সাধারণ সৈনিক থেকে অফিসার, সবাইকে গড়গড়িয়ে বলতে হবে আরবি! সেইসঙ্গে কণ্ঠস্থ করতে হবে কোরান। ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির পর বাহিনীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করল ইজ়রায়েল। ইহুদিভূমির এ-হেন পদক্ষেপে পশ্চিম এশিয়ায় পড়ে গিয়েছে শোরগোল। এর ফলে তেল আভিভের মাথা হেঁট হয়েছে বলে উৎসবে মেতেছেন প্যালেস্টাইনপন্থীরা। যদিও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ইহুদি সরকার।
ইজ়রায়েলি গণমাধ্যম ‘গ্যালেই তাজ়াহাল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইহুদি ফৌজকে আরবি ভাষায় শিক্ষিত করে তুলতে বাহিনীর মধ্যে তৈরি হবে বিশেষ একটি বিভাগ। ভাষাবিদ প্রশিক্ষকদের নেতৃত্বে কাজ করবে সেটি। প্রাথমিক পর্যায়ে অনুবাদক এবং রেডিয়ো অপারেটরদের আরবি শেখাবেন তাঁরা। পরে গুপ্তচর ও ফৌজের গোয়েন্দাবাহিনীর সমস্ত কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ সৈনিকদের শিখতে হবে আরবি ভাষা। পাশাপাশি, কোরানও শিখে রাখবে ইহুদি ফৌজ।
নেতানিয়াহু প্রশাসন সূত্রে খবর, আগামী বছরের মধ্যে গুপ্তচর এবং গোয়েন্দাবাহিনীর ১০০ শতাংশ কর্মী যাতে আরব দুনিয়ার ইসলামীয় ধর্মীয় সংস্কৃতি ‘গুলে খেতে’ পারেন, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজে নামছে প্রতিরক্ষা দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন সংশ্লিষ্ট বিভাগ। পাশাপাশি, ৫০ শতাংশ কর্মীকে আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
একটা সময়ে ইজ়রায়েলি স্কুল-কলেজগুলিতে চালু ছিল ‘ডিপার্টমেন্ট অফ মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ় প্রমোশন’ নামের একটি বিভাগ। সেখানেও আরব দুনিয়ার অন্য দেশগুলির ভাষা এবং ইসলামীয় সংস্কৃতির শিক্ষা দেওয়া হত। কিন্তু শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস পাওয়ায় বছর ছ’য়েক আগে সেগুলি বন্ধ করে দেয় নেতানিয়াহু সরকার। কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগটিকে পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইহুদি প্রশাসন।
২০১৮ সাল নাগাদ ইজ়রায়েল জুড়ে ৮,২০০টি কেন্দ্র ছিল ‘ডিপার্টমেন্ট অফ মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ় প্রোমোশন’-এর। বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে কাজ করত সংশ্লিষ্ট বিভাগ। সেখানকার পড়ুয়ারা ‘মিডল ইস্টার্ন ক্যাডেট কোর্স’-এ পড়াশোনা করার সুযোগ পেতেন। শিখতে পারতেন আরবি সাহিত্য এবং ভাষার সুপ্রাচীন ইতিহাস।
পাশাপাশি, হুথি এবং ইরাকি উপভাষা শেখার বিশেষ কোর্স খুলছে ইজ়রায়েল। বিষয়টি নিয়ে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ রেডিয়োয় মুখ খোলেন ইহুদি গোয়েন্দাবাহিনীর এক পদস্থ আধিকারিক। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আরবি ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুব সীমিত। বর্তমান সময়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য এই জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন রয়েছে। আর তাই এই পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর প্যালেস্টাইনের গাজ়া থেকে ইজ়রায়েলে ঢুকে বড় আকারের হামলা চালায় ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। হামাসের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারান প্রায় দু’হাজার নিরীহ ইহুদি। পাশাপাশি, বহু সাধারণ ইজ়রায়েলিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইরানি মদতপুষ্ট ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত ইহুদিরা সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গাজ়ায় চলতে থাকে লাগাতার বোমাবর্ষণ। এই পরিস্থিতিতে হামাসের পাশে দাঁড়িয়ে ইজ়রায়েলকে নিশানা করে ইরানি মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের হুথি। ফলে চাপে পড়ে যায় ইহুদি ফৌজ।
কিন্তু সময় গড়াতেই পাল্টা প্রত্যাঘাতে শত্রুপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) ও বিমানবাহিনী। যুদ্ধের মধ্যেই গত বছর লেবাননে পেজার হামলা চালায় ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। পাশাপাশি, গত দেড় বছরে হামাস ও হিজ়বুল্লার একাধিক শীর্ষনেতাকে নিকেশ করে দুই সশস্ত্র গোষ্ঠীর একরকম কোমর ভেঙে দিতে সক্ষম হয় নেতানিয়াহু সরকার।
চলতি বছরের ১৩ জুন ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। ফলে আরও ছড়িয়ে যায় পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধ। তেহরানের আণবিক কেন্দ্রগুলিতে অভিযানের নাম ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ রাখে ইজ়রায়েলি ফৌজি। তেল আভিভের যুক্তি, পরমাণু বোমা তৈরির জন্য লাগাতার বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ান তৈরি করে চলেছে সাবেক পারস্য দেশের কট্টরপন্থী শিয়া সরকার। ওই মারণাস্ত্র হাতে পেলে ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা করবে তারা।
ইরানের বিরুদ্ধে ইজ়রায়েলের এই অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ, শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নেতৃত্বাধীন তেহরান কখনওই দেশ হিসাবে ইহুদিভূমিকে মান্যতা দেয়নি। তেল আভিভকে বরাবর ‘ছোট শয়তান’ বলে উল্লেখ করে এসেছেন তিনি। ইজ়রায়েলকে বিপদে ফেলতে হামাস, হিজ়বুল্লা এবং হুথির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পর্দার আড়ালে থেকে ক্রমাগত অর্থ ও হাতিয়ার সরবরাহ করার অভিযোগও রয়েছে সাবেক পারস্য দেশের আধাসেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির বিরুদ্ধে।
