বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হস্টেলে অসাধ্যসাধন! বছর ২০-র তরুণ যুগলের হাতযশে অভিভূত ভারতীয় সেনা। ফৌজের জন্য আত্মঘাতী ড্রোন তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন তাঁরা। দু’জনের মধ্যে এক জন আবার খাঁটি বাঙালি, বাড়ি কলকাতায়। ইতিমধ্যেই স্টার্টআপ উদ্যোগপতিদের তালিকায় নাম ওঠে ওই পড়ুয়া যুগলের। আগামী দিনে তাঁরা বাহিনীকে আরও ঘাতক হাতিয়ার উপহার দেবেন বলে আশাবাদী খোদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
জয়ন্ত খত্রী এবং শৌর্য চৌধুরী। হায়দরাবাদের ‘বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজ়ি অ্যান্ড সায়েন্স’ বা বিআইটিএস পিলানি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পড়ুয়া যুগলকে সামরিক ড্রোন প্রযুক্তির ‘জাদুকর’ বললে অত্যুক্তি হবে না। হস্টেলের ঘরে বসে সামান্য কিছু সরঞ্জাম ব্যবহার করে আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যান বানিয়েছেন তাঁরা। বর্তমানে তাঁদের তৈরি ড্রোন জম্মু, হরিয়ানার চণ্ডীমন্দির, বাংলার পানাগড় এবং অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় মোতায়েন করেছে ভারতীয় ফৌজ।
বিআইটিএস পিলানি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই প্রতিভাবান পড়ুয়া যুগল যে একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন, এমনটা নয়। কলকাতার শৌর্য ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। রাজস্থানের অজমেঢ়বাসী জয়ন্তের বিষয় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ভারতীয় সেনাকে ড্রোন সরবরাহের পাশাপাশি মাস দুই আগে একটি স্টার্টআপ শুরু করেছেন তাঁরা, নাম ‘অ্যাপলিয়ন ডায়নামিক্স’।
হস্টেলের ঘরে শৌর্য-জয়ন্তের হাতে গড়া ড্রোনের সেনাছাউনি পর্যন্ত রূপকথার যাত্রাপথ কিন্তু একেবারেই মসৃণ নয়। গণমাধ্যমের কাছে এই স্বপ্নপূরণের কথা বলতে গিয়ে বেশ আবেগতাড়িত ছিলেন মরুরাজ্যের খত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘ড্রোন তৈরির কাজ পুরোপুরি শেষ হলে অনেককে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। হঠাৎই তাতে সাড়া দেন ভারতীয় সেনার এক কর্নেল। পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীর জন্য চণ্ডীগঢ়ে ডেকে পাঠান তিনি।’’ এর পর আর এই পড়ুয়া যুগলকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
চণ্ডীগঢ়ে সেনা অফিসারদের সামনে দু’টি ড্রোন প্রদর্শন করেন শৌর্য ও জয়ন্ত। তার মধ্যে একটি ছিল আত্মঘাতী শ্রেণির (পড়ুন কামিকাজ়ে)। অপরটি নজরদারির। পরীক্ষামূলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির পারফরম্যান্সে মুগ্ধ ছিলেন ফৌজি জেনারেলরা। আর তাই কামিকাজ়ে ড্রোনের দ্বিতীয় স্তরের পরীক্ষার জন্য হায়দরাবাদের পড়ুয়া যুগলকে ডেকে পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা। অন্যাদিক ওখান থেকেই বাহিনীকে নজরদারি ড্রোন সরবরাহের বরাত পেয়ে যান জয়ন্ত ও শৌর্য।
বিআইটিএস পিলানির পড়ুয়া যুগলের ড্রোনে ভারতীয় সেনার চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, আকারে অনেকটাই ছোট হওয়ায় এগুলি ধরা পড়ে না বললেই চলে। ঘণ্টায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এগুলির। অর্থাৎ, বাজারে থাকা এই শ্রেণির ড্রোনগুলির নিরিখে গতিবেগ প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
শৌর্য বলেছেন, ‘‘চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই আত্মঘাতী ড্রোনটিকে পুরোপুরি ফৌজের প্রয়োজন মতো তৈরি করে ফেলতে পারব আমরা। এটি এক কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারবে। শুধু তা-ই নয়, কিছু অপ্রচলিত যন্ত্রাংশের সাহায্যে ঘরে বসেই সংশ্লিষ্ট ড্রোন তৈরি করা যাবে। এর জন্য বড় কারখানার সে ভাবে প্রয়োজন নেই।’’
হায়দরাবাদের বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে খবর, রোবোটিক্সের প্রতি আগ্রহ থেকে ধীরে ধীরে শৌর্য ও জয়ন্তের মধ্যে গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। প্রথম থেকেই ফৌজি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার একটা নেশা ছিল তাঁদের। এই উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সংক্রান্ত একটি ক্লাব চালু করেন তাঁরা। স্টার্টআপ সূচনার নীল নকশাও তৈরি হয় সেখানে।
‘অ্যাপলিয়ন ডায়নামিক্স’-এ সামরিক ড্রোন নিয়ে কাজ করছেন হায়দরাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির দ্বিতীয় বর্ষের অন্তত ছ’জন পড়ুয়া। উল্লম্ব ভাবে ওঠানামায় সক্ষম মানববিহীন উড়ুক্কু যান তৈরিতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছেন তাঁরা। চলছে স্থায়ী ডানাওয়ালা (পড়ুন ফিক্সড উইং) ড্রোন তৈরির কাজও। কারণ, ফৌজকে শুধুমাত্র আত্মঘাতী ড্রোন সরবরাহ করে ক্ষান্ত থাকতে নারাজ জয়ন্ত এবং শৌর্য।
এর পাশাপাশি কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) ব্যবহার করে ড্রোনকে আরও ঘাতক করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে ‘অ্যাপলিয়ন ডায়নামিক্স’-এর। স্টার্টআপটির সঙ্গে জড়িতেরা মাঝেমধ্যেই সেনাবাহিনীর জওয়ান এবং অফিসারদের ড্রোন সংক্রান্ত নানা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। জয়ন্ত ও শৌর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিআইটিএস পিলানির অধ্যাপক সঙ্কেত গোয়েল।
অন্য দিকে, চলতি মাসে অন্ধ্রপ্রদেশের কুর্নুলের ‘ন্যাশনাল ওপেন এরিয়া রেঞ্জ’ বা এনওএআরে ড্রোন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালায় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। হাতিয়ারটির পোশাকি নাম ‘আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকল লঞ্চড প্রিসিশন গাইডেড মিসাইল-ভ্যারিয়্যান্ট ৩’ বা ইউএলপিজিএম-ভি৩।
এর আগেও এই শ্রেণির একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে বাহিনীকে সরবরাহ করেছে ডিআরডিও। ইউএলপিজিএম-ভি৩ তার উন্নত সংস্করণ বলে জানা গিয়েছে। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক হাই-ডেফিনেশন ডুয়াল-চ্যানেল সিকার। ফলে বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র। এ ছাড়া যে কোনও পরিবেশে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে এর।
মূলত সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং বাঙ্কারকে ধ্বংস করার কথা মাথায় রেখে ইউএলপিজিএম-ভি৩ তৈরি করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ক্ষেপণাস্ত্রটিতে তিন ধরনের আলাদা আলাদা শ্রেণির ওয়ারহেড বহনের সক্ষমতা রয়েছে। বাঙ্কারের ক্ষেত্রে কিছুটা মাটির গভীরে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এই মারণাস্ত্র।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, যে ড্রোন থেকে ইউএলপিজিএম-ভি৩ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তার নির্মাণকারী সংস্থা বেঙ্গালুরুর স্টার্টআপ ‘নিউস্পেস রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজ়িস’। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ওই মানববিহীন উড়ুক্কু যানটি তৈরি করেছে তারা। অর্থাৎ, বাহিনীর জন্য বিপুল পরিমাণে হাতিয়ারটির উৎপাদন শুরু হলে পুরোটাই ঘরের মাটিতে করতে পারবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
বর্তমান ড্রোন থেকে উৎক্ষেপণকারী ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চালাচ্ছে ডিআরডিও। তাদের এই প্রকল্পের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে আদানি ডিফেন্স এবং ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেডের নাম। এ ছাড়া ছোট ও মাঝারি মিলিয়ে ৩০টির বেশি স্টার্টআপ সংস্থা এতে বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহের কাজ করছে বলে জানা গিয়েছে।
ডিআরডিও-র ড্রোন থেকে উৎক্ষেপণকারী ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার ছবি ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, ‘‘হাতিয়ার তৈরিতে আত্মনির্ভর হওয়ার পথে বেসরকারি এবং স্টার্টআপ সংস্থাগুলির অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এটা সত্যিই প্রশংসনীয়।’’
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সঙ্গে চলা সংঘর্ষে ভারতীয় ড্রোনের পরাক্রম প্রত্যক্ষ করে বিশ্ব। সূত্রের খবর, ওই সংঘাতে ইজ়রায়েলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি স্কাইস্ট্রাইকার আত্মঘাতী মানববিহীন যানটির বহুল ব্যবহার করে সেনা। পাক ভূমির একাধিক জঙ্গি ঘাঁটিতে এগুলি আছড়ে পড়েছিল।
২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ফৌজি অভিযানগুলিতে ড্রোনের ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়তে শুরু করে। ২০২৩ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বর্তমানে যুদ্ধ বা জঙ্গি দমন অভিযানে মানববিহীন উড়ুক্কু যানের ব্যবহার ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এত দিন পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সক্ষম ড্রোন ছিল আমেরিকা, রাশিয়া, চিন এবং তুরস্ক-সহ হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কাছে। এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হল ভারতের নামও।