পশ্চিম এশিয়ার যু্দ্ধে আপাতত ইতি। মুখোমুখি সংঘর্ষে দাঁড়ি টেনেছে বিবদমান ইরান এবং ইজ়রায়েল। লড়াই থামতেই দু’পক্ষের রণকৌশলের কাটাছেঁড়ায় বিশ্বের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠেছে। সাবেক পারস্য দেশের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উড়িয়ে দেওয়াই এই যুদ্ধের ‘মোড় ঘোরানো’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। আর সেই অপারেশনে সফল হওয়ায় ফের খবরের শিরোনামে এসেছে ইহুদিদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ।
যুদ্ধ শুরুর দিনেই এয়ার ডিফেন্স ধ্বংস করায় ইরানি আকাশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনীর হাতে। ফলে ১২ দিনের সংঘর্ষে সাবেক পারস্য দেশে দাপিয়ে বেড়াতে পেরেছেন ইহুদি যোদ্ধা পাইলটেরা। বেছে বেছে শিয়া ফৌজের শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণুবিজ্ঞানীদের নিকেশ করতেও সমস্যা হয়নি তাদের। তেহরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ উড়িয়ে দেওয়ার নীলনকশা তৈরির নেপথ্যে রয়েছে মোসাদের গুপ্তচরদের বহু দিনের পরিশ্রম এবং মেধা, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ইরানি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ড্রোন হামলা চালিয়ে তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেয় ইজ়রায়েল। কী ভাবে সেই আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলি শত্রুদেশের ভিতরে নিয়ে গেলেন ইহুদি গুপ্তচরেরা? সেই রহস্য এখনও ভেদ করতে পারেনি তেহরান। তবে বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদসংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ বা এপি।
মার্কিন সংবাদসংস্থাটির দাবি, এই ‘অপারেশন’-এর খুঁটিনাটি জানতে বর্তমান এবং প্রাক্তন মিলিয়ে অন্তত ১০ জন ইজ়রায়েলি গোয়েন্দা এবং উচ্চপদস্থ সেনাকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। যদিও তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে খুব বেশি পরিমাণে তথ্য যে বাইরে এসেছে, এমনটা নয়। তেল আভিভের দাবি, গত কয়েক দশক ধরে ইরানের ভিতরে একটি মজবুত নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে মোসাদ। সেই এজেন্টদের কাঁধেই ছিল তেহরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ধ্বংসের গুরুদায়িত্ব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইহুদি গোয়েন্দা এবং ফৌজের পদস্থ কর্তাদের উদ্ধৃত করে এপি লিখেছে, রাজধানী তেহরানের ভিতরে একটি ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করতে সক্ষম হন মোসাদের এজেন্টরা। সেখান থেকেই সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে হামলা চালানো হয়েছিল। পাশাপাশি, সেগুলি কোথায় কী ভাবে মোতায়েন রয়েছে, সেই তথ্যও আগাম সংগ্রহ করেন ইজ়রায়েলি গুপ্তচরেরা। ফলে ‘অপারেশন’-এর সময়ে কোনও ভুল করেননি তাঁরা।
এপি জানিয়েছে, ইরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’য় আক্রমণ শানাতে অন্তত তিন বছর ধরে পরিকল্পনা করেন মোসাদের গুপ্তচরেরা। আমেরিকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ আবার লিখেছে, এই অভিযানে ‘কোয়াডকপ্টার’ নামের একটি বিশেষ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করে মোসাদ। স্যুটকেস, ট্রাক এবং মালবাহী জাহাজের কন্টেনারে করে সেগুলিকে তেহরানের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ড্রোন উৎক্ষেপণের লঞ্চার এবং বিস্ফোরকও সাবেক পারস্য দেশে পাচার করে ইজ়রায়েল।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, শিয়া ফৌজের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিতে কয়েকশো ড্রোন চোরাপথে ইরানের ভিতরে নিয়ে যান ইহুদি গুপ্তচরেরা। এর পর ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র খুব কাছে সেগুলিকে মজুত করা হয়। পাশাপাশি, মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে আরও বেশি ঘাতক করে তুলতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তিও ব্যবহার করে ইজ়রায়েল। এর জেরে স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের লক্ষ্য খুঁজে নিতে পেরেছিল হামলাকারী ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোনের ঝাঁক।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, আমেরিকার তৈরি এআই-ভিত্তিক বেশ কিছু প্রযুক্তি এই যুদ্ধে ব্যবহার করেছে ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফ। ইরানের উপর গুপ্তচরবৃত্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে এগুলি দারুণ ভাবে সাহায্য করে তাঁদের। পাশাপাশি, কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে তেহরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র হদিস খুঁজে নেয় ‘মোসাদ’। সেই অনুযায়ী হামলার গোটা পরিকল্পনা ছকে ফেলে তারা।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর ইরানের সামরিক-বিশ্লেষক নায়সান রাফাতি। তাঁর দাবি, গত বছরের অক্টোবরে তেহরানে হামলা চালায় ইহুদি বায়ুসেনা। সেই সময়েই সাবেক পারস্য দেশের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র দুর্বলতা টের পায় তেল আভিভ। বছর ঘুরে ফের আক্রমণ শানাতে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ফৌজ ও গুপ্তচরবাহিনী।
অন্য দিকে, মোসাদের নেতৃত্বে ইহুদিরা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম উড়িয়ে দেওয়ার পর দেশের সরকারি নিউজ় চ্যানেলে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দেন ইরানি পুলিশ প্রধান জেনারেল আহমাদরেজা রাদান। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আকারে ছোট ড্রোনগুলিকে গাড়িতে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যায় ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী। ফলে সেগুলির হদিস করা যায়নি। এই কাজে দেশের ভিতরের বেশ কয়েক জনের সাহায্য পায় তারা। সেই সমস্ত বিশ্বাসঘাতকের খোঁজ চলছে।’’
