ইরানের পরমাণুকেন্দ্রে মার্কিন হামলার পর পশ্চিম এশিয়ায় ফিরেছে শান্তি। যুদ্ধ বন্ধ হলেও মূল প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনও অধরা। সাবেক পারস্য দেশের আণবিক বোমা তৈরির স্বপ্নকে কি চিরতরে ধূলিসাৎ করতে পেরেছে আমেরিকা? না কি বিশেষ লাভ হয়নি? গোপনে গোপনে ফের সেই কাজ শুরু করতে পারবে তেহরান? এ ব্যাপারে নিজের দেশের গোয়েন্দা রিপোর্টকেই অস্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে আমজনতার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে দেরি হয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইরান ইস্যুতে ট্রাম্প যে ভাবে গোয়েন্দা রিপোর্টকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) গ্রহণযোগ্যতা। শুধু তা-ই নয়, ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদের সঙ্গে এর তুলনা টেনে বিতর্ক তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রবাসীদেরই একাংশ। মজার বিষয় হল, ওয়াশিংটন ও তেল আভিভের মধ্যে সুদৃঢ় ‘বন্ধুত্ব’ থাকা সত্ত্বেও এই দুই সংস্থার মধ্যে সম্পর্ক যে সব সময় সরলরেখায় চলেছে এমনটা নয়।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত শতাব্দীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সঙ্গে চলা ‘ঠান্ডা লড়াই’ পর্বে সিআইএ-র যে গরিমা ছিল, কালের নিয়মে তা কিছুটা ফিকে হয়েছে। অত্যধিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থাটির সীমাবদ্ধতা সারা দুনিয়ার নজরে এসেছে। তার পরেও তাদের রিপোর্টকে খাটো করে দেখা মোটেই উচিত নয়। এ ব্যাপারে তাড়াহুড়োর মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ট্রাম্প ভুল করছেন বলে স্পষ্ট করেছেন বিশ্লেষকেরা।
১৯৬২ সালে ‘কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট’-এর সময় দেওয়া রিপোর্টকে আমেরিকার ইতিহাসে সিআইএ-র সবচেয়ে বড় সাফল্য বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ের কাছের প্রতিবেশী দেশ মস্কো যে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতে চলেছে, সময় থাকতে সেই তথ্য ফাঁস করেন মার্কিন গুপ্তচরেরা। সঙ্গে সঙ্গে নৌ অবরোধে হাভানাকে ঘিরে ধরার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি। ফলে ভেস্তে যায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যাবতীয় পরিকল্পনা।
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে মস্কো। এশিয়া জুড়ে তখন সোভিয়েত প্রভাব বাড়ছিল। রাশিয়ার সেই আগ্রাসন ঠেকাতে আসরে নামে সিআইএ। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে সক্ষম হয় তারা। দুই সংগঠনের যৌথ চেষ্টায় আম আফগানদের নিয়ে তৈরি হয় মুজাহিদিন বা ‘ধর্মযোদ্ধা’দের ফৌজ। তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয় ক্রেমলিন।
সিআইএ-র এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সাইক্লোন’। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে মস্কো। শুধু তা-ই নয়, এর দু’বছরের মাথায় (পড়ুন ১৯৯১ সালে) পুরোপুরি ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলে পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়া মিলিয়ে তৈরি হয় রাশিয়া-সহ ১৫টি স্বাধীন দেশ। অন্য দিকে, সিআইএ-র তৈরি মুজাহিদিনেরা পরবর্তী কালে ধরে সন্ত্রাসবাদের রাস্তা। ফলে নিজেদের স্বার্থে তাদের ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের রাস্তা খুলে যায় ইসলামাবাদের সামনে।
আফগান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়ায় সন্ত্রাসবাদের আগুনের আঁচ শুধুমাত্র ভারতের গায়ে লেগেছে, এমনটা নয়। এর লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে পারেনি আমেরিকাও। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিন বিমান ছিনতাই করে ‘ফিদায়েঁ’ আক্রমণ শানায় কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ‘আল কায়দা’। উড়োজাহাজের ধাক্কায় চোখের নিমেষে ভেঙে পড়ে নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের গগনচুম্বী জোড়া অট্টালিকা।
