ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ থামলেও ‘ডুমুরের ফুল’ ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। সংঘাত চলাকালীন তাঁকে হত্যার হুমকি দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ফলে সংঘর্ষবিরতির মধ্যে তেল আভিভের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ যে ফের তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না, এ কথা বলা কঠিন। সেই আশঙ্কা মাথায় রেখে ‘সর্বোচ্চ নেতা’র নিরাপত্তা আরও আঁটসাঁট করেছে তেহরান।
১৯৮৯ সালের ৬ অগস্ট থেকে সাবেক পারস্য দেশের শীর্ষ নেতার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন আলি খামেনেই। তেহরানে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর পর গত সাড়ে চার দশকে বেশ কয়েক বার তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করে গুপ্তঘাতকের দল। কিন্তু, প্রতি বারই অল্পের জন্য মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে শুধুমাত্র যে ইজ়রায়েল জড়িত ছিল, এমন নয়।
আলি খামেনেইয়ের উপর প্রথম প্রাণঘাতী আঘাত নেমে আসে ১৯৮১ সালের ২৭ জুন। ওই সময়ে ‘ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি’র (আইআরপি) তরুণ নেতা হিসাবে বাড়ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। তবে সরকারি ভাবে কোনও বড় পদে ছিলেন না তিনি। তাঁকে খুনের চেষ্টার এক বছর আগেই (পড়ুন ১৯৮০ সাল) ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইরান। ফলে তেহরানের অন্দরে তুঙ্গে ওঠে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
ইরাকের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীন বাহিনীর মনোবল বাড়াতে প্রায়ই রণাঙ্গনে যেতেন আলি খামেনেই। প্রাণঘাতী হামলার দিনে সেখান থেকে রাজধানী তেহরানে ফেরেন তিনি। এর পর ভাষণ দিতে সটান চলে যান আবু জার মসজিদে। সেখানে আমজনতার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। ঠিক তখনই সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে খামেনেইয়ের দিকে এগিয়ে যান এক ঘাতক। তাঁর টেবলে একটি ছোট্ট টেপ রেকর্ডার রেখে মুহূর্তে ভিড়ে মিশে যান তিনি।
এ ভাবে প্রকাশ্যে যে তাঁকে খুনের ষড়যন্ত্র হতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি খামেনেই। নির্ধারিত রীতি মতো নিজের বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। সেই সঙ্গে চালিয়ে দেন ওই টেপ রেকর্ডার। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই শব্দযন্ত্রে ঘটে বিস্ফোরণ। তাতে মারাত্মক ভাবে জখম হন আলি খামেনেই। দ্রুত তাঁকে দক্ষিণ তেহরানের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলেও ডান হাত চিরতরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাঁর। সমস্যা শুরু হয় কণ্ঠস্বরেও।
খামেনেইয়ের উপর এই হত্যার চেষ্টার তদন্তে উঠে এসেছিল একের পর এক বিস্ফোরক তথ্য। ঘটনাস্থল থেকে টেপ রেকর্ডারের দু’টি ভাঙা টুকরো উদ্ধার করেন তেহরানের গোয়েন্দারা। সেখানে লেখা ছিল, ‘ইসলামিক রিপাবলিক ইরানকে ফোরকান গ্রুপের উপহার’। তদন্তে আরও জানা যায়, উদারপন্থী রাজনৈতিক দল ‘পিপল্স মুজাহিদিন অর্গানাইজ়েশন অফ ইরান’ বা এমইকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হামলাটি চালিয়েছে শিয়াদের ওই উগ্রপন্থী সংগঠন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেনকে সমর্থন করত এই ‘ফোরকান গ্রুপ’। ইরানের ‘ইসলামীয় বিপ্লব’ একেবারে মেনে নিতে পারেনি তারা। সেই কারণে কট্টরপন্থী নেতাদের সরাতে গোপনে এমকেইর সঙ্গে হাত মেলায় সংশ্লিষ্ট সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। আলি খামেনেইকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁদের উপর দুর্ভাগ্য নেমে এসেছিল। কারণ পরবর্তী বছরগুলিতে ফোরকান ও এমকেইর বহু শীর্ষনেতাকে ফাঁসিতে ঝোলায় তেহরান।