চলতি বছরের জুন মাসের গোড়ায় রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ঠিক একই কায়দায় ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। এর মাধ্যমে মস্কোর কৌশলগত বোমারু বিমানের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস করতে সফল হয় কিভ। ইরানের অন্দরে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের হুবহু সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধকৌশল থেকে মোসাদ অনুপ্রাণিত হয়েছে কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।
এপির প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে, এই অপারেশন চলাকালীন ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির শীর্ষ কমান্ডারদের একটি তালিকা তৈরির দায়িত্ব বিশেষ একজন এজেন্টকে দেয় মোসাদ। পরে সেই তালিকা ধরে এক এক করে শত্রুদের নিকেশ করেছে নেতানিয়াহুর ফৌজ ও গুপ্তচরবাহিনী। তেহরানের ব্যালেস্টিক এবং হাইপারসনিক (শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিশীল) ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এই আইআরজিসির হাতে।
ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী যে হামলা চালাতে পারে সেই আশঙ্কা অবশ্য প্রথম থেকেই করছিল ইরান। ২০২০ সালে মোসাদকে নিয়ে সতর্ক করে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তেহরানের গোয়েন্দা দফতরের প্রাক্তন মন্ত্রী আলি ইউনেসি। একটি বিতর্কসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে ওরা। বললে হয়তো হাস্যকর শোনাবে, আমাদের কানের চেয়েও কাছে দাঁড়িয়ে আছে ইহুদি এজেন্টরা।’’
ঠিক এর পরের বছরে (পড়ুন ২০২১) একই কথা বলতে শোনা যায় ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজ়াদকে। তাঁর দাবি, ‘‘মোসাদকে আটকাতে একটি গোয়েন্দা দল তৈরি করা হয়। কিন্তু সমস্যা হল সেই ইউনিটের প্রধান নিজেই ছিলেন একজন ইজ়রায়েলি এজেন্ট।’’ ২০১৮ সালে তেহরানের পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র থেকে চুরি যায় কয়েক হাজার পৃষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ নথি। তার নেপথ্যেও ইহুদি গুপ্তচরদের হাত থাকার অভিযোগ ওঠে।
২১ শতকের প্রথম দশকে পরমাণু বোমা তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান তথা তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণে ব্যবহৃত ইরানি সেন্ট্রিফিউজ়ের কম্পিউটারে সাইবার হামলা চালায় ইজ়রায়েল। সে বার ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস সেখানে ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয় তেল আভিভ। ফলে পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছিল। ওই ঘটনার পর আবার প্রথম থেকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের কাজ শুরু করতে হয়েছিল সাবেক পারস্য দেশের বিজ্ঞানীদের।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের বুকে বড় আকারের আক্রমণ শানায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইহুদিভূমিতে ঢুকে নির্বিচারে নিরীহ আমজনতাকে খুন করে তারা। অনেককে আবার অপহরণ করে প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় নিয়ে যায় হামাস। তাদের পণবন্দি রেখে নেতানিয়াহু সরকারের উপর চাপ তৈরি করেছিল ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
হামাসের এই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। ৭ অক্টোবরের ঘটনায় মোসাদকে নিয়ে উঠে যায় বড়সড় প্রশ্ন। কিন্তু, সেই ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে দ্রুত পাল্টা প্রত্যাঘাতের রাস্তা খুঁজে বার করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী। ঠিক এক বছরের মাথায় সাফল্য পায় তারা।
হামাসের ওই আক্রমণের পর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সঙ্গে সঙ্গে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীটির পাশে দাঁড়িয়ে ইহুদিভূমিতে লাগাতার রকেট হামলা শুরু করে লেবাননের হিজ়বুল্লা। পর্দার আড়ালে থেকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকেও তেহরান মদত দিয়ে চলেছে বলে দীর্ঘ দিন ধরে অভিযোগ জানিয়ে আসছে ইজ়রায়েল। ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আচমকাই হিজ়বুল্লার যোদ্ধা ও সমর্থকদের কাছে থাকা যোগাযোগের ডিভাইস পেজারে বিস্ফোরণ ঘটে। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে একসঙ্গে কয়েকশো পেজার ফেটে যাওয়ায় লেবানন জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জানা যায় এই ঘটনার মূল চক্রী মোসাদ। ওই মাসের ২৯ তারিখে লেবাননের রাজধানী বেইরুটে ইজ়রায়েলি সেনার রকেট হামলায় প্রাণ হারান হিজ়বুল্লার প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লা। এ ছাড়া ইরানে গুপ্ত বৈঠক করতে এসে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় হামাসের শীর্ষনেতা ইসমাইল হানিয়ের। এই দুই ঘটনার নেপথ্যেও ইহুদি গুপ্তচরদের হাত থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল।
এ বছরের ১৩ জুন পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি ধ্বংস করতে ইরানে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ নামে সেনা অভিযান চালায় ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনী। একে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে ১০ দিন ধরে চলে যুদ্ধ। এই লড়াইয়ের গোড়াতেই ড্রোন হামলায় শিয়া ফৌজের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেয় ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী। আর এ ভাবেই আরও একবার সারা দুনিয়ার সামনে নিজেদের জাত চিনিয়েছে মোসাদ।