উচ্চ বেতনের চাকরি বা কাজের খোঁজে ভারত থেকে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। কিন্তু, এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে বিস্ফোরক তথ্য। সমীক্ষকদের দাবি, পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেশগুলিতে বেশি করে চাকরি করতে যাচ্ছে এ দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক। কেন অতিরিক্ত রোজগারের জন্য জীবন বাজি রাখছেন তাঁরা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবার নয়াদিল্লির অর্থনীতির ‘অন্ধকার সত্যি’টা প্রকাশ্যে চলে এসেছে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্লেষকদের একাংশ।
বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত। কিন্তু তা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে কর্মসংস্থান। এ দেশের যুব সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ সম্মানজনক বেতনের কাজ বা চাকরি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। শুধু তা-ই নয়, সেই সুযোগও তাঁদের সামনে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। ফলে নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা বেশি রোজগারের আশায় আরও বেশি করে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
বেশ কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি খোলসা করেছেন সমীক্ষকেরা। তাঁদের দাবি, এ দেশের পিএইচডি উত্তীর্ণদেরও সরকারি দফতরে পিওন পদে আবেদন করতে দেখা গিয়েছে। গত বছর পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উত্তরপ্রদেশ সরকার। এতে মোট শূন্যপদ ছিল ৬০ হাজার। কিন্তু, ৪৮ লক্ষের বেশি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল বলে জানায় নিয়োগ পর্ষদ।
২০১৯ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশের কনস্টেবল পদে ৪৯ হাজার শূন্যপদের কথা উল্লেখ করেছিল উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। সে বার আবেদনকারীর সংখ্যা ১৯ লক্ষ ছাপিয়ে গিয়েছিল। স্টাফ সিলেকশান কমিশন বা এসএসসির ছবিটাও একই রকম করুণ। কয়েক বছর আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় চাকরির পরীক্ষা দিতে আবেদন করেন ৩৭ লক্ষ তরুণ-তরুণী। অন্য দিকে, শূন্যপদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ হাজার।
সমীক্ষকদের দাবি, ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রেও যে বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থান হচ্ছে, এমনটা নয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর এই বিষয়ে ডিগ্রি পাচ্ছেন ১৫ লক্ষ তরুণ-তরুণী। কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশের কপালে জুটছে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি। বাকিদের ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে অন্য জায়গায় চাকরি করতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ বা আইআইটিগুলিতেও কমেছে ক্যাম্পাস থেকে কাজ পাওয়ার সংখ্যা।
ভারতে কর্মসংস্থানের এ-হেন করুণ হালের কারণেই বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এ দেশের যুব সমাজের অনেকেই পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলিকে বেছে নিচ্ছেন। কারণ ইরাক, ইরান, সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইজ়রায়েলে চাকরি বা কাজ পাওয়ার বিপুল সুযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে খুব দ্রুত জড়িয়ে পড়তে পারছেন তাঁরা।
পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলিতে মূলত তেল সংস্থা এবং হোটেলে কাজ করতে ভারতীয়েরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। এ ছাড়া সৌদি আরবের মতো দেশে মরুভূমির মধ্যে তৈরি হচ্ছে আস্ত একটা শহর। আমিরশাহি এবং বাহরাইনে রিয়্যাল এস্টেট শিল্পের সূচক খুবই ঊর্ধ্বমুখী। আর তাই সেখানে ইঞ্জিনিয়ার থেকে শ্রমিক— যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন এ দেশের বাসিন্দারা। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার চিত্রটাও একই রকমের। অনেকে আবার সেখানে যাচ্ছেন ব্যবসা করতে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বিদেশে কর্মরত ভারতীয়েরা ঘরের মাটিতে চাকরির থেকে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারছেন। এই কারণেও পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ বা আমেরিকাকে নিজেদের ‘কর্মভূমি’ করে তুলছেন এ দেশের যুব সমাজের একাংশ। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিদেশে কাজ করলে বছরে ১০০ শতাংশ বেশি অর্থ আয় করছেন তাঁরা। পাশাপাশি, শ্রমের মর্যাদা থাকায় অতিরিক্ত সম্মানও জুটছে তাঁদের কপালে।
বর্তমানে কুয়েতের জনসংখ্যা প্রায় ৪২ লক্ষ। সমীক্ষকদের দাবি, আরব মুলুকটির ২১ শতাংশ জনগণই ভারতীয়। পাশাপাশি, সেখানকার তেল সংস্থাগুলিতে কর্মরতদের ৩০ শতাংশ এ দেশ থেকে গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। ইজ়রায়েলের চিত্রটি আরও চিত্তাকর্ষক। ইহুদিভূমির রাজধানী তেল আভিভে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখভালে নিযুক্ত পরিচারক বা পরিচারিকা মাসে পাচ্ছেন এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতে শ্রমিক সস্তা হওয়ায় এই বেতন পাওয়া সম্ভব নয়। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও নিচু স্তরের কর্মচারীদের মাসের রোজগার ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেখানে পশ্চিম এশিয়ার যে কোনও দেশে মাসে ন্যূনতম ৩০০ ডলার আয় করার সুযোগ রয়েছে। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় মাসে রোজগারের অঙ্ক দাঁড়াবে ২৫ হাজার ৭০০ টাকা।