পরমাণুকেন্দ্রগুলির উপরে ইহুদি বিমানবাহিনীর আক্রমণের পর একেবারেই চুপ করে বসে থাকেনি তেহরান। ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় ৩’ শুরু করে ইরান। দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক (শব্দের পাঁচ গুণের চেয়ে বেশি গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্রে তেল আভিভ ও হাইফা-সহ ইহুদিভূমির একাধিক শহরকে নিশানা করে আইআরজিসি। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ব্যবহার করেও সেগুলিকে আটকাতে সক্ষম হয়নি ইজ়রায়েলি ফৌজ।
এই পরিস্থিতিতে ইহুদিদের পক্ষ নিয়ে আসরে নামে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী। ওয়াশিংটন জানায়, ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির ‘বি-২ স্পিরিট’ বোমারু বিমান থেকে সেখানে ‘বাঙ্কার ব্লাস্টার’ বোমা ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করতে ব্যবহার করা হয়েছে টমাহক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। তেহরানের আণবিক বোমা তৈরির স্বপ্নকে চিরতরে মুছে ফেলার এ-হেন মার্কিন সৈন্য অভিযানের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’।
তেহরানের উপর আমেরিকার আঘাতের পরই সংঘর্ষবিরতির জন্য চাপ দিতে থাকেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। শেষে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় বন্ধ হয় ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ। লড়াই থামার পর ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার গোয়েন্দা ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণে বসে নেতানিয়াহুর সরকার। সেখানে উঠে আসে একাধিক ফাঁকফোকর। সে সব এ বার মুছে ফেলার চেষ্টা করছে ইহুদিরা। আরবি ভাষা ও কোরান শিক্ষার সিদ্ধান্ত সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
ইহুদি গোয়েন্দা কর্তাদের দাবি, হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথিদের মতো ‘বিষধর’ গোষ্ঠীগুলির নেতা-কর্মীদের কথ্য ভাষা হল আরবি। ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোরানের বিভিন্ন শব্দ বা পঙ্ক্তি গোপন ‘কোড’ হিসাবে ব্যবহার করে তারা। হিব্রুভাষী ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের পক্ষে সেটা বোঝা অসম্ভব। এই ভাষাগত সমস্যার কারণে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে দেরি হচ্ছে তাঁদের।
এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসাবে ৭ অক্টোবরের কথা বলা যেতে পারে। ওই দিন হামাসের হামলার পর সশস্ত্র গোষ্ঠীটির যোদ্ধাদের কথোপকথন টেপ করতে সক্ষম হয় ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। কিন্তু তাঁরা আরবিতে কথা বলার কারণে তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারেননি ইজ়রায়েলি গোয়েন্দারা। একাধিক প্রাণের বিনিময়ে এর খেসারত দিতে হয়েছে তেল আভিভকে।
লেবাননের হিজ়বুল্লা ও ইয়েমেনের হুথিদের ‘হাঁড়ির খবর’ সংগ্রহ করতে গিয়েও একই রকমের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে মোসাদ। এ ছাড়া মূল প্রতিপক্ষ ইরানের সরকারি ভাষা পার্সি হলেও আরবির বেশ চল রয়েছে। হুথি বিদ্রোহীরা আবার বিশেষ ধরনের একটি নেশার পাতা মুখে চিবোতে চিবোতে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট নেশাদ্রব্যটির নাম ‘কথ্’। ওই গুপ্ত তথ্য বুঝতে যে আরবি এবং কোরানের উপর ভাল দখল থাকা দরকার, তা হা়ড়ে হাড়ে বুঝেছে ইজ়রায়েল।
আইডিএফ রেডিয়োকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইহুদি গোয়েন্দাবাহিনীর পদস্থ আধিকারিক বলেছেন, ‘‘আমরা গুপ্তচর, সৈনিক এবং অফিসারদের আরবের গ্রামে বেড়ে ওঠা শিশুদের সমতুল্য করতে পারব না। কিন্তু, তাঁদের চিন্তাভাবনা এবং ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনাগুলিকে বুঝতে হলে আমাদের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি শিখতে হবে। আগামী দিনে এটা আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনার বড় অংশ হতে চলেছে।’’
পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলি অবশ্য ইজ়রায়েলের এই সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অন্য ভাবে দেখছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পাকিস্তান। অধিকাংশ ইসলামীয় রাষ্ট্রের দাবি, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে আরবি ভাষা এবং কোরান পাঠে মন দিচ্ছে ইহুদিরা। আরব দুনিয়ার মুসলিমদের ধর্ম এবং সংস্কৃতির মাহাত্ম্য এ বার বুঝতে পারবে তেল আভিভ।
ইসলামাবাদের গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের ‘বন্ধুত্ব’ দেখে ভয় পেয়েছে ইজ়রায়েল। সেই কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে তেল আভিভ। ইহুদিভূমিকে কোনও রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়নি ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, আরবি ও কোরানের পাঠ নিয়ে খুব দ্রুত ভয়ঙ্কর ভাবে ফিরে আসবে ইজ়রায়েলি ফৌজ ও গুপ্তচরবাহিনী। তাঁদের জোরালো প্রত্যাঘাত সামলানো পাকিস্তান ও আরব দেশগুলির পক্ষে কঠিন হতে পারে।