আসলে ১৯৭৯-এর ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এ রাতারাতি পাল্টে যায় ইরান। ক্ষমতাচ্যুত হন সেখানকার শাহ (পড়ুন রাজা) মহম্মদ রেজা পেহলভি। তাঁর উপরে ছিল আমেরিকার আশীর্বাদের হাত। তড়িঘড়ি দেশ ছেড়ে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন তিনি। বিপ্লবের পর নতুন ব্যবস্থায় ‘সর্বোচ্চ নেতা’ হয়ে তেহরানে জাঁকিয়ে বসেন রুহল্লাহ মুসাভি খোমেনি। এর পর থেকে সাবেক পারস্য দেশের রাজনীতিতে বাড়তে থাকে কট্টরপন্থীদের প্রভাব।
‘ধর্মীয় বিপ্লব’-এর পর উদারপন্থী এমকেই-র নেতা আবোলহাসান বানিসদর প্রেসিডেন্ট করেন খোমেনি। ওই সময়ে আমেরিকার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক খারাপ করতে রাজি ছিলেন না তিনি। ফলে তাঁর চরম বিরোধিতা শুরু করেন কট্টরপন্থী আলি খামেনেই। ১৯৮১ সালের ২১ জুন ‘ইমপিচমেন্ট’-এর মাধ্যমে তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেয় ইরানি পার্লামেন্ট ‘ইসলামিক কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলি’। এর ঠিক ছ’দিনের মাথায় আবু জার মসজিদে ঘটে হামলার ঘটনা।
ইরানি গোয়েন্দাদের দাবি, প্রেসিডেন্ট পদ হারানোর জন্য আজীবন খামেনেইকে দায়ী করে গিয়েছেন বানিসদর। সেই রাগেই ‘ফোরকান গ্রুপ’-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন তিনি। ঘটনার পর তেহরান থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি। ২০২১ সালে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে পর্যন্ত আলি খামেনেইয়ের প্রবল সমালোচক ছিলেন এই বানিসদর।
২৭ জুন তেহরানের মসজিদে নাশকতার ঘটনায় রীতিমতো নড়ে গিয়েছিল গোটা ইরান। ঠিক এর এক দিনের মাথায় (পড়ুন ১৯৮১ সালের ২৮ জুন) খামেনেইয়ের দল ‘ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি’-র সদর দফতরে ঘটে মারাত্মক বিস্ফোরণ। তাতে প্রাণ হারান ৭০ জন। এর মধ্যে ২৭ জন ছিলেন ইরানি পার্লামেন্টের সদস্য। ওই হামলায় মৃত্যু হয় সাবেক পারস্য দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মহম্মদ হুসেন বেহেস্তির।
আইআরপির সদর দফতরে বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তে প্রকাশ্যে আসে মহম্মদ রেজা কোলাহি নামের এক ইঞ্জিনিয়ারের নাম। দীর্ঘ দিন ধরে ওই দলীয় কার্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ঘটনার পর অবশ্য নেদারল্যান্ডসে পালিয়ে যান কোলাহি। সেখানে নাম ভাঁড়িয়ে থাকছিলেন ওই ব্যক্তি। ২০১৫ সালে বাড়ির সামনে রহস্যজনক ভাবে উদ্ধার হয় তাঁর রক্তাক্ত মৃতদেহ। তবে কোলাহি খুনের দায় কখনই স্বীকার করেনি তেহরান।
আইআরপির সদর দফতরে বিস্ফোরণের ঘটনায় আঙুল ওঠে শাহ পেহলভির গুপ্তচরবাহিনী সাভাকের দিকে। ইরানি গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, আলি খামেনেইকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল তাদের। কিন্তু এক দিন আগে নাশকতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। সেই খবর অবশ্য কোলাহি জানতেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
