লেবাননে পেজার বিস্ফোরণ হোক বা ইরানে ঢুকে ড্রোন হামলা। গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে ইহুদি-রাষ্ট্র ইজ়রায়েলের খ্যাতি ভুবনজোড়া। শত্রুদেশে ‘টার্গেট কিলিং’ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক তথ্য চুরির ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি মেলা ভার। তবে এই ধরনের দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে বেশ কয়েক বার পা পিছলেছে তেল আভিভের। একবার তো তার জন্য গর্দান যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর। কোনও মতে পিঠ বাঁচান তিনি।
ইজ়রায়েলের সেই কলঙ্কিত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নাম পিনহাস লেভন। তাঁর নির্দেশে প্রতিবেশী দেশ মিশরে অভিযান চালাতে গিয়ে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী। সালটি ছিল ১৯৫৪। এক দশক শাসন করার পর সে বছর কুর্সি ছেড়ে দেন ইজ়রায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মোশে শারেট। লেভনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ছিল না তাঁর।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকের ওই সময়টা ছিল ইহুদি রাজনীতির এক জটিল অধ্যায়। কারণ, লেভনের পাশাপাশি তখন ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ-কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘চিফ অফ জেনারেল স্টাফ’ (পড়ুন সেনাপ্রধান) মোশে দায়ান। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন শিমন পেরেস। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই দুই তরুণ ইহুদি শারেটের থেকে গুরিয়নকে বেশি বিশ্বাস করতেন। আর তাই বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিষয় নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতে ভালবাসতেন তাঁরা।
এ-হেন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আবার ইজ়রায়েলি গুপ্তচর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলির কাজের পরিসর নিয়ে বাধে ঝামেলা। পশ্চিম এশিয়ার ইহুদিভূমিতে স্বতন্ত্র তিনটি সংস্থা রয়েছে। সেগুলি হল মোসাদ, আমান এবং শিন-বেট। এর মধ্যে বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে যুক্ত মোসাদ। আইডিএফের জন্য গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে আমান। আর শিন-বেটের কাজ হল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দেখভাল। ৫০-এর দশকে লেভনের আমলে মোসাদকে কিছুটা একঘরে করে ফেলার অভিযোগও উঠেছিল।
গুরিয়ন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করত মোসাদ ও আমান। কিন্তু, কেউ কারও কাজে সে ভাবে ‘নাক গলাত’ না। যদিও বিদেশে গুপ্তচরবৃত্তির মূল দায়িত্ব ছিল মোসাদের উপরেই। লেভন এসে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি পাল্টে দেন। কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল চারদিকের শত্রু আরব দেশগুলিকে শিক্ষা দিতে আমান আরও বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে। আর এখানেই মস্ত ভুল করে বসেন তিনি। ফলে ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয় তাঁকে।
প্রতিবেশী দেশ মিশরেও তখন চলছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। সেখানকার রাজা দ্বিতীয় ফারুখকে উৎখাত করে কায়রোর ক্ষমতা দখল করে গামাল আবদেল নাসের। গোটা আরব দুনিয়ার নেতা হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাঁরা। পাশাপাশি, ইজ়রায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না তিনি। নাসের চেয়েছিলেন লোহিত সাগর ও ভুমধ্যসাগরকে জুড়ে দেওয়া সুয়েজ খালের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ফলে ‘পিরামিডের দেশে’ তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে প্রমাদ গোনে ইহুদিরা।
