পশ্চিম এশিয়ায় ভয়াবহ আকার নিচ্ছে যুদ্ধ। ইজ়রায়েলি বিমান হামলায় তছনছ হয়ে গিয়েছে ইরানের রাজধানী তেহরান-সহ একাধিক শহর। পাল্টা ‘হাইপারসনিক’ (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রে ইহুদি ভূমির একাংশ জ্বালিয়ে দিয়েছে সাবেক পারস্য মুলুকের শিয়া ফৌজ। এই আবহে একে অপরের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারগুলিকে নিশানা করায় সংঘাত ‘লাল-রেখা’ অতিক্রম করল বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। এর আঁচ যে ভারত-সহ গোটা বিশ্বের জ্বালানির দামে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
গত ১৪ জুন ইরানের গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটে হামলা চালায় ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। ইহুদিদের ওই আক্রমণে সেখানে আগুন লেগে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্র সাউথ পার্সের উৎপাদন বন্ধ করে তেহরান। এ ছাড়া ফজর জাম গ্যাস প্ল্যান্ট, শাহরান তেল ডিপো, শাহর রে তেল শোধনাগার এবং তেহরানের জ্বালানি ডিপোকে ইহুদি বায়ুসেনা উড়িয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শিয়া ফৌজের পাল্টা প্রত্যাঘাতে কেঁপে ওঠে ইজ়রায়েলের একাধিক জ্বালানি ক্ষেত্র।
সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেল আভিভ, জেরুজ়ালেম এবং হাইফার মতো শহরগুলিতে ইরানি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়তেই তিনটি প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্র বন্ধ করে ইজ়রায়েল। এর মধ্যে রয়েছে শেভরন পরিচালিত লেভিয়াথান এবং এনারজিয়ানের কারিশ গ্যাস উত্তোলন এলাকা। ইহুদিভূমির তামার গ্যাস ক্ষেত্রটি অবশ্য চালু রয়েছে। তবে মোট তিনটি উৎপাদন এলাকা বন্ধ হওয়ায় ইজ়রায়েলে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমেছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।
২০১৯ সালে সৌদি আরবের আবকাইক তৈল খনি এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে। সংবাদমাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্বালানি বিশ্লেষক জর্জ লিওন বলেছেন, ‘‘ওই ঘটনার পর তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের খনিতে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় আক্রমণ। এতে বিশ্ব জুড়ে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে।’’ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা অবশ্য আরও একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, সাউথ পার্সকে নিশানা করে ইরানি সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে ইজ়রায়েল।
জনপ্রিয় মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ জ্বালানি ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান রিচার্ড ব্রোঞ্জ লিখেছেন, ‘‘শিয়া সেনার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ক্রমাগত ইহুদিদের শহর এবং বন্দরে আছড়ে পড়ছে। এতে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেটা হলে চুপ করে বসে থাকবে না তেল আভিভ। ইরানের একাধিক জ্বালানি ক্ষেত্রকে যে তাঁরা নিশানা করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সাউথ পার্স আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সেটা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার।’’
ইহুদিদের এই হুমকিতে ইরানি সেনা যে দমে গিয়েছে তা কিন্তু নয়। উল্টে তাঁদের প্রত্যাঘাত সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ইজ়রায়েলকে। ইতিমধ্যেই হাইফা বন্দরের তেলের ডিপো ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস করেছে শিয়া ফৌজ। বিশ্লেষকদের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে আগামী দিনে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি চালু রাখতে প্রাকৃতিক গ্যাসের বদলে কয়লা এবং জ্বালানি তেলের দিকে ঝুঁকতে হবে ইহুদি সরকারকে। ফলে প্রতিবেশী আরব দেশগুলির উপর তাদের নির্ভরশীলতা বাড়ল বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা অবশ্য ইজ়রায়েলের সাউথ পার্স গ্যাস ক্ষেত্রকে নিশানা করার ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, সেখান থেকে দিনে ১.২০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদন করে ইরান। সাবেক পারস্য দেশের বুশেহর প্রদেশের উপকূলবর্তী এলাকার সংশ্লিষ্ট গ্যাস ক্ষেত্রটি প্রতিবেশী কাতারের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে তেহরান। এখান থেকে ইরানের অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাহিদার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সরবরাহ হয়, যেটা প্রায় ৬৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে সংশ্লিষ্ট গ্যাস ব্যবহার করে থাকে সেখানকার সরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনকারী দেশ হল ইরান। পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটিতে বছরে গড়ে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়, যা দুনিয়ার মোট উৎপাদনের প্রায় ৬.৫ শতাংশ। ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই গ্যাস বিদেশে সে ভাবে রফতানি করতে পারে না তেহরান। পশ্চিম এশিয়ার শিয়া মুলুকটির থেকে একমাত্র তরল প্রাকৃতিক গ্যাস কেনে উত্তরের প্রতিবেশী দেশ ইরাক।