এই ঘটনার তিন মাসের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ অগস্ট ব্রিফকেস বিস্ফোরণে প্রাণ হারান তৎকালীন ইরানি প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আলি রাজাই এবং প্রধানমন্ত্রী মহম্মজ জাভেদ বাহোনার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়তেই ঘটে ওই নাশকতার ঘটনা। সেই সময়ে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত একটি বৈঠক চলছিল। বিস্ফোরক বোঝাই ব্রিফকেসটি সেখানে রেখে এসেছিলেন মাসুদ কাশ্মিরি নামের এক যুবক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিরোধী দল এমকেইকে দায়ী করেন খামেনেই। বলেন, এর মাধ্যমে তাঁকে খুনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। যদিও পশ্চিমি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই নাশকতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল খামেনেইয়ের নিজের দল আইআরপি-র বিক্ষুব্ধ নেতারা। তবে তাঁদের নিশানায় বর্তমানের ‘সর্বোচ্চ নেতা’ ছিলেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পর পর তিনটি হামলায় প্রাণে রক্ষা পাওয়ায় ইরান জুড়ে বাড়তে থাকে খামেনেইয়ের জনপ্রিয়তা। পাশাপাশি দলের মধ্যে আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না তাঁর। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদ পান তিনি। এর চার বছরের মাথায় ফের ‘ফিঁদায়ে’ হামলায় তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন এক গুপ্তঘাতক।
১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যান খামেনেই। সেখানে ভাষণ দেওয়ার সময় আত্মঘাতী হামলায় তাঁকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে হত্যাকারী। কিন্তু, অস্বাভাবিক ভিড় থাকায় প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছতে পারেননি তিনি। ফলে আলি খামেনেইয়ের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি। তবে প্রাণ হারান সভার দর্শকাসনে থাকা বেশ কয়েকজন। এই ‘ফিঁদায়ে’ আক্রমণের জন্য ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে পুরোপুরি দায়ী করেন খামেনেই।
এই ঘটনার চার বছরের মাথায় রুহল্লাহ মুসাভি খোমেনির মৃত্যু হলে ‘সুপ্রিম লিডার’-এর পদ পান খামেনেই। গত শতাব্দীর ’৯০-এর দশকের পর তাঁর নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় ইরান সরকার। শিয়া মুলুকটির আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির কাঁধে যায় ওই গুরুত্ব। কিন্তু, তা সত্ত্বেও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের খামেনেইকে প্রাণে মারার চেষ্টা করে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।
২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে মার্কিন ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয় আইআরজিসির শীর্ষ নেতা কাসেম সুলেমানির। এই খুনের বদলা নিতে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সেনা ছাউনিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় তেহরান। পাশাপাশি, সুলেমানি প্রাণ হারানোর পর আলি খামেনেইকে গুপ্ত ঘাঁটিতে সরিয়ে নিয়ে যায় আইআরজিসি। কারণ, দেশের ‘সর্বোচ্চ নেতা’কে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইহুদি গুপ্তচরেরা নিশানা করতে পারে বলে ভয় পেয়েছিল তেহরান।
২০২০-র পর চার বছর প্রকাশ্যে আসেননি আলি খামেনেই। এর মধ্যে আইআরজিসির একটি দফতরে ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। ইরানি গোয়েন্দাদের দাবি, সেখানে খামেনেই রয়েছে ভেবে ওই আক্রমণ শানিয়েছিল মোসাদ। গত বছরের অক্টোবরে একই রকমের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তাদের।
চলতি বছরের ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন নিরাপত্তার স্বার্থে ফের খামেনেইকে সুরক্ষিত বাঙ্কারে আইআরজিসি নিয়ে গিয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। দু’পক্ষে সংঘর্ষবিরতি হলেও প্রকাশ্যে আসেননি তিনি। তাঁর দফতরের প্রধান মেহদি ফজ়ায়লি জানিয়েছেন, ‘‘সুস্থই রয়েছেন সর্বোচ্চ নেতা।’’ এই বার্তার পর ইহুদি গুপ্তচরেরা যে চুপ করে বসে থাকবেন না, তা বলাই বাহুল্য।