এককালের ‘বন্ধু’ই আজ ভয়ঙ্কর শত্রু। একে অপরকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে তারা। ইরান-ইজ়রায়েল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, প্রথম থেকেই শিয়া-ইহুদিদের ‘মধুর প্রেমে’ মিশে ছিল সন্দেহ আর স্বার্থপরতা। সেই কারণে প্রকাশ্যে নয়, সবার অলক্ষ্যে দু’পক্ষের চলত দেখাসাক্ষাৎ। গোপনে সরবরাহ হত খনিজ তেল এবং হাতিয়ার। সময়ের চাকা ঘুরতে স্বাভাবিক ভাবেই চিড় ধরে সেই সম্পর্কে। বিচ্ছেদের পাশাপাশি জন্ম হয় চরম বৈরিতার।
১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েলের জন্মের পর বিশ্বের একমাত্র ইহুদি দেশটিকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে প্রায় সমস্ত ইসলামিক রাষ্ট্র। কিন্তু সেখানে ইরান ছিল ব্যতিক্রম। পশ্চিম এশিয়ার শিয়া মুলুকটির সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস নেহাত ছোট নয়। ওই সময় আরব রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক ছিল অস্বস্তির। ফলে সরকারি ভাবে মান্যতা না দিলেও অচিরেই ইহুদিভূমির সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলে সাবেক পারস্য দেশ। তাদের এই কূটনৈতিক চালকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করা হয়েছিল।
পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের জন্মের সময় ইরানের তখ্তে ছিলেন দেশটির শেষ রাজা শাহ মহম্মদ রেজা পহলভি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মধ্যে তখন সবেমাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’। পাশ্চাত্য সভ্যতার গোঁড়া সমর্থক হওয়ায় দেশ জুড়ে সেই হাওয়া ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন পারস্যের শাহ। ফলে আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আরব দুনিয়ায় ইহুদি দেশটিকে স্থাপন করার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় হাত ছিল ওয়াশিংটনের।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তেহরানের শাহের মার্কিন প্রীতির কারণেই ইরানকে ‘বন্ধু’ ভাবতে দেরি করেনি ইজ়রায়েল। গত শতাব্দীর ’৫০ এবং ’৬০-এর দশকে নিজেদের অস্তিত্ব মজবুত করতে অ-আরব দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে ইহুদি সরকার। তেল আভিভের এই বিদেশনীতি ‘পেরিফেরি ডকট্রিন’ নামে বিখ্যাত। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্যান-আরব জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা। সেই লক্ষ্যে ইরান, তুরস্ক এবং ইথিওপিয়াকে নিজেদের দলে টানতে অনেকটাই সক্ষম হয় ইজ়রায়েল।
১৯৫৮ সালে তৎকালীন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিঅন এক গোপন বৈঠকে তৈরি করেন ‘পেরিফেরি জোট’। সেখানে হাজির ছিলেন তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্ডেরেস। অচিরেই এই জোটে যোগ দেয় ইরান। তিন ‘বন্ধু’র মধ্যে ‘ট্রাইডেন্ট’ নামের একটি চুক্তিও হয়। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল গোয়েন্দা তথ্যের আদানপ্রদান, অস্ত্র ব্যবসা এবং অন্যান্য আর্থিক সহযোগিতা। পরবর্তী দশকগুলিতে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদকে ইরানি শাহের গোপন পুলিশ সাভাকের কাছাকাছি আসতে দেখা গিয়েছিল।
ত্রিপাক্ষিক চুক্তির উপর ভর করে এর পর তেহরানকে সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করতে থাকে তেল আভিভ। বিনিময়ে ইরান থেকে বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল পেত ইহুদিরা। ১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধের সময় ইজ়রায়েলকে বয়কট করে সমস্ত আরব দেশ। ফলে ‘তরল সোনা’ আমদানি করা ইহুদিদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ওই সময় পরিত্রাতার ভূমিকা নেয় পারস্য উপসাগরের কোলের শিয়া মুলুক। সেখান থেকে তেল আসা বন্ধ না হওয়ায় লড়াই চালিয়ে যাওয়া এবং তাতে জয় পাওয়া ইজ়রায়েলের পক্ষে সহজ হয়েছিল।