এর পাশাপাশি আল কায়দার জঙ্গিরা মার্কিন প্রতিরক্ষার সদর দফতর পেন্টাগনেও ছিনতাই করা বিমান নিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল। ৯/১১-র ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার। পরবর্তী এক দশক নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাগলের মতো এক জনকে খুঁজে বেড়িয়েছিল সিআইএ। তিনি আর কেউ নন, আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেন। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদের গোপন আস্তানায় ঢুকে তাঁকে নিকেশ করে মার্কিন কমান্ডোরা।
বিন লাদেনকে খতমের জন্য চালানো অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন নেপচুন স্পিয়ার’। তাঁর গোপন আস্তানার ঠিকানা থেকে শুরু করে অপারেশনের খুঁটিনাটির নীলনকশা তৈরিতে সবচেয়ে বড় হাত ছিল সিআইএ-র। ৯/১১-র পর লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে আফগানিস্তান আক্রমণ করে আমেরিকা। সেই যুদ্ধেও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে বড় ভূমিকা ছিল মার্কিন গুপ্তচরদের।
অন্য দিকে, ১৯৪৮ সালে জন্মের পর থেকে সব সময় ইজ়রায়েলের দিকে থেকেছে আমেরিকার সমর্থন। ফলে বহু ক্ষেত্রে ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছে সিআইএ-কে। কিন্তু, তার পরেও দুই সংগঠনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা নেহাত কম নয়। উদাহরণ হিসাবে ১৯৫৪ সালের ‘লেভন অ্যাফেয়ার্স’-এর কথা বলা যেতে পারে। এই অভিযানে ‘বন্ধু’ দেশের নাগরিকদের খুন করে নিজের অবস্থান মজবুত করতে চেয়েছিল তেল আভিভ।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন পিনহাস লেভন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ মিশরে মার্কিন এবং ব্রিটিশ নাগরিকদের হত্যা করতে মোসাদকে নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সেইমতো সিনেমাহল, পাঠাগার এবং আমেরিকান সেন্টারে বিস্ফোরণ ঘটায় ইহুদি গুপ্তচরেরা। ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব মানতে অস্বীকার করা কায়রো তখন তেল আভিভ আক্রমণের ছক কষছিল। পাশাপাশি, ইজ়রায়েলের জন্য সুয়েজ খাল বন্ধ করার পরিকল্পনাও ছিল মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের।
কায়রোর এই সিদ্ধান্তে প্রমাদ গোনেন লেভন। সুয়েজ খাল বন্ধ হলে ইহুদিভূমির অর্থনীতি যে দু’দিনে ভেঙে পড়বে, তা বুঝতে দেরি হয়নি তাঁর। আর তাই ব্রিটেন এবং মার্কিন নাগরিকদের উপর হামলা করে দুই শক্তিশালী দেশকে মিশরের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মোসাদের সেই পরিকল্পনা সিআইএ-র কাছে ফাঁস হতে বেশি দিন সময় লাগেনি। ফলে ওই ঘটনার জেরে আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের মধ্যে বেড়েছিল দূরত্ব।
১৯৮০-এর দশকে আবার সিআইএ-র গোপন তথ্য চুরির অভিযোগ ওঠে মোসাদের বিরুদ্ধে। তাতে গ্রেফতার হন জোনাথন পোলার্ড নামের মার্কিন গুপ্তচর সংস্থার এক ব্যক্তি। আমেরিকার গোয়েন্দাদের দাবি, চাকরি করার পাশাপাশি দিব্যি ইহুদি গুপ্তচরবাহিনীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করছিলেন তিনি। ইজ়রায়েল ওই সময় সন্দেহ করেছিল যে প্রয়োজনমতো তাদের সব তথ্য দিচ্ছে না আমেরিকা। সেই কারণে হাঁড়ির খবর পেতে জোনাথনকে সিআইএ-র অন্দরমহলে পাঠাতে দেরি করেনি মোসাদ।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে আমেরিকা। বাগদাদের কুর্সিতে তখন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসেন। এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে নামানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মোসাদের। সাদ্দামের বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করে ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী। রটিয়ে দেয় গণবিধ্বংসী হাতিয়ার তৈরি করছেন ইরাকি প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি কুর্দ জনজাতিভুক্তদের নৃশংস ভাবে হত্যার অভিযোগও সেখানে তোলা হয়েছিল।
মোসাদের এই রিপোর্ট বিশ্বাস করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা। নিজেদের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র কথা শুনতে চাননি তিনি। ১৯৯০ সালেই পরমাণু, রাসায়নিক এবং জৈবিক হাতিয়ার নির্মাণের কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে দেন সাদ্দাম। বিষয়টি জানার পর এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রেসিডেন্টের টেবলে পাঠায় সিআইয়ে। যুদ্ধের শেষে সাদ্দামের পতন হলে সিআইএ-র কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। ইরাকে কোথাও গণবিধ্বংসী হাতিয়ারের চিহ্ন খুঁজে পায়নি যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজ।
ইরান ইস্যুতেও কিছু ক্ষেত্রে মোসাদ এবং সিআইএ-র মধ্যে মতপার্থক্য দেখা গিয়েছে। কয়েক বছর আগে গুপ্তচর সংস্থার ফাঁস করা তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট জনসমক্ষে আনেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সিআইএ। তাঁদের বক্তব্য ছিল, ২০০৩ সালের আগের তথ্য দেখিয়ে ওই রিপোর্ট তৈরি করেছে মোসাদ। সেই কারণে পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরেরা।
সিআইএ-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলা শুরু হলে পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করে দেয় ইরান। কারণ সাদ্দামের ভয়াবহ পরিণতি দেখে ভয় পেয়েছিল তেহরান। কিন্তু পরবর্তী কালে বিদ্যুৎশক্তির চাহিদা মেটাতে ফের আণবিক শক্তি উৎপাদনে মন দেয় সাবেক পারস্য দেশ। শিয়া মুলুকটির ওই কর্মকাণ্ডকে প্রথম থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে ইজ়রায়েল। ইহুদিদের দাবি, পরমাণু বোমা তৈরির উদ্দেশ্যে এর অন্যতম উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের লাগাতার কাজ চালাচ্ছে তেহরান।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন কিন্তু সিআইএ-র উপর পুরোপুরি ভরসা রেখেছিলেন। ফলে ইজ়রায়েলের দাবি মেনে পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে জড়াননি তিনি। যদিও এ ক্ষেত্রে মোসাদের রিপোর্টকে ভুল বলা যাবে না। কারণ, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা’ বা আইএইএ (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি) জানিয়ে দেয়, নিয়ম ভেঙে পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ করছে ইরান। ফলে ইহুদিদের কাছে খুলে যায় তেহরান আক্রমণের দরজা।
ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ সেরে ফেলেছে ইরান। বোমা তৈরির জন্য অবশ্য ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে এই তেজস্ক্রিয় পদার্থকে। গত ২৪ জুন দু’পক্ষে সংঘর্ষবিরতি হলে সিআইএ জানায়, তেহরানের আণবিক কর্মসূচিকে কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে, পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি।
ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে ইজ়রায়েল এবং আমেরিকার যৌথ হামলা সত্ত্বেও সেখান থেকে কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের খবর পাওয়া যায়নি। সেই কারণে অনেকেই সিআইএ-র রিপোর্টকে সঠিক বলে মনে করছেন। অন্য দিকে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তেহরান কখনওই আণবিক বোমা তৈরি করতে পারবে না। সাবেক পারস্য মুলুকে বোমারু বিমান দিয়ে হামলার জন্য তাঁকে অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে ভোলেনি তেল আভিভ।