Bengaluru River Rejuvenation

‘কালকূট’ বিষে ভরা জল গলায় গেলেই সর্বনাশ! ‘ভূতুড়ে নদী’র পুনর্জন্মে মিটবে ভারতের সিলিকন ভ্যালির তৃষ্ণা?

‘দক্ষিণের গঙ্গা’ হিসাবে পরিচিত কাবেরীর অন্যতম উপনদী আর্কাবতীর পুনরুজ্জীবনে বড় প্রকল্পের ঘোষণা করেছে কংগ্রেস শাসিত কর্নাটক সরকার। একটা সময়ে বেঙ্গালুরু শহরের মূল পানীয় জলের উৎস ছিল এই নদী।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৫ ১৭:৩৯
Share:
০১ ২০

শহরের গা ঘেঁষে বইছে ‘ভূতুড়ে নদী’, যার জলে মিশে আছে ‘কালকূট’ বিষ! এ-হেন স্রোতস্বিনীকে গরল-মুক্ত করার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়েছে সরকার। সেই লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। জটিল এই কর্মযজ্ঞে প্রশাসনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে একাধিক বেসরকারি সংস্থা। সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় সাফল্য এলে ভারতে ‘নদী বাঁচাও’ প্রকল্পগুলি যে নতুন দিশা পাবে, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ২০

কর্নাটকের ওই ‘ভূতুড়ে নদী’র নাম আর্কাবতী। একসময়ে এতে প্রবাহিত হত কাচের মতো স্বচ্ছ পরিষ্কার জল, যা পানীয় হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা ছিল না রাজধানী বেঙ্গালুরুর বাসিন্দাদের। শুধু তা-ই নয়, আর্কাবতীতে স্নানও করতেন বহু মানুষ। কিন্তু, এখন সে সবই ইতিহাস। সংশ্লিষ্ট নদীটির জলে বিষের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন সেখানকার সরকার।

Advertisement
০৩ ২০

কর্নাটকের নন্দী পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে চিক্কাবালাপুর জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ৫৩ কিলোমিটার লম্বা আর্কাবতী। শেষে বেঙ্গালুরুর পায়ের কাছে কনকাপুরায় পৌঁছে ‘দক্ষিণের গঙ্গা’ হিসাবে পরিচিত কাবেরীতে গিয়ে মিশেছে এই নদী। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ১,৪০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত আর্কাবতীর অববাহিকায় রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সংস্থা, কৃষিজমি এবং আবাসন।

০৪ ২০

প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ১৯৩৪ সালে থিপ্পাগোন্ডানাহল্লিতে আর্কাবতীর উপরে বাঁধ ও জলাধার তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার। এতে বেঙ্গালুরুর পানীয় জলের সমস্যা অনেকাংশেই মিটে গিয়েছিল। ১৯৩৬ সালে ওই জলাধার থেকে দক্ষিণের শহরটিতে শুরু হয় পানীয় জলের সরবরাহ, যা ২০০০ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলেছে। এর জন্য মাঝের বছরগুলিতে অবশ্য বেশ কয়েক বার ব্যারিকেড টপকাতে হয়েছে স্থানীয় সেচ দফতরকে।

০৫ ২০

১৯৭০-এর দশকে প্রথম বার আর্কাবতীর জলপ্রবাহে বড় পতন লক্ষ করে কর্নাটক প্রশাসন। ওই সময় থেকে ধীরে ধীরে বেঙ্গালুরুতে বাড়তে থাকে জলসঙ্কট। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানতে পারেন, নদীখাতের বিভিন্ন এলাকা বেআইনি ভাবে জবরদখল হয়ে গিয়েছে। ফলে সরু হয়ে গিয়ে অনেক জায়গায় শুকিয়ে মরে গিয়েছে নদী।

০৬ ২০

২১ শতকের গোড়ায় দ্বিতীয় বিপদটি টের পায় কর্নাটক প্রশাসন। বেঙ্গালুরুর ‘প্রাণশক্তি’ হিসাবে পরিচিত আর্কাবতীর জল মাত্রাতিরিক্ত দূষিত হয়ে গিয়েছে বলে জানতে পারে তারা। তড়িঘড়ি নদীটির অববাহিকায় একটি সমীক্ষা চালায় সেখানকার সরকার। সেই রিপোর্ট হাতে আসতেই চোখ কপালে ওঠে সকলের।

০৭ ২০

আর্কাবতীকে নিয়ে করা সমীক্ষায় জানা যায়, নদীটির জল বিষিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল শিল্প সংস্থার থেকে বেরিয়ে আসা রাসায়নিক বর্জ্য। একাধিক জায়গায় তা সরাসরি এসে মিশছে নদীর জলে। এ ছাড়া বেঙ্গালুরু শহরের পয়ঃপ্রণালীও আর্কাবতীর সঙ্গে যুক্ত। ফলে মানব বর্জ্য, প্লাস্টিক এবং অন্যান্য ফেলে দেওয়া সামগ্রীও শেষ পর্যন্ত এসে পড়ছে ওই নদীতেই।

০৮ ২০

সেচ দফতরের শীর্ষকর্তাদের বড় অংশই আর্কাবতীর ‘মৃত্যু’র জন্য কঠিন বর্জ্যকে দায়ী করেছেন। তবে শিল্প সংস্থাগুলিকে বাদ দিলে অবিবেচকের মতো বৃক্ষরোপণও সংশ্লিষ্ট নদীটির শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। একটা সময়ে সবুজায়ন এবং আর্থিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে কাবেরীর অন্যতম প্রধান উপনদীটির তীর ধরে বসানো হয় ইউক্যালিপট্যাস গাছ। এতে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত।

০৯ ২০

ইউক্যালিপট্যাসের বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর জলের, যার জোগান আর্কাবতী থেকেই দেওয়া হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ দখলদারির জন্য সরু হতে থাকে নদীখাত। অন্য দিকে, ইউক্যালিপট্যাস রোপণ বন্ধ হয়নি। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এর জেরে জলের অপচয়ও ওই এলাকায় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

১০ ২০

বর্তমানে আর্কাবতীর উপরে ছোট-বড় মিলিয়ে রয়েছে ৪০০-র বেশি অস্থায়ী বাঁধ। উন্নত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সেগুলি তৈরি করেছে স্থানীয় কৃষক সমাজ। কিন্তু, এর জেরে দিন দিন নেমে গিয়েছে নদীর জলস্তর। গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো, নদী তীরবর্তী আধা শহরগুলিতে রয়েছে নলকূপের রমরমা, যার জেরে হ্রাস হু-হু করে হ্রাস পেয়েছে ভূর্গভস্থ জলস্তর।

১১ ২০

এই সব কিছুর জেরে আর্কাবতীর জল মুখে তোলার অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। সব সময়েই তার থেকে বার হয় উৎকট গন্ধ। কিছু কিছু জায়গায় জল প্রায় বদলে গিয়েছে অ্যাসিডে। ফলে এতে স্নান করলেই দেখা দিচ্ছে চর্মরোগ। আর তাই সংশ্লিষ্ট নদীটিতে নামা বা এর জল পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা একরকম বন্ধ করে দিয়েছে কর্নাটক সরকার।

১২ ২০

গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) গোড়ায় আর্কাবতীর জলের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালায় আইআইটি মাদ্রাজ এবং ‘পানি ডট আর্থ’ নামের একটি সংস্থা। সেখান থেকে জানা যায় যে সংশ্লিষ্ট জলে বিপজ্জনক মাত্রায় মিশে আছে ফসফরাস এবং শিল্পজাত রাসায়নিক। ফলে আর্কাবতীর জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমেছে কয়েক গুণ। এর জেরে নদীটি বিষাক্ত জলজ উদ্ভিদ এবং ব্যাকটেরিয়ার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