গত শতাব্দীর ’৬০-এর দশকের শেষের দিকে ইরানের পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে জড়িয়ে পড়ে ইহুদিভূমির একাধিক সংস্থা। সাবেক পারস্য দেশের কৃষি-প্রযুক্তি উন্নতির নেপথ্যেও তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি) গোপন নথি অনুযায়ী, ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সঙ্কটের পর আরব দেশগুলির উপরে নানা কারণে তেহরান যে যথেষ্ট খাপ্পা, তা আঁচ করতে ইজ়রায়েলের দেরি হয়নি। পশ্চিম এশিয়ার একাধিক দেশ তখন সোভিয়েতের সামরিক সাহায্য পাচ্ছিল।
সিআইএ-র দাবি, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক মজবুত করে তেল আভিভ। ’৬৭-র ছ’দিনের যুদ্ধে মিশরের থেকে সিনাই উপদ্বীপ ছিনিয়ে নেয় ইহুদি সেনা। ফলে সেখানকার তেলের খনি বা কুয়োগুলি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে ইজ়রায়েল। সিনাই দখলের আগে পর্যন্ত ইহুদিদের মূল তেল সরবরাহকারী দেশ ছিল ইরান। তেল আভিভ তাদের দখল করা এলাকাটি ১৯৭৫ সালে ‘পিরামিডের দেশ’কে ফিরিয়ে দেয়। ফলে ফের খনিজ তেলের জন্য তেহরানের উপর তাদের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়।
মার্কিন গুপ্তচরদের গোপন নথি অনুযায়ী, ইরানে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পর্যন্ত ইহুদিভূমির ‘তরল সোনা’র চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করত তেহরান। উল্টো দিকে শিয়া ফৌজকে বিপুল পরিমাণে অত্যাধুনিক হাতিয়ার বিক্রি করত ইজ়রায়েল। শুধু তা-ই নয়, ইরাকের কুর্দ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত দেওয়া শাহের বাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল মোসাদ। শাহের আমলে সাবেক পারস্য দেশে বসবাসকারী ইহুদির সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার। তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছিল তেহরান।
কিন্তু, ১৯৭৯ সালে ইরানে ‘ইসলামিক বিপ্লব’-এর পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। সে বছর সাবেক পারস্য দেশের কুর্সিতে বসেন শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লা রুহুল্লা খোমেইনি। ক্ষমতাচ্যুত শাহ আশ্রয় নেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায় তেহরানের বিদেশনীতি। ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে প্যালেস্টাইনকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করতে থাকে সেখানকার ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক সরকার। ফলে তেল আভিভের সঙ্গে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তারা।
‘ইসলামিক বিপ্লব’-এর পর খোমেইনির নির্দেশে তেহরানের ইজ়রায়েলি দূতাবাস বন্ধ করে সেখান থেকে কর্মীদের বহিষ্কার করে ইরান। ওই দূতাবাস প্যালেস্টাইনের হাতে তুলে দিয়েছিল তারা। এর পরেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ইহুদিরা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ বেধে গেলে তেল আভিভের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল শিয়া মুলুকটির দিকে। কারণ তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে খোমেইনির চেয়েও বিপজ্জনক বলে মনে করত মোসাদ।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ স্থায়ী হয় আট বছর। সিআইএ-র দাবি, এই পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঘুরপথে তেহরানকে হাতিয়ার জুগিয়ে গিয়েছিল তেল আভিভ। ১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর এ ব্যাপারে আমেরিকার সরকারকে একটি গোপন রিপোর্ট দেয় সিআইএ। এর শিরোনাম ছিল, ‘ইজ়রায়েল অ্যান্ড ইরান: দ্য টাইজ় দ্যাট বন্ড’। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে তেল আভিভ ও তেহরানের মধ্যে গোপন সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন মার্কিন গুপ্তচরেরা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইরানের সঙ্গে গোপন সমঝোতার নেপথ্যে ইজ়রায়েলের সুনির্দিষ্ট যুক্তি ছিল। ইহুদিরা মনে করেছিল, এর ফলে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে শান্তি স্থাপনে সক্ষম হবে তারা। পাশাপাশি, শিয়া মুলুকটির খনিজ তেল প্রচণ্ড ভাবে প্রয়োজন ছিল তাদের। কিন্তু উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন স্বার্থ ছিল অনেকটাই আলাদা। ফলে এই লক্ষ্যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় তেল আভিভ।
১৯৮৫ সালে ইজ়রায়েলের উত্তরের প্রতিবেশী লেবাননে গজিয়ে ওঠে হিজবুল্লা নামের প্যালেস্টাইনপন্থী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। ১৯৯০-এর দশকে ইয়েমেনে জন্ম হয় একই রকমের আর একটি সংগঠনের, নাম হুথি। এ ছাড়া প্যালেস্টাইনের গাজ়া ভূখণ্ডে হামাস নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। এই তিনটি সংগঠনই সুযোগ পেলেই হামলা চালায় ইহুদিভূমিতে। আর এদের সমর্থন করে ইরান। এর জেরে ইরানের সঙ্গে চরম শত্রুতায় জড়িয়ে পড়ে তেল আভিভ।
ইজ়রায়েলের অভিযোগ, প্রথম দিন থেকে এই সংগঠনগুলিকে সব রকম সাহায্য করে আসছে ইরান। তেহরানের একমাত্র উদ্দেশ্য পশ্চিম এশিয়া থেকে ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলা। এর জন্য হামাস-হিজবুল্লা-হুথিদের কাজে লাগিয়ে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সাবেক পারস্য দেশ। ইহুদিদের এই অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়। গত কয়েক বছরে বহু বারই এই তিন সংগঠনের হয়ে প্রকাশ্যে তেল আভিভকে নিশানা করতে দেখা গিয়েছে শিয়া ফৌজকে।
’৯০-এর দশকের শেষের দিকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে ইরান। তেহরানের দাবি ছিল, পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির লক্ষ্যেই এই কাজ। কিন্তু ইজ়রায়েলের অভিযোগ, আণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সাবেক পারস্য দেশের পরমাণু বিজ্ঞানীদের। কারণ ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। ২১ শতকের গোড়া থেকে এই নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সুর চড়াতে শুরু করে তেল আভিভ।
চলতি বছরের ১২ জুন ইজ়রায়েলের এই অভিযোগের সমর্থন মেনে নেওয়া হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-র (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি) বিবৃতিতে। সেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ না মেনে পরমাণু কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। গত দু’দশকের মধ্যে প্রথম বার সাবেক পারস্য দেশটি এমন কাজ করছে বলেও স্পষ্ট করে আইএইএ। সূত্রের খবর, ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণে সক্ষম হয়েছে তেহরান।
ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, খুব অল্প দিনের মধ্যেই অন্তত ন’টি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে ইরান। সেই কারণে গত ১৩ জুন শিয়া মুলুকটির বেশ কয়েকটি পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিকে নিশানা করে ইহুদিদের বিমানবাহিনী। এই অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ রেখেছে তারা। এতে সাবেক পারস্য দেশের একগুচ্ছ ফৌজি কমান্ডার এবং ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেউদুন আব্বাসি।
ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের এই আক্রমণের পর চুপ করে বসে থাকেনি ইরান। পাল্টা ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় ৩’ শুরু করেছে শিয়া ফৌজ। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্রে ইহুদিদের রাজধানী তেল আভিভ-সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিকে নিশানা করেছে তারা। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েও তা আটকাতে পারেনি ইহুদি সেনা। তেহরানের ওই প্রত্যাঘাতের পর যত সময় গড়িয়েছে ততই দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র হয়েছে সংঘাত। এই যুদ্ধ গোটা আরব দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।