মিশরের পালাবদল পর্বে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ছিল একটি অ্যাংলো-ফরাসি সংস্থার হাতে। কুর্সিতে বসেই তাদের তাড়াতে উঠেপড়ে লাগেন নাসের। তাঁর লক্ষ্য ছিল খাল সংলগ্ন সিনাই উপদ্বীপ পেরিয়ে মূল ইহুদিভূমিতে আক্রমণ। কিন্তু ওই এলাকায় ইংরেজ এবং ফরাসিরা থাকার কারণে কিছুতেই তা করতে পারছিলেন না তিনি। নাসের জানতেন, সুয়েজ খাল পুরোপুরি ভাবে হাতে এলে সেখানে ইজ়রায়েলের ঢোকা বন্ধ করা যাবে। আর তাতে রাতারাতি ভেঙে পড়বে ইহুদিদের অর্থনীতি।
এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৪ সালের গ্রীষ্মে আইডিএফের গোয়েন্দা শাখা আমান জানতে পারে সুয়েজ খাল এলাকা থেকে তল্পিতল্পা গোটাচ্ছে ইংরেজরা। সঙ্গে সঙ্গে মরিয়া হয়ে ওঠে ইহুদিদের এই সংস্থা। রাতারাতি ছকে ফেলা হয় কায়রোর ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং আমেরিকান ইনফরমেশন সেন্টারে নাশকতার নীলনকশা। হামলার পর এর সম্পূর্ণ দোষ স্থানীয় আরবদের উপরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল আমান। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে বলে নিশ্চিত ছিল ইজ়রায়েল।
ইহুদি গোয়েন্দারা মনে করেছিলেন, ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং আমেরিকান ইনফরমেশন সেন্টারে নাশকতার ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক ভাবে মারাত্মক চাপে পড়বেন নাসের। হামলার পর কিছুতেই সুয়েজ ছাড়তে চাইবে না সেখানে মোতায়েন ইংরেজ বাহিনী। অন্য দিকে এর জন্য পুরনো শত্রু ‘মুসলেম ব্রাদার্স’ গোষ্ঠীর পিছনে পড়বেন মিশরের নতুন প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি, ঘরোয়া অশান্তি সামলে তাঁর পক্ষে ইহুদিভূমির দিকে নজর দেওয়া বেশ কঠিন হবে।
ফলে পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করে দেয় আমান। কায়রোয় নাশকতার জন্য মিশরীয় ইহুদিদের একটি দলকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন কর্নেল মোর্দেচাই বেন-সুর। এই অভিযানের নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সুজ়ানা’। সংশ্লিষ্ট মিশনে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা শিন-বেটও জড়িত ছিল। অপারেশনে জড়িতরা নিজেরাই তৈরি করেন বিশেষ ধরনের বোমা। সেগুলি ছিল অ্যাসিডভর্তি কন্ডোম আর বিস্ফোরকভর্তি চশমার খাপ।
‘মোসাদ: ইজ়রায়েল্স মোস্ট সিক্রেট সার্ভিস’ বইয়ে ‘অপারেশন সুজ়ানা’র বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ সাংবাদিক রোনাল্ড পেইন। সেখানে তিনি লেখেন, ১৯৫৪ সালের জুলাইয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ‘কাজে’ নামার নির্দেশ পাঠায় তেল আভিভ। আদেশনামায় লেখা ছিল, অ্যাংলো-মিশরীয় চুক্তি রোধ বা স্থগিত করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ শুরু করুন। এর জন্য বিশেষ করে ব্রিটিশ নাগরিকদের নিশানা করতে বলা হয় তাঁদের।
তেল আভিভ থেকে নির্দেশ পেতেই আলেকজান্দ্রিয়ার ডাকঘরে পর পর বিস্ফোরণ ঘটান মিশরের ইহুদি এজেন্টরা। এ ছাড়া কায়রোয় মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের পাঠাগারে নাশকতার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। পাশাপাশি রেলস্টেশন এবং সিনেমাহলে বিস্ফোরক রেখে আসার জন্য একত্রিত হন তাঁরা। সকলের সন্দেহ যাতে অন্যদের উপরে পড়ে, তার জন্য নাসেরের কুর্সিপ্রাপ্তির বর্ষপূর্তির দিনে ‘অপারেশন সুজ়ানা’কে সফল করতে চেয়েছিল ইজ়রায়েল।
ইহুদিদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্যে ছিল বছর ১৯-র ফিলিপ নাথানসন নামের এক এজেন্টের ছোট্ট একটা ভুল। বিস্ফোরকবোঝাই চশমার বাক্স পকেটে নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় একটি সিনেমাহলের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তখনই আচমকা সেটা ফেটে গেলে গুরুতর জখম হয় নাথানসন। দ্রুত উদ্ধার করে তাঁর জীবনরক্ষা করে মিশরীয় পুলিশ। কিন্তু বিস্ফোরণের ধরন দেখে তদন্তকারীদের মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। ফিলিপকে জেরা করতেই ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ে বেড়াল।
ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মিশরে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ইহুদিদের গোটা নেটওয়ার্ক। নাসেরের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মোসাদের অন্যতম ধুরন্ধর গুপ্তচর ম্যাক্স বেনেট। ‘পিরামিডের দেশ’-এ ব্যবসায়ী হিসাবে দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন তিনি। অপারেশনের সময়ে তাঁর রেডিয়ো কাজ না করায় নাশকতার দায়িত্বপ্রাপ্ত এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি বেনেট। ‘সুজ়ানা’ ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্যে একেও অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
পেইন অবশ্য তাঁর বইয়ে লিখেছেন, এই অপারেশনের জন্য অপেশাদারদের কাজে লাগিয়েছিল মোসাদ। আর সেটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। অতি উৎসাহে ওই এজেন্টরা বাড়িতে গুপ্ত বৈঠক করছিলেন। রেডিও সেট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল না তাঁদের। তবে বেনেটের গ্রেফতারি ছিল ইহুদিদের কাছে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। কারণ, কায়রোর হাঁড়ির খবর জোগাড়ের জন্য তিল তিল করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন তিনি। এর পুরোটাই রাতারাতি ধ্বংস করে দেয় নাসেরের পুলিশ।
আলেকজান্দ্রিয়ার সিনেমাহলের সামনে বিস্ফোরণকাণ্ডের চার দিনের মাথায় মোট ১০ জন পুরুষ এবং এক জন মহিলা ইজ়রায়েলি গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে মিশরীয় তদন্তকারী দল। এঁদের সবাই ‘রক্তাক্ত ইহুদিবাদী দল’-এর সদস্য বলে ব্যাপক প্রচার করেছিল নাসের প্রশাসন। ধৃতদের মধ্যে দু’জনকে ফাঁসিতে ঝোলায় কায়রো। বেনেট অবশ্য জেলবন্দি অবস্থায় একটা জং ধরা পেরেক দিয়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেন। ফলে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেনি ‘পিরামিডের দেশ’।
‘অপারেশন সুজ়ানা’য় জড়িত থাকায় দীর্ঘ কারাবাসের শাস্তি পান মোসাদের মহিলা এজেন্ট ভিক্টোরিয়া নিনিও। কায়রোতে জেলবন্দি অবস্থায় অন্তত দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু দু’বারই ব্যর্থ হন নিনিও। শেষে ১৯৬৮ সালে বন্দি বিনিময়ের সময়ে ইজ়রায়েলে ফিরে আসেন তিনি। ইহুদিভূমিতে জাতীয় বীরের সম্মান পেয়েছিলেন নিনিও। ঘরে ফেরার তিন বছরের মাথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ভিক্টোরিয়া। সেই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সাবেক ইহুদি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার।
মিশরের অন্দরে এ-হেন ‘ফল্স ফ্যাগ’ অপারেশনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে চাপে পড়ে ইজ়রায়েল। ইহুদিদের বাড়াবাড়ি মোটেই ভাল চোখে দেখেনি ব্রিটেন। অন্য দিকে মোসাদ, আমান, শিন-বেটের পরিকল্পনা বুঝে নিয়ে বিশেষ রিপোর্ট তৈরি করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি)। এর প্রভাব ওয়াশিংটন ও তেল আভিভের সম্পর্কেও পড়েছিল।
‘অপারেশন সুজ়ানা’র ব্যর্থতার কাটাছেঁড়া করতে একাধিক তদন্ত কমিটি বসায় ইহুদি সরকার। চলে দীর্ঘ শুনানি। সেখানে অবশ্য মোসাদ, আমান এবং শিট-বেটের কর্তাব্যক্তিরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাতে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তবে সব কিছুর দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী লেভনকে। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নাকি নিয়েছিলেন বলেও একাধিক ইজ়রায়েলি সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
মিশরে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনীর এই ব্যর্থতা ‘লেভন অ্যাফেয়ার্স’ নামে বিখ্যাত। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি সামলাতে অবসর ভেঙে ফিরে আসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল তাঁকে। কায়রোকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী দশকগুলিতে অবশ্য নিজেদের মধ্যে ফাঁকফোকরগুলি অনেকাংশেই মিটিয়ে নিতে পেরেছিল তিন ইজ়রায়েলি সংস্থা।