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিবৃতি দিয়েছে আইডিএফ। সেখানে বলা হয়েছে, মাটি থেকে সাত কিলোমিটার উচ্চতায় তেহরানের অস্ত্রের মুখ খুলে গিয়েছিল। তা থেকে বেরিয়ে আসে অন্তত ২০টি বোমা। সেগুলি মধ্য ইজ়রায়েলের বিভিন্ন জায়গায় আট কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ‘ক্লাস্টার বোমা’র আরও একটি বিশেষত্ব হল, এগুলি স্বচালিত নয়। ছোট বোমাগুলির কোনও কোনওটি মাটিতে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ফাটে না।
সাধারণত কোনও কিছুর সংস্পর্শে এলে তবেই ‘ক্লাস্টার বোমা’য় ঘটে বিস্ফোরণ। অর্থাৎ, জনবহুল এলাকা না হলে এবং কিছুর সংস্পর্শে না এলে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত এই বোমা সক্রিয় থেকে যেতে পারে। বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে ‘ক্লাস্টার বোমা’র। এক বার ছোড়া হলে কোথায় পড়ছে, তাতে কার ক্ষতি হচ্ছে, তা আর নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় নেই। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এই ‘ক্লাস্টার বোমা’।
এ-হেন পরিস্থিতিতে ‘অবাধ্য’ ইরানকে শিক্ষা দিতে ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে আমেরিকা। ইতিমধ্যে সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের এ ব্যাপারে বেশ অনীহা রয়েছে। ওয়াশিংটন জানিয়েছে, এ ব্যাপারে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে আমেরিকা পাশে না-থাকলেও ইহুদিরা যে সংঘাত থেকে পিছিয়ে আসবে না, তা একরকম স্পষ্ট করে দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
অন্য দিকে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে আমেরিকার ‘নাক গলানো’ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জ়াখারোভার কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ করলে পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর। সেটা অকল্পনীয় এবং নেতিবাচকও হতে পারে।’’ ক্রেমলিনের এই হুমকি অবশ্য সে ভাবে গায়ে মাখেননি ট্রাম্প। পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন ঘাঁটিতে মোতায়েন থাকা মার্কিন বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার একাধিক গণমাধ্যম।
দীর্ঘ দিন ধরেই পরমাণু হাতিয়ার তৈরির চেষ্টা করছে ইরান। এতে প্রবল আপত্তি রয়েছে ইজ়রায়েলের। কারণ, ইহুদিভূমিকে এখনও দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি তেহরান। উল্টে তাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার হুমকি দিতে বহু বার শোনা গিয়েছে শিয়া ধর্মগুরু তথা ইরানের ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের গলায়। সেই কারণে সাবেক পারস্য দেশের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। কোনও ভাবেই যাতে শিয়া ফৌজের হাতে আণবিক অস্ত্র না পৌঁছোয়, সেটাই তাদের লক্ষ্য।
বর্তমানে ইরানে কুর্সি বদল করতে চাইছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তাঁর নির্দেশে আলি খামেনেইকে নিকেশ করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী। পাল্টা ইজ়রায়েলি আক্রমণ ঠেকাতে প্রত্যাঘাত চালাচ্ছে আইআরজিসি, যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস ৩’। সুরক্ষার কথা ভেবে বছর ৮৬-র আলি খামেনেইকে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। সেখানে তাঁকে হত্যা করতে আমেরিকার কাছে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা চেয়েছে আইডিএফ।
ইরানের পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠা আটকাতে তৎপর আমেরিকাও। কারণ, তেহরানের চোখে যুক্তরাষ্ট্র ‘দ্বিতীয় শয়তান’। ইহুদি ও মার্কিন জোট খামেনেইকে খতম করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে চলছে চর্চা। শিয়া ফৌজের মোসাদ ও আমানের সদর দফতরে হামলার পর সেটা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, ওই আক্রমণের পর আর কোনও গুপ্তহত্যা করতে পারেনি ইজ়রায়েল। যদিও মোসাদ ও আমান দফতরের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার।