আরব দুনিয়ায় যুদ্ধের বিউগল। মুখোমুখি লড়াইয়ের ময়দানে ‘চিরশত্রু’ ইরান ও ইজ়রায়েল। সাবেক পারস্য দেশের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করেছে ইহুদি সেনা। সেখানে ২০০ লড়াকু জেট নিয়ে হামলা চালায় তেল আভিভ। পাল্টা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ইজ়রায়েলের বিভিন্ন শহরকে নিশানা করেছে তেহরান। ইহুদিদের সেনা সদর দফতরের কাছে আগুন ঝরিয়েছে শিয়াদের মারণাস্ত্র। এই সংঘাত গোটা পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় প্রমাদ গুনছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
ইহুদি ও শিয়াদের যুদ্ধে সামরিক শক্তির বিচারে কে এগিয়ে? লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসার সম্ভাবনা কার বেশি? ইতিমধ্যেই এই সমস্ত প্রশ্নে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী রয়েছে ইরানের কাছে। তবে খুব একটা পিছিয়ে নেই ইজ়রায়েলও। ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স’-এর দেওয়া ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাবেক পারস্য দেশের তুলনায় মাত্র এক ধাপ এগিয়ে আছে ইহুদিরা। সৈন্যশক্তির নিরিখে বিশ্বের ১৪৫টি দেশের মধ্যে ১৫তম স্থানে আছে ইজ়রায়েল। ঠিক তার পরে ১৬ নম্বরে জায়গা পেয়েছে ইরান।
ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ইহুদি দেশটির জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ৯৪ লক্ষ, সেখানে শিয়া রাষ্ট্রটিতে থাকেন প্রায় ন’কোটি মানুষ। এর স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে দু’দেশের সেনাকর্মীর সংখ্যায়। ইরানে সক্রিয় সেনার সংখ্যা ছ’লক্ষ ১০ হাজার। সংরক্ষিত সেনার (রিজ়ার্ভ ফোর্স) সংখ্যা তিন লক্ষ ৫০ হাজার। আর আধা সামরিক বাহিনীতে রয়েছেন দু’লক্ষ ২০ হাজার জন। অন্য দিকে ইহুদিদের সক্রিয় সৈন্যসংখ্যা মাত্র এক লক্ষ ৭০ হাজার। তবে সংরক্ষিত সেনার (রিজ়ার্ভ ফোর্স) সংখ্যা ইরানের থেকে কিছুটা বেশি।
ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) হাতে রয়েছে ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার সংরক্ষিত সেনার একটি বাহিনী। এ ছাড়া তাদের আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য ৩৫ হাজার জন। এই সংখ্যার নিরিখে সাবেক পারস্য দেশ ইহুদিদের টেক্কা দিলেও প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে তেল আভিভ। ফৌজ এবং হাতিয়ারের জন্য ৩,০৫০ কোটি টাকা খরচ করে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। অন্য দিকে প্রতিরক্ষা খাতে ১,৫৪৫ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করেছে তেহরান। অর্থাৎ, প্রতিরক্ষা বাজেট ইরানের প্রায় দ্বিগুণ।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আকাশ-যুদ্ধে শিয়া ফৌজকে নিমেষে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে ইহুদি সেনার। কারণ সাবেক পারস্য দেশের কাছে রয়েছে ৫৫১টি সামরিক বিমান। এর মধ্যে লড়াকু জেটের সংখ্যা ১৮৮। অন্য দিকে ইজ়রায়েলের হাতে সামরিক বিমান রয়েছে ৬১১টি। আইডিএফের যুদ্ধবিমানের সংখ্যা ২৪০। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ রয়েছে তাদের কাছে। ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ৩৬টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনে ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। আরও ৭৫টির বরাত দিয়েছে তারা।
আইডিএফের বহরে মালবাহী বিমানের সংখ্যা ১৩। সেখানে ইরানি বায়ুসেনা ৮৭টি এই ধরনের বিমান ব্যবহার করে। মাঝ-আকাশে লড়াকু জেটের তেল ভরার জন্য ইহুদিদের এরিয়াল ট্যাঙ্কার আছে ১৪টি। শিয়া ফৌজ সেখানে ব্যবহার করে মাত্র ৬টি এরিয়াল ট্যাঙ্কার। হেলিকপ্টার এবং হামলাকারী কপ্টারের নিরিখেও এগিয়ে রয়েছে নেতানিয়াহুর ফৌজ। তাদের কাছে থাকা এর সংখ্যা যথাক্রমে ১৪৭ ও ৪৮। শিয়া সেনার বহরে আছে ১২৮টি হেলিকপ্টার এবং ১৩টি হামলাকারী হেলিকপ্টার।
এক হাজার ৭১৩টি ট্যাঙ্ক আছে ইরানের কাছে। ইজ়রায়েলের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি এক হাজার ৩০০। ইজ়রায়েলের থেকে সামরিক গাড়িও বেশি রয়েছে ইরানের কাছে। ৬৫ হাজার ৮২৫টি সামরিক গাড়ি রয়েছে ইরানের কাছে। ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনীতে রয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৫টি গাড়ি। এ ছাড়া ইহুদি ও শিয়া সেনার চাকাযুক্ত কামানের সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫২ এবং ৩৯২।
ইরানি স্থলসেনার হাতে থাকা চাকাবিহীন কামানের সংখ্যা ২,০৭০। এ ছাড়া ১,৫১৭টি মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে তারা। অন্য দিকে মাত্র ১৭১টি চাকাবিহীন কামান রয়েছে আইডিএফের অস্ত্রাগারে। নেতানিয়াহুর ফৌজ ১৮৩টি মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করে থাকে।
জলপথেও দু’দেশ তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক যুদ্ধজাহাজ রয়েছে ইরানের নৌবাহিনীর কাছে। ইজ়রায়েলের কাছে সব মিলিয়ে যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৬২। ইরানের কাছে ২৫টি ডুবোজাহাজ রয়েছে। ইজ়রায়েলের ভরসা মাত্র ৫টি ডুবোজাহাজ। আকাশপথে ইজ়রায়েলের সামরিক শক্তি বেশি হলেও জলপথে ইরান বেশি শক্তিশালী।
এ ছাড়া দু’পক্ষের হাতেই রয়েছে একগুচ্ছ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং আত্মঘাতী ড্রোন। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের গোড়ায় বিশ্বের ন’টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পরমাণু হাতিয়ার রয়েছে। সেই তালিকায় আছে ইজ়রায়েলের নাম। সূত্রের খবর, বর্তমানে ৯০ থেকে ৪০০টি আণবিক অস্ত্র সজ্জিত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইহুদি সেনার অস্ত্রাগারে।
ইরানি সেনার কাছে অবশ্য এখনও কোনও পরমাণু অস্ত্র নেই। কিন্তু, ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ তৈরির মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে তেহরান। সেই কারণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ শুরু করেছেন সেখানকার প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। নেতানিয়াহুর দাবি, আর কিছু দিনের মধ্যে মোট ন’টি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে তেহরান। একবার ওই মারণাস্ত্র হাতে পেলে ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চাইবে শিয়া সেনা। আর তাই সেখানকার পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করেছে আইডিএফ।
ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘাতে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিদের পাশে পেয়েছে ইরান। ইয়েমেন থেকে ইহুদি ভূমির উপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ শুরু করেছে তারা। পাল্টা হুথিদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় আইডিএফ। ইহুদি ফৌজ জানিয়েছে, হুথিদের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মুহাম্মদ আল-ঘামারিকে খতম করার লক্ষ্য রয়েছে তাদের। যদিও ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রে তাঁর কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
চলতি বছরের ১৩ জুন ইরানে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ শুরু করে ইজ়রায়েল। ইহুদি হামলায় মৃত্যু হয় ইরানি আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেন সালামি, আইআরজিসির চিফ অফ স্টাফ মহম্মদ হোসেন বাগেরি, ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম আলি রশিদ এবং রেভলিউশনারি গার্ড অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলি হাজিজ়াদের। এ ছাড়াও প্রাণ হারিয়েছেন শিয়া ফৌজের গুপ্তচর বাহিনীর উপপ্রধান গোলাম রাজা মেহরবি এবং ডেপুটি অফ অপারেশন্স মেহেদি রব্বানি।
সেনা অফিসারদের পাশাপাশি আইডিএফের আক্রমণে প্রাণ গিয়েছে ন’জন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীর। তার মধ্যে রয়েছেন সাবেক পারস্য দেশের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেউদুন আব্বাসি। শুধু তা-ই নয়, সেখানকার সর্ববৃহৎ আণবিক কেন্দ্র নাতান্জে আঘাত হানে ইহুদি ফৌজ। ফোরডোর পরমাণুকেন্দ্রেও আছড়ে পড়ে আইডিএফের ক্ষেপণাস্ত্র। শিয়া দেশটির পরমাণু সংস্থার দাবি, পাহাড়ঘেরা জায়গায় অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ইজ়রায়েলের এই হামলার পরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি)। এর ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, ‘‘ইরানের নাতান্জ পরমাণুকেন্দ্রের ভিতরে তেজস্ক্রিয় এবং রাসায়নিক দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে।’’ তবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রটির বাইরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কোনও প্রভাব পড়েনি। এ ব্যাপারে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে তেহরানও।
ইহুদিদের এই হামলার পরেই ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় ৩’ শুরু করে শিয়া সেনা। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ইজ়রায়েলের রাজধানী তেল আভিভ এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর জেরুজ়ালেমকে নিশানা করে ইরান। ডুবোজাহাজ থেকেও ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেও সেগুলিকে আটকাতে পারেনি আইডিএফ। পরে ফের তেহরানে বিমান হামলা চালায় ইহুদিরা।
ইজ়রায়েলের পাশাপাশি পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করার হুমকি দিয়েছে ইরান। এ ব্যাপারে শিয়া মুলুকটিকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘‘তেহরান যদি আমেরিকার উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তা হলে সব কিছু তছনছ করে দেওয়া হবে।’’
গত জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর থেকে পরমাণু চুক্তি করতে ইরানের উপর চাপ তৈরি করে গিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তেহরান যাতে কোনও ভাবেই আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চাইছে ওয়াশিংটন। সেই লক্ষ্যে দু’পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েক বার আলোচনাও হয়েছে। ১৫ জুন ওমানে পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু, তার আগে ইজ়রায়েলি হামলার জেরে সেই প্রক্রিয়া বিশ বাঁও জলে চলে গিয়েছে। ইরানি বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাইকে উদ্ধৃত করে শিয়া মুলুকটির সংবাদ সংস্থা তানসিম জানিয়েছে, আমেরিকা একপাক্ষিক আচরণ করছে, তাই আলোচনা অর্থহীন। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আরব দুনিয়ায় ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। এই অবস্থায় শান্তি বজায় রাখার বার্তা দিয়েছে ভারত।