এই পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থানের সমস্যা মেটাতে ভারত থেকে বিদেশে চাকরি বা কাজে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছে সরকারও। উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা প্রশাসন এবং ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এ ব্যাপারে খুবই উদ্যোগী। দেড় লক্ষের বেশি বেতনের চাকরি বা কাজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা। বিদেশে কাজের বাজারে ভারতের নির্মাণশ্রমিক, কারুশিল্পী এবং কলের মিস্ত্রিদের যথেষ্ট কদর রয়েছে।
কিন্তু, সমস্যা হল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেশে চাকরি বা কাজ করতে যাওয়ায় ভারতীয়দের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। এর পর থেকে গত তিন বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে চলছে যুদ্ধ। সংঘাতপর্বে মস্কোর বিরুদ্ধে ১২৬ জন ভারতীয়কে ফৌজে নিয়োগের অভিযোগ ওঠে। বেশি বেতনের লোভে বাহিনীতে যোগ দেয় তাঁরা। সংশ্লিষ্ট ভারতীয়দের রণাঙ্গনে যাওয়ার কথা ছিল না। বাস্তবে অবশ্য সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি ক্রেমলিন।
তবে বিষয়টি জানাজানি হতেই তৎপর হয় নয়াদিল্লি। যদিও তত দিনে বেশ কিছুটা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। ১২৬ জনের মধ্যে ইউক্রেনের রণাঙ্গনে প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। নিখোঁজ ১৬। বাকিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। পাশাপাশি, এই ধরনের নিয়োগ নিয়ে মস্কোকে সতর্ক করে সাউথ ব্লক। ক্রেমলিন অবশ্য ওই সময় নিজেদের ভুল স্বীকার করেছিল।
২০১৪ সালে ইরানের মসুল এলাকা থেকে ৪০ জন ভারতীয়কে অপহরণ করে কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইসিস)। কোনও মতে তাদের কবল থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন হরজিৎ মসিহা নামের এক ব্যক্তি। পরে ৩৮ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হলে ডিএনএ পরীক্ষা করে তাঁদের চিহ্নিত করে ভারত। অপহৃত এক জন শ্রমিকের এখনও পর্যন্ত কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া বিদেশে কাজ দেওয়ার নামে এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে প্রতারণার স্বীকার হওয়া ভারতীয়ের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কেউ কেউ আবার চোরাপথে আমেরিকা পৌঁছোতে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করছেন। জমি বিক্রি করে বা ঋণ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ গত কয়েক বছরে বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে, বলছেন সমীক্ষকেরা।
এই পরিস্থিতিতে অবশ্য হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই নয়াদিল্লি। বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে যুদ্ধ বাধলেই ভারতীয়দের নিরাপদে দেশে ফেরাতে তৎপর হচ্ছে কেন্দ্র। গত ১৩ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত চলা ইরান-ইজ়রায়েল সংঘর্ষ চলাকালীন ‘অপারেশন সিন্ধু’ চালায় মোদী সরকার। ফলে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পেরেছেন তিন থেকে চার হাজার ভারতীয়।
এ ছাড়া ২০১৫ সালে ইয়েমেনে যুদ্ধের সময় ‘অপারেশন রাহত’, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ‘অপারেশন গঙ্গা’ এবং ২০২৩ সালে সুদানের গৃহযুদ্ধের সময় ‘অপারেশন কাবেরী’ চালিয়ে সেখান থেকে বাসিন্দাদের দেশে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে নয়াদিল্লি। ১৯৯০ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মোট ১ লক্ষ ৭০ হাজার ভারতীয়কে ‘এয়ারলিফ্ট’ করে ঘরে ফেরায় কেন্দ্র।
কর্মসংস্থানের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে দু’মুখী নীতিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। প্রথমত, ঘরের মাটিতে কাজের পরিমাণ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে বলেছেন তাঁরা। অর্থাৎ, মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) পাশাপাশি মাথাপিছু গড় আয়ের সূচক ঊর্ধ্বমুখী করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
দ্বিতীয়ত, বিদেশে কর্মরতদের নিরাপত্তার দিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এর জন্য ‘ফিলিপিন্স মডেল’ অনুসরণ করতে পারে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে ভিন্রাষ্ট্রে চাকরি বা অন্য কোনও কাজে যাওয়া ভারতীয়দের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখতে হবে সেখানকার দূতাবাসকে। এতে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে যাবেন তাঁরা।
ভারতীয়দের বিদেশে চাকরি বা কাজ করতে পাঠানোর নেপথ্যে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। কারণ, দেশের অর্থনীতির উপরে রয়েছে এর সুদৃঢ় প্রভাব। বিদেশ থেকে রোজগারের অর্থ প্রায়ই বাড়িতে পাঠান তাঁরা। ফলে এখানকার বহু পরিবারের বাড়ছে আর্থিক সচ্ছলতা। তবে অতিরিক্ত বেতন এবং শ্রমের মর্যাদার কারণে যুদ্ধ জড়িয়ে পড়া দেশে কাজ করতে যেতে সাধারণত আপত্তি করছেন না এ দেশের নাগরিকেরা। এটা অর্থনীতির পক্ষে ভাল ইঙ্গিত নয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।