নতুন বছরের শুরুতেই হবে বারুদবর্ষণ? ফের রক্তাক্ত হবে পশ্চিম এশিয়া? বর্ষশেষে সেই রণবাদ্যই যেন বাজিয়ে দিল ইহুদিরা! সূত্রের খবর, সাবেক পারস্য দেশে (বর্তমান ইরান) ৫০০-র বেশি বার বোমাবর্ষণের নীলনকশা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে তেল আভিভ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাতে সবুজ সঙ্কেত দিলেই শুরু হবে আক্রমণ। সেই লক্ষ্যে বাহিনীকে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। আমেরিকায় ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ অনেক হিসাব বদলে দেবে বলে মনে করছেন দুঁদে কূটনীতিকদের একাংশ।
চলতি বছরের ২৯ ডিসেম্বর ফ্লোরিডার ‘মারে-এ-লাগো’ এস্টেটে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন নেতানিয়াহু। ইজ়রায়েলি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানেই ইরানে নতুন করে হামলা শুরু করার ব্যাপারে ট্রাম্পের সঙ্গে যাবতীয় আলোচনা সারবেন তিনি। দুঁদে কূটনীতিকদের কেউ কেউ মনে করেন, এ বার যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে প্রথম থেকে সঙ্গে নিয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নামতে চাইছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি, অত্যাধুনিক কিছু হাতিয়ারও আমেরিকার থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা আছে তাঁর।
গত জুনে ইরানের সঙ্গে ১২ দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ইজ়রায়েল। লড়াইয়ের একেবারে শেষ পর্বে আসে আমেরিকা। তার পর অবশ্য ট্রাম্পের মধ্যস্থতাতেই সংঘর্ষবিরতিতে সম্মত হয় তেল আভিভ ও তেহরান। কিন্তু মাত্র ছ’মাসের মধ্যেই থেমে যাওয়া সেই লড়াইয়ের আগুনে ইহুদিদের ফের ঝাঁপাতে চাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। এর মধ্যে অন্যতম হল, শিয়া ফৌজের ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি এবং পরমাণু বোমা তৈরির অদম্য ইচ্ছা। দ্বিতীয়টা তাদের ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’ ডেকে আনতে পারে বলেও মনে করছে নেতানিয়াহুর সরকার।
ইজ়রায়েলি গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, জুনের যুদ্ধের পর ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র সম্প্রসারণের কাজে আরও গতি আনে ইরান। ইহুদিদের বিমানবাহিনীর মতো তেহরানের বায়ুসেনা এতটা শক্তিশালী নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় শিয়া মুলুকটির আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির ক্ষেপণাস্ত্র। ওই ব্রহ্মাস্ত্রে তেল আভিভ বা হাইফার মতো শহরগুলিকে নিশানা করে তারা। শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) থাকা সত্ত্বেও সেগুলিকে আটকাতে পারেনি নেতানিয়াহুর ফৌজ।
দ্বিতীয়ত, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। দীর্ঘ দিন ধরেই তা চালিয়ে যাচ্ছে তেহরান। ইজ়রায়েলি গোয়েন্দাদের দাবি, বর্তমানে আণবিক বোমা তৈরির খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে সাবেক পারস্য দেশ। জুনের লড়াইয়ে শিয়া মুলুকটির একাধিক পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ (এনরিচমেন্ট) কেন্দ্রকে নিশানা করে ইহুদি এবং মার্কিন বিমানবাহিনী। তাতে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলির কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। তেল আভিভের অভিযোগ, গত কয়েক মাসে ওই কেন্দ্রগুলির পুনর্নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সরকার।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এ বারের ইরান হামলা ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনীর জন্য ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হতে পারে। কারণ, ইহুদি বিমানহানা ঠেকাতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আগের চেয়ে মজবুত করেছে তেহরান। চিন ও রাশিয়ার থেকে অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের নতুন ইউনিট হাতে পাওয়ার কথা আছে তাদের। তা ছাড়া নতুন করে লড়াই বাধলে দূরপাল্লার ‘কামিকাজ়ে’ (আত্মঘাতী) শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করতে পারে শিয়া ফৌজ। ইউক্রেন যুদ্ধে ইতিমধ্যেই নিজের ঘাতক শক্তির পরিচয় দিয়েছে পারস্যের এই পাইলটবিহীন বিমান।
তা ছাড়া আরও দু’টি জায়গায় সমস্যা হতে পারে ইজ়রায়েলের। আগের বার যুদ্ধ চলাকালীন পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তা করেনি তেহরান। এ বার সেটা করলে হঠাৎ করে দুনিয়া জুড়ে ধাক্কা খেতে পারে পশ্চিম এশিয়ার খনিজ তেলের সরবরাহ। এতে অশোধিত ‘তরল সোনা’র মূল্য রকেট গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেল আভিভ যে প্রবল চাপের মুখে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভারতের মতো ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের থেকেও বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে ইহুদিদের।
পাশাপাশি, জুনের সংঘাতের পর ইরানের হয়ে ইজ়রায়েলের উপর গুপ্তচরবৃত্তি শুরু করে মস্কো ও বেজিং। সম্প্রতি বেশ কয়েক জন রুশ এবং চিনা এজেন্টকে গ্রেফতার করেন ইহুদি গোয়েন্দারা। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া দেয় নেতানিয়াহুর সরকার। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সাবেক পারস্য দেশে যথেষ্টই দুর্বল হয়ে পড়েছে তেল আভিভের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। কারণ, জুনের যুদ্ধের পর ইহুদি এজেন্টদের খুঁজে বার করে এক এক করে ফাঁসিতে ঝোলায় তেহরান।
এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ইরান আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে ইজ়রায়েল পিছু হটবে বলে মনে করেন না অনেকেই। গত কয়েক বছর ধরেই ইহুদিদের বিরুদ্ধে ছায়াযু্দ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তেহরান। এ ব্যাপারে ‘তুরুপের তাস’ হিসাবে প্যালেস্টাইনপন্থী তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পর্দার আড়ালে থেকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন শিয়া ‘ধর্মগুরু’ তথা সর্বোচ্চ নেতা (সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেই। ফলে পারস্যের বিষাক্ত সাপের মাথা থেঁতলে না দিলে ভবিষ্যতে যে তাদের উপর বড় আঘাত নেমে আসবে, তা ভালই জানে তেল আভিভ।
ইজ়রায়েলকে ঘিরতে প্যালেস্টাইনের গাজ়া উপত্যকায় হামাস, লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে ইরান। গত দু’বছরে এই তিন গোষ্ঠীকে বহু বার একসঙ্গে তেল আভিভের উপর হামলা চালাতে দেখা গিয়েছে। ইহুদিদের অভিযোগ, সেই সমস্ত অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী হল তেহরান। শুধু তা-ই নয়, ২০২৩ সালে ইজ়রায়েলকে ধ্বংস করতে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট-সহযোগে আক্রমণ শানায় শিয়া ফৌজ। সে বার কোনও মতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সেগুলিতে আটকে প্রত্যাঘাতে নেমেছিল নেতানিয়াহুর বিমানবাহিনী।
আর তাই ইরানের মতো শত্রুকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগই দিতে চাইছে না পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি রাষ্ট্র। সেই কারণে নতুন বছরের গোড়াতেই তেহরানে বারুদবর্ষণের ছক কষছে তারা। গত ২১ ডিসেম্বর একটি সামরিক মহড়ায় এই ইস্যুতে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের প্রধান (চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনে আমরা কাছাকাছি এবং দূরবর্তী, উভয় ফ্রন্টেই শত্রুদের উপর আক্রমণ শানাব।’’ এখানে তিনি কোনও দেশের নাম না নিলেও, তেল অভিভের লক্ষ্য তেহরান বলেই মনে করা হচ্ছে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ওই দিনই ইহুদিদের সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে সংবাদমাধ্যম রাশিয়া টুডের কাছে মুখ খোলেন ইরানি বিদেশমন্ত্রী আব্বাস আরাঘাচি। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রগুলির পুনর্নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তেহরান কখনওই পরমাণু ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। সেটা অবিলম্বে শুরু হবে। তবে সেটা কোনও গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির জন্য নয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য।’’
এর পরই ইজ়রায়েলকে হুমকি দিয়ে বিবৃতি দেন আরাঘচি। ইরানি বিদেশমন্ত্রীর কথায়, ‘‘আগেও বহু বার আমাদের উপর ইহুদিরা কিছু ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। আবার তেমন কিছু করতে গেলে উচিত শিক্ষা পাবে। এ বার আমাদের প্রত্যাঘাত আরও কঠোর এবং ধ্বংসাত্মক হবে।’’ যুদ্ধ শুরু হলে তেহরান যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে পারে, সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সেই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সামরিক অভিযানে নামতে চাইছেন নেতানিয়াহু। আমেরিকার গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, সরাসরি লড়াইয়ে জড়ানোর ব্যাপারে যথেষ্ট আপত্তি আছে ট্রাম্পের। তবে ইজ়রায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন আছে তাঁর। ফলে একাধিক অত্যাধুনিক হাতিয়ার তেল আভিভকে পাঠাতে পারেন তিনি।
গত ১৩ জুন ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিতে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী হামলা চালালে পশ্চিম এশিয়ায় শিয়া ও ইহুদি ফৌজের মধ্যে বেধে যায় যুদ্ধ। ইহুদিরা সাবেক পারস্য মুলুকে তাদের অভিযানের নাম রাখে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’। অন্য দিকে পাল্টা প্রত্যাঘাত শানানো তেহরানের অভিযান পরিচিতি পায় ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ় থ্রি’ নামে। সংশ্লিষ্ট লড়াই চলাকালীন শিয়া সেনার একাধিক শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীকে নিকেশ করে ইহুদি বায়ুসেনা।
এ বছরের ২২ জুন ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতে ইহুদিদের পক্ষ নিয়ে আসরে নামে আমেরিকা। তেহরানের ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান পরমাণুকেন্দ্রে ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বায়ুসেনা। পরে এই নিয়ে বিবৃতি দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বলেন, ‘‘এই হামলার জন্য ১৭ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আকাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের বি-২ স্পিরিট বোমারু বিমান।’’ এই অভিযানের পোশাকি নাম ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ রাখে ওয়াশিংটন। এর পরই ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছিল দু’পক্ষ।
জুনের ওই লড়াইয়ে হাজারের বেশি ইরানির মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল। অন্য দিকে শিয়া ফৌজের প্রত্যাঘাতে ইহুদিদের ২৪০টি বড় ভবন, ২,৩০৫টি বাড়ি, দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ১৩ হাজারের বেশি ইজ়রায়েলিকে বাস্তুহারা হতে হয়েছিল। তেল আভিভ অবশ্য মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করেনি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ট্রাম্পের সমর্থন না মিললেও ইরান আক্রমণের নির্দেশ দেবেন নেতানিয়াহু। ২০২৬ সালে লম্বা সময় ধরে চলতে পারে সেই লড়াই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মুখে এক এবং কাজে আর এক করার প্রবণতা রয়েছে। তেল আভিভ সংঘাতের রাস্তায় গেলে তাঁর ভূমিকা কী হবে, তা অনুমান করা বেশ কঠিন।