১৩ ২০

আর্কাবতীর কিছু অংশের জল অবশ্য এখনও স্বচ্ছ রয়েছে। কিন্তু, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পর আইআইটি মাদ্রাজ সেটাও পানের অনুপযুক্ত বলে জানিয়ে দিয়েছে। ২০০৩ সালে থিপ্পাগোন্ডানাহল্লি জলাধার রক্ষায় বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্নাটক সরকার। যদিও তাতে তেমন কোনও লাভ হয়নি। ২০২২ সাল থেকে সম্পূর্ণ নদীটিকে দূষণমুক্ত করার পরিকল্পনা শুরু করে সেখানকার প্রশাসন।

১৪ ২০

চলতি বছরের জুনে ‘ভূতুড়ে নদী’র পুনরুজ্জীবনের জন্য একটি মেগা প্রকল্প ঘোষণা করে কংগ্রেস শাসিত কর্নাটকের সিদ্দারামাইয়া সরকার। ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ বা পিপিপি মডেলে তাতে কাজ হবে বলে জানিয়েছে তারা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে জড়িত থাকবে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও।

১৫ ২০

আর্কাবতীকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রথমেই একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি করেছে কর্নাটক সরকার। তাতে রয়েছেন একাধিক পরিবেশবিদ এবং নদী বিশেষজ্ঞ। তাঁদের দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি কী ভাবে কাজ করবে তার নীলনকশা তৈরি করবে প্রশাসন। নদীকে বাঁচাতে কী কী বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, সেই পরামর্শও নেওয়া হবে বিশ্লেষকদের থেকে।

১৬ ২০

এ ছাড়া আর্কাবতী নদী অববাহিকার একটি বিস্তারিত সমীক্ষা রিপোর্টও তৈরি করছে কর্নাটক সরকার। এতে নদীর ঠিক কোন কোন অংশে শিল্প বর্জ্য মিশছে, নদীখাতে জলস্তর কোথায় কম, কোথায় বেশি— এই ধরনের যাবতীয় তথ্য থাকবে। এর জন্য ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ছবির উপরে ভিত্তি করে মানচিত্র তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের।

১৭ ২০

সূত্রের খবর, আর্কাবতী উদ্ধারে বেশ কিছু কঠিন পদক্ষেপ করতে পারে কর্নাটক সরকার। নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা শিল্প সংস্থাগুলিকে বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র বসানোর জন্য ইতিমধ্যেই চাপ দিতে শুরু করেছে সেখানকার প্রশাসন। পাশাপাশি, আর্কাবতী সংলগ্ন আধা শহরগুলিতে বেশ কিছু নলকূপ বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

১৮ ২০

কর্নাটক সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুযায়ী, ডোডাবাল্লাপুরা এবং বেসিত্তিহাইলিতে সংশ্লিষ্ট নদীটির জলে মিশছে সর্বাধিক বিষাক্ত রাসায়নিক। কারণ, এই দু’টি এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিত। সেখানে অত্যাধুনিক বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সিদ্দারামাইয়া প্রশাসনের।

১৯ ২০

আর্কাবতী পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের বাস্তবায়ন মোটেই সহজ নয়। কারণ, নদীটির অববাহিকা এলাকা যথেষ্ট ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে সেখানে বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র তৈরির ক্ষেত্রে জমি পেতে সমস্যার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনিক কড়া পদক্ষেপের জেরে বন্ধ হতে পারে একাধিক শিল্প সংস্থা। এতে রাজ্যে বাড়বে বেকারত্ব।

২০ ২০

যদিও তার পরেও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী সিদ্দারামাইয়া সরকার। গত জুনে বেঙ্গালুরু জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন বোর্ডের চেয়ারম্যান রাম প্রসাত মনোহর বলেন, ‘‘গোটা অববাহিকার মাত্র ১৫ শতাংশ জমি পেলেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে সফল করা যাবে। এই শহরকে আমার জলশূন্য হতে দিতে পারি না। সমস্যাটা সকলের। ফলে আমজনতার সমর্থন প্রশাসনিক স্তরে পাব বলেই আশা রাখছি।’’

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement