বিশ্বের একাংশ এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। বিগত কয়েক বছরে ইজ়রায়েল বনাম গাজ়া, ইরান বনাম ইজ়রায়েল, ইউক্রেন বনাম রাশিয়া-সহ আরও একাধিক যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী। এগুলিই কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্-পর্ব— কী বলছে ইতিহাস?
ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদেরা অনেক বছর আগেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলেছিলেন। ১৯৫০ থেকে ৬০-এর দশকের সময় থেকেই শোনা যেত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। সে সময় একদল ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদ বলতে শুরু করেন, অ্যালবার্ট পাইক নামক এক আইনজীবী ১৮৭১ সালে চিঠি লিখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলে গিয়েছেন।
অ্যালবার্ট পাইক ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। পেশায় একজন আইনজীবী, সৈনিক এবং লেখক। পাশাপাশি ইউরোপের ‘ফ্রিম্যাসন’ সংগঠনের সদস্য ছিলেন তিনি।
ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদদের দাবি, ইতালির জিয়োসেপ্পে মাজ্জিনিকে অ্যালবার্ট একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতেই নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে। যদিও আদতে তেমন কোনও চিঠির খোঁজ মেলেনি।
ইতালির ঐক্য আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন জিয়োসেপ্পে। পাইক ও জিয়োসেপ্পের মধ্যে গোপন সম্পর্ক ছিল বলেও কানাঘুষো শোনা যায়। যদিও জিয়োসেপ্পের কাছ থেকে পাইকের কোনও চিঠি পাওয়া যায়নি কখনওই। তা হলে অযথা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদদের এমন উস্কানি দেওয়ার নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ আছে কি না— এই নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
২০০ বছরের পুরনো, না-উদ্ধার হওয়া সেই চিঠিতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটার কথা নাকি লেখা হয়েছিল। ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদদের দাবি, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ধারণা আগে থেকেই ছিল পাইকের কাছে।
চিঠিতে নাকি লেখা ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার জ়ারতন্ত্র ধ্বংস করা। রাশিয়াকে কমিউনিজ়মের ঘাঁটিতে পরিণত করা। বিশ্বযুদ্ধের পর ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদদের বলা কথা অনেকাংশেই সত্যি হয়। অনেকে আবার বলেন, পাইকের কোনও ‘ভবিষ্যদ্বাণী’র জন্য এটা হয়নি। ঘটনাচক্রেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়।
আরও দাবি ছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল নাজ়িবাদ ধ্বংস করা, কমিউনিজ়মের বিস্তার ঘটানো। চিঠিতে নাকি লেখা ছিল, বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে ফ্যাসিবাদ ও জায়নিস্ট আন্দোলনের দ্বন্দ্ব থেকে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি।
এ বার আসা যাক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথায়। খাতায়কলমে যে যুদ্ধের সাক্ষী এখনও পৃথিবী হয়নি। কিন্তু পাইকের চিঠিতে নাকি সে যুদ্ধের উল্লেখও রয়েছে। চিঠি অনুযায়ী বর্তমানে যে সব যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সে সবই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্-পর্ব।
দাবি করা হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে চিঠিতে লেখা ছিল, এই যুদ্ধ হবে ইসলামিক দেশ বনাম পশ্চিমি দেশগুলির মধ্যে। যেখানে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়বে। এই যুদ্ধের কারণ হিসাবে মানুষ ধর্মকে দায়ী করবে। যুদ্ধের শেষে ‘নতুন বিশ্ব সরকার’ তৈরি হবে বলেও দাবি করেন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদেরা।
যদিও এই সব যুক্তির একটিরও প্রমাণ মেলেনি। কোনও চিঠিও পাওয়া যায়নি। ইতিহাসবিদদের মতে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদদের এটা একটা কৌশল। বড় যুদ্ধ, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার গুজব, ধর্মীয় সংঘাত— এ সবের ভয় মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে। মানুষের মনে সহজে ভয় ঢোকানোর উদ্দেশ্যে তাঁরা নিজেদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন।
ইতিহাসবিদেরা জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ বিভ্রান্ত ছিল। এত বড় ধ্বংস কেন হল— সে প্রশ্নই ঘুরছিল সকলের মনে। তারই সুযোগ নিয়েছিলেন ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদেরা। সাধারণ মানুষের কাছে এই চিঠির ঘটনা রহস্যময় হলেও অনেকে এটা বিশ্বাস করেছিলেন।
কেউ কেউ এটিকে ‘জাতীয়তাবাদী প্রচার’-এর আখ্যাও দিয়েছেন। বিশেষ করে ইউরোপে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলি বলত, তাদের জাতিকে ধ্বংস করতে বিদেশি গোপন শক্তি কাজ করছে। পাইকের নাম ব্যবহার করে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদেরা নিজেদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।
১৯২০-এর দশকে প্রথম বার চিঠির কথা প্রকাশ্যে আসে। শোনা যায়, ব্রাজ়িলিয়ান লেখক ডোমিঙ্গো ভিয়েরা প্রথম পাইক–ম্যাজিনি চিঠির গুজব ছড়ান। পরে তাঁর কথাকে স্বীকৃতি দেয় ষড়যন্ত্র-তত্ত্ববিদেরা।
চিঠি নিয়ে বেশ কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেন ইতিহাসবিদেরা। চিঠিতে ‘নাৎসিবাদ’, ‘জায়োনিজ়ম’-এর মতো কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৭১ সালে শব্দগুলি প্রচলিত ছিল না। তাই সে সময় এই শব্দ দিয়ে কোনও চিঠি লেখা সম্ভব নয়।
বর্তমানে বিশ্বের দরবারে যে যুদ্ধ চলছে তাতে আবারও পাইকের চিঠির কথা উঠে আসছে। ইজ়রায়েল-গাজ়ার যুদ্ধে সরাসরি পশ্চিমি দেশের হস্তক্ষেপ, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে রাশিয়াকে ড্রোন দিয়ে ইরানের সাহায্য— সবই নতুন করে ভাবাচ্ছে পাইকের চিঠির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু নিয়ে।