আমেরিকা, রাশিয়া, চিন ও ফ্রান্স। ‘ফারাও’ বায়ুসেনার ঘাঁটিতে রয়েছে অতিশক্তিশালী চার দেশের যুদ্ধবিমান। বর্তমানে বিশ্বের আর কোনও বিমানবাহিনীর বহরে নেই লড়াকু জেটের এ হেন অদ্ভুত সংমিশ্রণ। তবে যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে নীল নদের তীরের দেশটির যে ভাবে বেজিং-প্রীতি বাড়ছে, তাতে বেজায় চটতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়া। ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সমীকরণ বদলের প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
উত্তর আফ্রিকার ‘পিরামিডের দেশ’ মিশর। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে সেখানকার বায়ুসেনা প্রথম পাঁচে না থাকলেও তাদের বহরে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, চিন এবং ফ্রান্স— চার শক্তিশালী দেশের লড়াকু জেট। বর্তমানে পুরনো হয়ে যাওয়া মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলিকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কায়রো। সেই জায়গায় বেজিঙের তৈরি জে-১০সি জেটকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে সাবেক ফৌজি অফিসার তথা মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির।
গত বছর থেকে বায়ুসেনার আধুনিকীকরণে জোর দিয়েছে মিশর। তার পর থেকেই চিনা যুদ্ধবিমান জে-১০সি ভিগোরাস ড্রাগন বিক্রি করতে ড্রাগন ঝাঁপাবে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই লড়াইয়ে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার এফএ-৫০ নামের লড়াকু জেটও। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ফারাও’দের দেশে হওয়া প্রদর্শনীতে প্রথম বার যোগ দেয় বেজিঙের জে-১০সি। ফলে এই নিয়ে জল্পনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জে-১০সি নিয়ে কায়রো প্রশাসন চিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষাচুক্তি সেরে ফেলেছে বলে খবর প্রকাশ করে স্থানীয় বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। যদিও পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন বেজিঙের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র উ কিয়ান। উল্টে এ ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুয়ো খবর ছড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। যদিও তার পরেও এই নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়নি।
এ বছরের এপ্রিলে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় যোগ দেয় পিরামিডের দেশের বিমানবাহিনী। মহড়াশেষে জে-১০সি যুদ্ধবিমানের ককপিটে বসে থাকা এক জন মিশরীয় যোদ্ধা পাইলটের ভিডিয়ো, ছবি প্রকাশ্যে আসে। ফলে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনেকেই দুয়ে দুয়ে চার করেছেন। যদিও সংশ্লিষ্ট চিনা যুদ্ধবিমানটির প্রতিরক্ষাচুক্তি নিয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি কায়রো।
সূত্রের খবর, গত মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ কোরিয়ার এফএ-৫০ লড়াকু জেট হাতে পেতে আগ্রহ দেখিয়েছিল ‘ফারাও’ বায়ুসেনা। কিন্তু পরে জে-১০সির দিকে তারা ঝুঁকতে শুরু করে। সোলের গণমাধ্যম চোসুন ডেলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধে’ বেজিঙের হাতিয়ার খারাপ পারফরম্যান্স করায় এই সিদ্ধান্ত ফের বদল করতে পারে কায়রো।
চিনা প্রতিরক্ষা সংস্থা চেংডুর তৈরি ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ইসলামাবাদকে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছে বেজিং। মিশর শেষ পর্যন্ত এটি পছন্দ করলে দ্বিতীয় কোনও দেশকে সংশ্লিষ্ট জেটটি সরবরাহ করবে ড্রাগন সরকার। কায়রোর বহরে ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান রয়েছে। সূত্রের খবর, ভারত-পাক ‘যুদ্ধে’ মুখোমুখি লড়াইয়ে ছিল রাফাল এবং জে-১০সি।
মিশরীয় বায়ুসেনার বহরে মার্কিন সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি ২০০টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের সঙ্গে ২৪টি রাফাল জেটের চুক্তিতে সই করে কায়রো। এর মধ্যে ছিল ১৬টি দু’আসন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। বাকি আটটি এক আসনের জেট। সংশ্লিষ্ট বিমানগুলি সরবরাহ ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে দাসোঁ অ্যাভিয়েশন।
২০১৫ সালে রাশিয়ার সঙ্গেও একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে মিশর। এর মাধ্যমে ৪৬টি মিগ-২৯এম/এম২ বরাত দেয় কায়রো। ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ওই জেটগুলি সরবরাহ করেছে মস্কো। ২০১৮ সালে ২৪টি এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে আর একটি চুক্তি সেরে ফেলে সিসি প্রশাসন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পরে তা বাতিল করতে বাধ্য হয় তারা।
২০২১ সালে আরও ৩০টি রাফাল লড়াকু জেট কিনতে ফ্রান্সের সঙ্গে চুক্তি করে মিশর। ফলে ২০২৬ সালের মধ্যে ‘ফারাও’ বায়ুসেনার বহরে মোট রাফালের সংখ্যা বেড়ে ৫৫ হবে বলে জানা গিয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে এফ-১৬ এবং মিগ-২৯ জেটের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে সমস্যায় পড়ে কায়রো। এর পর থেকেই বিকল্প পথের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে সিসি প্রশাসন, খবর সূত্রের।
বিশ্লেষকদের দাবি, গত কয়েক দশকে চিন ও মিশরের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত হয়েছে। ১৯৭৫ সালে প্রথম বার দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রচুক্তি সই হয়। এর মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ার বাজারের দরজা বেজিঙের সামনে খুলে গিয়েছিল। ওই সময়ে শি’আন এইচ-৬ নামের বোমারু বিমান কিনেছিল কায়রো। সেগুলি ‘বুড়ো’ হয়ে গেলেও এখনও ব্যবহার করছে পিরামিডের দেশের বিমানবাহিনী।
গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে বিপুল পরিমাণে চিনা সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করছে মিশর। সেই তালিকায় রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র, ছোট যুদ্ধজাহাজ, ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরী এবং লড়াকু জেট। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ইজ়রায়েল প্রীতিই কায়রোকে বেজিঙের কাছাকাছি যেতে সাহায্য করেছে। ইহুদিদের সমস্যা হয় এমন কোনও হাতিয়ার কখনওই ‘ফারাও’ ফৌজকে বিক্রি করেনি ওয়াশিংটন।
সূত্রের খবর, চিনের রফতানি করা অস্ত্রের ৬০ শতাংশ কিনে থাকে পাকিস্তান। ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধে’ অত্যন্ত খারাপ পারফরম্যান্স করায় সেগুলির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে দু’টি জেএফ-১৭ লড়াকু জেট ধ্বংস হয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছে ইসলামাবাদ। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলির নির্মাণকারী সংস্থা ছিল চেংডু।
গত ৮ এবং ৯ মে রাতে প্রত্যাঘাতের সময়ে ড্রোন হামলা চালিয়ে পাক পঞ্জাব প্রদেশের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। এর জন্য ইজ়রায়েলের তৈরি ‘হারোপ’ ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করে ইসলামাবাদ। সূত্রের খবর, লাহৌরে চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন রেখেছিলেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
এ ছাড়া মাঝ-আকাশের ডগফাইটে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে বেজিং থেকে আমদানি করা পিএল-১৭ নামের একটি ‘এয়ার টু এয়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল পাক বিমানবাহিনী। কিন্তু কোনও রকম বিস্ফোরণ না ঘটিয়ে পঞ্জাবের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামে এসে পড়ে ওই অস্ত্র। পরে তা উদ্ধার করে বাহিনীর হাতে তুলে দেন এলাকাবাসীরা। এই ঘটনাগুলির জেরে অস্ত্রবাজারে কমেছে ড্রাগনের গ্রহণযোগ্যতা।
‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের সংঘর্ষে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে ভারতীয় আমজনতার মনে ভয় ধরানোর ক্ষেত্রে চেষ্টার ত্রুটি করেনি পাকিস্তান। চিনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান দিয়ে ভারতীয় রাফালকে ধ্বংস করা গিয়েছে বলে প্রচার চালাচ্ছিল ইসলামাবাদ। পরে তাতে যোগ দেয় চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’।
এর পর ‘গ্লোবাল টাইমস’কে সঠিক তথ্য দিতে ‘ফ্যাক্ট চেক’ পাঠায় কেন্দ্রের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো বা পিআইবি। বাধ্য হয়ে ভুল খবর প্রকাশ করার কথা স্বীকার করে নেয় চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম। রাফালকে ধ্বংস করতে বেজিঙের জে-১০সি লড়াকু জেট ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঢোঁক গিলে পত্রপাঠ তাঁর বক্তব্য খারিজ করে দেয় ড্রাগন প্রশাসন।
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই সংঘাতের পর ভারতীয় অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ থেকে শুরু করে ড্রোনের মারণক্ষমতা ছিল নজরকাড়া। তবে কায়রোকে নয়াদিল্লি হাতিয়ার বিক্রি করতে চাইবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সে ক্ষেত্রে ইজ়রায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে, যা হয়তো কখনওই চাইবে না কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
বর্তমানে বায়ুসেনার র্যাঙ্কিংয়ের নিরিখে বিশ্বে অষ্টম স্থানে রয়েছে মিশর। তাঁদের বহরে রয়েছে হাজারের বেশি লড়াকু জেট। এ ছাড়া কায়রোর বিমানবাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। পাশাপাশি, ২০ হাজার রিজ়ার্ভ সেনা রয়েছে ‘ফারাও’য়ের দেশের।