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সাউথ পার্স গ্যাস ক্ষেত্রের অপর ভাগীদার কাতার কিন্তু সেখান থেকে ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে ফি বছর ৭ কোটি ৭০ লক্ষ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করে থাকে। এর জন্য শেল এবং এক্সনমোবিলের মতো বহুজাতিক জ্বালানি সংস্থার সাহায্য নিয়েছে তারা। এর জেরে ফুলেফেঁপে উঠেছে কাতারের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার। আরব মুলুকগুলির মধ্যে এই দেশটির আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রকে নিশানা করে যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ইজ়রায়েল। ইহুদি ফৌজের ধারণা এতে আর্থিক ভাবে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে পড়বে তেহরান। কিন্তু, বাস্তবে পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনীর এই আক্রমণের জেরে পশ্চিম এশিয়ার লড়াইয়ে খুলে গিয়েছে নতুন ফ্রন্ট। এই সংঘাত ধীরে ধীরে ‘জ্বালানি-যুদ্ধে’ বদলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আগামী দিনে এই লড়াইয়ে ইজ়রায়েলের পক্ষে আমেরিকার প্রবেশ ঘটলে ভয়াবহ আকার নেবে পরিস্থিতি। সে ক্ষেত্রে আরব মুলুকের অন্যান্য দেশগুলির তেলের খনিগুলিকে নিশানা করতে পারে আতঙ্কিত তেহরান। সেই তালিকায় অবশ্যই থাকবে সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত এবং কাতার। তখন বিশ্ব বাজারে নাগালের বাইরে যেতে পারে ‘তরল সোনা’র দর। গত ১৩ জুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইতিমধ্যেই যা প্রায় ১৮ শতাংশের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সংঘাত আরও তীব্র হলে পারস্য উপসাগরের হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে পারে ইরানি নৌসেনা। এই এলাকার একেবারে গা-লাগোয়া খার্গো দ্বীপে রয়েছে সাবেক পারস্য দেশের প্রধান খনিজ তেল রফতানির টার্মিনাল। অন্য দিকে, সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হল হরমুজ প্রণালী। ওই রাস্তা দিয়ে প্রতি দিন গড়ে বিশ্বের ২১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ১ কোটি ৪০ লক্ষ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহণ করা হয়। এই রাস্তা বন্ধ করতে আরব মুলুকগুলি থেকে জ্বালানি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে নয়াদিল্লিরও।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা খার্গ দ্বীপকে নিশানা করলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে পাল্টা চাপ দেওয়ার রাস্তায় হাঁটবে ইরান। ইতিমধ্যেই সেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে শিয়া নৌসেনা। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, পারস্য উপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং হরমুজ প্রণালীতে ওয়াটার মাইন বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এ ছাড়া সমু্দ্র বাণিজ্যের রাস্তা আটকানোর জন্য সাবেক পারস্য মুলুকটির হাতে রয়েছে বেশ কয়েকটি ডুবোজাহাজও।
তবে সাউথ পার্সে ইহুদি বায়ুসেনার আক্রমণের ফলে ইরানের কোনও ক্ষতি হয়নি, তা ভাবলে ভুল হবে। যুদ্ধের মধ্যেই বেশ কিছুটা জ্বালানি সঙ্কটের মুখে পড়েছে তেহরান। সেখানকার চেম্বার অফ কমার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির কারণে ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাট হচ্ছে। এর জন্য দিনে ২৫ কোটি ডলারের লোকসান হচ্ছে সাবেক পারস্য দেশের ব্যবসায়ীদের।
এই পরিস্থিতিতে ইরানকে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’-এর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা জানি, ইরানের তথাকথিত ‘শীর্ষনেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) কোথায় লুকিয়ে আছেন। খুব সহজেই তাঁকে নিশানা করতে পারি। কিন্তু, এখনই তাঁকে বার করে মারতে চাইছি না। আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র আমজনতা বা আমেরিকান সৈন্যদের উপরে গিয়ে পড়ুক, তা কখনওই কাম্য নয়।’’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই হুমকি অবশ্য গায়ে মাখেনি তেহরান।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনের তৃতীয় সপ্তাহের শেষে ইরানে আক্রমণ চালাবে আমেরিকা। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওভাল অফিসের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘সব কিছু ঠিক থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই ভাল খবর মিলবে। তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলানো হতে পারে।’’ অন্য দিকে, খামেনেইকে শেষ করতে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা চেয়েছে ইজ়রায়েল। কারণ, ইরানের ‘সর্বোচ্চ নেতা’ ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন বলে গুপ্তচর মারফত খবর পেয়েছে ইহুদি সেনা।
আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’ আবার জানিয়েছে, বর্তমানে মধ্যবর্তী রাস্তা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুদ্ধে না জড়িয়ে ইরানের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘সিএনএন’ জানিয়েছে, সম্ভাব্য বিকল্পগুলি নিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র হামলা করা মানেই যে অন্য দু’টি দেশের যুদ্ধে সম্পূর্ণ ভাবে ওয়াশিংটন হস্তক্ষেপ করছে, এমন ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, বলেছেন ওই আধিকারিক।
গত কয়েক দশক ধরে পরমাণু হাতিয়ার তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে ইরান। এই নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলের। ইহুদিরা মনে করে সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটি তৈরি হয়ে গেলেই তাঁদের উপর সেটা প্রয়োগ করবে পারস্য উপসাগরের তীরের শিয়া মুলুক। আর তাই সাপ ফণা তোলার আগেই মাথা থেঁতলে দিতে সেখানে হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। তাঁদের এই অভিযানের পোশাকি নাম, ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। বর্তমানে শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ আয়াতোল্লা আলি খামেনেইকে সরিয়ে ইরানে নতুন সরকার আনার পক্ষপাতী তেল আভিভ।
অন্য দিকে, ইহুদি ফৌজের আক্রমণ সামলে পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তায় গিয়েছে সাবেক পারস্য দেশ। এই কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে সেখানকার আধা সেনা তথা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি। তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আটকাতে পারেনি ইহুদি ফৌজ। শিয়া সেনা তাদের অভিযানের নাম রেখেছে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় ৩’। দু’পক্ষের এই লড়াইয়ে খনিজ তেল এবং গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বিপুল পরিমাণে নষ্ট হলে বিশ্ব জুড়ে দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতি এবং আর্থিক মন্দা, বলছেন বিশ্লেষকেরা।