১৯৯০ সালে সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সরলা ভট্ট হত্যা মামলা। এক কাশ্মীরি হিন্দু নার্স সরলাকে গণধর্ষণের পর নির্মম ভাবে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছিল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে। সেই নৃশংসতায় কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ। ৩৫ বছর পর সেই মামলাটি পুনরায় চালু করার নির্দেশ এসেছে। সেই ঘটনায় আশায় বুক বাঁধছেন অত্যাচারিত শয়ে শয়ে কাশ্মীরি পরিবার।
৩৫ বছর আগে, ১৯৯০ সালের ১৮ এপ্রিল অনন্তনাগের ২৭ বছর বয়সি কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের কন্যাকে অপহরণ করা হয়েছিল। পরের দিন সকালে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সৌরার উমর কলোনির মল্লাবাগে রাস্তার ধারে তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে সরলাকে ধর্ষণ ও অমানুষিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
তিন দশক ধরে ধামাচাপা পড়ে থাকা মামলার ফাইলে নতুন করে হাত পড়েছে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ এবং রাজ্য তদন্ত সংস্থার (এসআইএ)। সরলা ভট্টের অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলায় মঙ্গলবার শ্রীনগরের ন’টি পৃথক পৃথক জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে বলে খবর। পুলিশ এবং সিআরপিএফ জওয়ানের যৌথ সহায়তায় বিভিন্ন সন্দেহজনক স্থানে অভিযান চালায় এসআইএ।
তল্লাশি অভিযানের তালিকায় রয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বাসস্থানও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রাক্তন জেকেএলএফ নেতা পীর নূরুল হক শাহ ওরফে ‘এয়ার মার্শাল’-এর বাড়িও। এসআইএ জানিয়েছে যে, তারা সরলা হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত ‘অপরাধমূলক প্রমাণ’ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে।
১৯৯০ সালে সারা দেশ সাক্ষী ছিল স্বাধীন ভারতে উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনার। পৈতৃক প্রাণটুকু রক্ষা করার তাগিদে কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজের একাংশ ভিটেমাটি, জীবিকা ছেড়ে একবস্ত্রে ভিন্রাজ্যে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায় তিন লক্ষ কাশ্মীরি কয়েক রাতের মধ্যে উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছিলেন। আশ্রয় পেয়েছিলেন দিল্লি বা জম্মুর আশ্রয় শিবিরে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে উপত্যকায় কাশ্মীরি পণ্ডিত বিতাড়ন-পর্বে খুন হয়েছিলেন বহু পণ্ডিত। ১৯৮৯ সালের ৪ নভেম্বর বিচারক নীলকান্ত গঞ্জুকে শ্রীনগর হাই কোর্টের কাছে ভরা বাজারে গুলি করে হত্যা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা।
জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা মোহম্মদ মকবুল ভাটকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন নীলকান্ত। দায়রা আদালতের বিচারক থাকাকালীন ১৯৬৬ সালে পুলিশ আধিকারিক অমর চাঁদ হত্যার দায়ে মকবুলের সাজা ঘোষণা করেছিলেন নীলকান্ত।
সেই বছরের ডিসেম্বরে জেকেএলএফ জঙ্গিরা তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুফ্তি মহম্মদ সঈদের কন্যা রুবাইয়া সঈদকে অপহরণ করে। জেকেএলএফ এবং ইসলামি জঙ্গিরা সমস্ত কাশ্মীরিকে ইসলামিক নিয়ম মেনে চলার জন্য হুমকি দিতে থাকে।
১৯৯০ সালের গোড়া থেকেই ধারাবাহিক ভাবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একের পর এক নিশানা করতে শুরু করে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি। ২ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগরের হাব্বা কাদালে বাড়ির কাছে সতীশ টিকু নামে এক তরুণ হিন্দু সমাজকর্মীকে খুন করা হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীনগর দূরদর্শনের স্টেশন ডিরেক্টর লাসা কাউলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৯ এপ্রিল সর্বানন্দ কুলপ্রেমী নামে একজন প্রবীণ কাশ্মীরি কবি এবং তাঁর ছেলেকে বাড়িতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।
এ সবের মধ্যে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন সরলা। শ্রীনগরের সৌরায় অবস্থিত শের-ই-কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের নার্স ছিলেন তিনি। অবিবাহিতা এই তরুণীর পরিবারে ছিলেন বাবা-মা ও ভাই-বোন। সরলার উপর ভরসা করতেন গোটা পরিবার। মহিলাদের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সরলা অকুতোভয় ছিলেন।
আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত কাশ্মীর জুড়ে সন্ত্রাসবাদ, খুন, মৌলবাদের সাঁড়াশিচাপে কোণঠাসা হয়ে যায় কাশ্মীরি হিন্দু, বিশেষত পণ্ডিত সম্প্রদায়। চতুর্দিকে পালাই পালাই রব। বিপদ শিয়রে শমন পাঠালেও বিচলিত হননি পণ্ডিত পরিবারের মেয়ে সরলা। বহু বার তাঁকে সন্ত্রাসবাদীদের হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সেই সমস্ত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
হস্টেলে ঢুকে সরলাকে সতর্ক করে যেত মৌলবাদীরা। তাঁকে সত্বর কাশ্মীর ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিতে থাকে তারা। জেকেএলএফের জঙ্গিরাই মূলত এই হুমকি দিতে আসত বলে অভিযোগ। এ ভাবেই চলছিল সরলার লড়াই। ১৯৯০ সালের ১৪ এপ্রিল শেষ বারের মতো হাসপাতালের হাব্বা খাতুন হস্টেলে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
সে দিন রাতে হস্টেলের ভিতর থেকে সরলাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় কয়েক জন দুষ্কৃতী। অভিযোগের তির ছিল জেকেএলএফের জঙ্গিদের দিকেই। তার কয়েক দিন পর মল্লাবাগের রাস্তায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় সরলার দেহ। এই বর্বরতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা কাশ্মীর। ক্ষোভ বাড়লেও মৌলবাদীদের ভয়ে দেহ দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন স্থানীয়েরা।
সরলার মুখে কাপড় গোঁজা ছিল। দেহে ছিল একাধিক বুলেটের ক্ষত। অত্যাচার ও নির্যাতনের চিহ্ন দগদগে হয়ে ফুটেছিল তরুণী সরলার গোটা দেহে। যে কয়েক দিন নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেই ক’দিন টানা অকথ্য নিগ্রহের মুখোমুখি হতে হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ ও হুমকির মুখে মাথা না নোয়ানো এই তরুণীকে। খুনিরা তাঁর দেহে একটি চিরকুট রেখে যায় যেখানে তাকে ‘পুলিশের তথ্যদাতা’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
বিজেপি নেতা অমিত মালবীয় দাবি করেছেন যে সরলাকে ‘গণধর্ষণ’ করা হয়েছিল। তার পর তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে দেওয়া হয়। জেকেএলএফের তিন জঙ্গি তাঁকে গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
নিগিন থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। সরলাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি মদতপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনটি। অন্তিম সংস্কারের সময় দেড়শো অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি জমা হন শ্মশানে। সরলার দেহের অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করতে যাওয়ার সময় সরলার পরিবারের সদস্যদের উপর পাথরবৃষ্টি করা হয়েছিল। কোনও মতে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন তাঁরা।
তার পরেও এই পরিবারটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য উঠেপড়ে লাগে জঙ্গিরা। বোমা ছুড়ে বাড়ি উড়িয়ে দেওয়ারও চেষ্টা হয়। সরলা ভট্টের মামলাটি কয়েক দশক ধরে স্থগিত ছিল। গত বছর এসআইএ মামলাটি গ্রহণ করে।
২০০৮ সালে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কতগুলি মামলা দায়ের হয়েছিল সেই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ১৯৮৯ সাল থেকে জঙ্গিরা ২০৯ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ। এর মধ্যে ১৯৯০ সালেই ১০৩ জনকে হত্যা করা হয়। তবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দাবি, সেই সংখ্যাটি আরও বেশি।