Janaki Ammal

Janaki Ammal: উদ্ভিদবিজ্ঞানে দেশের প্রথম মহিলা পিএইচডি, তাঁর আন্দোলনে পিছু হঠতে বাধ্য হয় সরকারও

যে সালে জানকী স্নাতক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে সময় এ দেশে তো বটেই, বিদেশেও নারীশিক্ষার হার অত্যন্ত কম।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২২ ১০:৫২
Share:
০১ ২২

সত্তরের দশকে কেরলের ৮.৩ বর্গ কিলোমিটারের বনাঞ্চলে একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে চেয়েছিল সে রাজ্যের সরকার। সরকারের দাবি ছিল, তাতে ঘাটতি মিটবে বিদ্যুতের। পাশাপাশি, রাজ্যের যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান হবে। তবে ৮০ বছরের এক লড়াকু বৃদ্ধার অনড় মনোভাবে কাছে হার মেনেছিল রাজ্য প্রশাসন।

০২ ২২

ওই বনাঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে পারেনি কেরল সরকার। বৃদ্ধা জানকী অম্মালের নেতৃত্বে স্থানীয়দের আন্দোলনে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসন। তাতে রক্ষা পেয়েছিল বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র। আজও এর কৃতিত্ব দেওয়া হয় জানকীকে।

Advertisement
০৩ ২২

সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক নামে পরিচিত ওই বনাঞ্চলে আজ রয়েছে বিশাল আকারের ম্যাককাস বাঁদর-সহ রয়েছে বহু বিপন্ন অর্কিড। সঙ্গে প্রায় হাজার প্রজাতির ফুলের গাছগাছড়া। এই সাফল্যের পিছনেও জানকীর হাত রয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।

০৪ ২২

এখন থেকে প্রায় ১২৮ বছর আগে ১৮৮৭ সালের ৪ নভেম্বর কেরলের তেলিচেরিতে (বর্তমানে যা পরিচিত তালাসেরি নামে) জন্ম হয়েছিল ইডাবলেট কক্কট জানকী অম্মালের। তাঁর বাবা ইকে কৃষ্ণণ ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির এক আদালতের বিচারক।

০৫ ২২

ভাইবোন মিলিয়ে জানকীরা ছিলেন ১৯ জন। তাঁদের সকলেরই সময় কাটত বাড়ির বাগানে। শখ করে সে বাগান করেছিলেন জানকীর বাবা। সেই সঙ্গে উত্তর মালাবার অঞ্চলের পাখিদের সম্পর্ক দু’টি বইও লিখেছিলেন তিনি। গাছপালা, পশুপাখির প্রতি বাবার এই টানই বোধহয় জানকীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। অন্তত, জানকীর ভাইঝি গীতার তেমনই দাবি।

০৬ ২২

একে একে ভাইবোনেদের সম্বন্ধ করে বিয়ে হলেও সে পথে পা বাড়াননি জানকী। তখনকার দিনে স্কুলের পড়াশোনার শেষে বিয়ের বদলে তিনি অন্য পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তৎকালীন মাদ্রাজের কুইন মেরি’জ কলেজ থেকে স্নাতক হন।

০৭ ২২

উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য জেদ বজায় রেখেছিলেন জানকী। স্নাতক হওয়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে সাম্মানিক ডিগ্রি লাভ করেন। সেটি ছিল ১৯১৩ সাল।

০৮ ২২

জানকীর এই ‘কীর্তিতে’ পরে ইতিহাসবিদ তথা তাঁর দুরসম্পর্কের ভাইঝি বিনীতা দামোদরণ একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিল— ‘জেন্ডার, রেস অ্যান্ড সায়েন্স ইন টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ইন ইন্ডিয়া’। বস্তুত, যে সালে জানকী স্নাতক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সে সময় এ দেশে তো বটেই, বিদেশেও নারীশিক্ষার হার ছিল বেশ কম।

০৯ ২২

স্নাতক হওয়ার পর তৎকালীন মাদ্রাজের ক্রিস্টিয়ান কলেজে তিন বছর শিক্ষকতা করেন জানকী। এর পর বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আসে। লেভি বারবারের নামে একটি স্কলারশিপের মাধ্যমে বিনামূল্যে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি।

১০ ২২

১৯২৪ সালে আমেরিকার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে পড়তে যান জানকী। বস্তুত, তাঁর মতো এশীয় মহিলাদের পড়াশোনার জন্যই ওই বিভাগটি তৈরি করেছিলেন লেভি।

১১ ২২

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় প্লান্ট সাইটোলজিতে মন বসিয়েছিলেন জানকী। এই বিদ্যায় গাছপালার জেনেটিক গঠন এবং জিনগত ধাঁচ বা বিন্যাস নিয়ে আলোকপাত করা হয়। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষা কাজে এসেছিল জানকীর।

১২ ২২

বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালির মধ্যে নিষেক করিয়ে নতুন হাইব্রিড প্রজাতি তৈরি করেছিলেন জানকী। ১৯২৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। ’৩১-এ ডক্টরেট হন। বস্তুত, তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন।

১৩ ২২

এ দেশে এসে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাজে লাগিয়েছিলেন জানকী। কোয়ম্বত্তূরে ইম্পেরিয়াল সুগারকেন ইনস্টিটিউট তখন জানকীর পারদর্শিতায় ভরসা রেখে নতুন এক জাতের আখ উৎপন্ন করতে সমর্থ হয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া থেকে আখ আমদানি করতে হত ভারতকে।

১৪ ২২

বস্তুত, জানকীর গবেষণার জেরেই এ দেশের আবহাওয়ায় ক্রস-ব্রিডের আখ উৎপন্ন করা করা গিয়েছিল। যাতে শর্করার মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল।

১৫ ২২

১৯৪০ সালে ইংল্যান্ডের নরফোকে গিয়ে জন ইনেস ইনস্টিটিউটে কাজ শুরু করেন জানকী। সেখানকার জিনোলজিস্ট সিরিল ডিন ডার্লিংটনের সঙ্গে তাঁর পাঁচ বছরের গবেষণার যৌথ ফসল— ‘ক্রোমোজোম অ্যাটলাস অব কাল্টিভেটেড প্লান্টস’। যে বইটি আজও উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রামাণ্য গ্রন্থ বলে মান্যতা পায়।

১৬ ২২

জানকী এবং সিরিলের ওই বইটিতে ১০ হাজার গাছের ক্রোমোজোম নম্বর লেখা রয়েছে। সেই সঙ্গে নিষেক এবং বিভিন্ন জাতের গাছগাছালির বিবর্তনের ধরনেরও উল্লেখ রয়েছে।

১৭ ২২

১৯৪৬ সালে নরফোকের ইনস্টিটিউট ছেড়ে লন্ডনের রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটিতে যোগ দেন জানকী। সে সময় তিনিই ছিলেন ওই ইনস্টিটিউটের প্রথম বেতনভোগী মহিলা সদস্য।

১৮ ২২

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে দেশে ফিরে আসেন জানকী। পরে বিনীতা লিখেছিলেন, ‘এ দেশের চাষবাসের কাজে উদ্ভিদবিজ্ঞানের চর্চা বাড়াতে তাঁর মতো গবেষকের প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে মনে করতেন নেহরু।’

১৯ ২২

লখনউতে সেন্ট্রাল বোটানিক্যাল ল্যাবরেটরির সুপারভাইজার পদে জানকীকে নিয়োগ করেছিলেন নেহরু। বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (বিএসআই)-র পুনর্গঠনে জানকীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। দেশীয় গাছগাছালি সংগ্রহ করা এবং তা নিয়ে সমীক্ষার জন্য ১৮৯০ সালে গঠিত হয়েছিল বিএসআই।

২০ ২২

বিএসআইতে কাজ করার সময় বিপন্ন দেশীয় গাছগাছালি রক্ষায় মন দিয়েছিলেন জানকী। দেশীয় গাছগাছালি সংগ্রহে স্থানীয়দের জ্ঞানের উপরেই ভরসা করতেন তিনি।

২১ ২২

জীবনের শেষ ভাগে পৌঁছে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান চর্চায় গঠিত সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের সায়েন্টিস্ট এমিরেটা নির্বাচিত হয়েছিলেন জানকী। তবে সে সময় একটি সাহসী পদক্ষেপও করেছিলেন। কেরলের বনাঞ্চলে হ্রদ তৈরি করে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছিলেন তিনি। জানকী লিখেছিলেন, ‘মনস্থির করে ফেলেছি। সাইলেন্ট ভ্যালিতে যেখানে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার জন্য কুন্তী নদীর জল দিয়ে হ্রদ তৈরি করা হবে। সেখানকার বনাঞ্চলের গাছগুলির ক্রোমোজোম-সার্ভে করব।’

২২ ২২

সাইলেন্ট ভ্যালি প্রকল্পের বিরুদ্ধে জানকীদের আন্দোলন অন্য মাত্রা পেয়েছিল। সত্তরের দশকে কেরল তথা ভারতে পরিবেশরক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল তা। সফল হয়েছিলেন জানকীরা। ক্রমাগত স্থানীয়দের বিক্ষোভের মুখে পড়ে ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর সে প্রকল্প বাতিল বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল কেরল সরকার। তবে তা দেখে যেতে পারেননি জানকী। প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করার ন’মাস আগে ৮৭ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
Advertisement
আরও গ্যালারি
Advertisement