হৃদ্যন্ত্রের ত্রুটি মেরামত করতে বাইপাস সার্জারির মতো অস্ত্রোপচার করতে বিদেশের কোনও হাসপাতালে ভর্তি হলে অন্তত ১৫-২০ লাখ টাকার ধাক্কা। ভারতে সেই অস্ত্রোপচারের খরচ তুলনায় নামমাত্র। বেসরকারি হাসপাতালে দু’লক্ষ টাকা খরচে এক জন রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব। অন্য দিকে, কোমরের হাড় প্রতিস্থাপন করার খরচ আমেরিকা, ইংল্যান্ডের মতো দেশে ৩৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
সেখানে একই পরিষেবা ভারতের নামীদামি হাসপাতালে মেলে ৬ লক্ষ টাকায়। উচ্চমানের পরিষেবা অথচ নামমাত্র মূল্যে। নানা জটিল অস্ত্রোপচারে অন্যান্য দেশে যা খরচ হতে পারে, তার প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ খরচে ভারতের বিভিন্ন শহরের হাসপাতালে উন্নত পরিষেবা মেলে। তাই ধীরে ধীরে ভারতীয় রাজ্যের হাসপাতালগুলি আন্তর্জাতিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠছে।
উন্নত দেশগুলিতে চিকিৎসার খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় অনেকেই উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার জন্য অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিকল্প খুঁজছেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারত একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে, যেখানে চিকিৎসা পরিষেবা যেমন উন্নত, তেমনই তুলনামূলক ভাবে সাশ্রয়ী।
এশিয়ার সেরা কিছু মাল্টিস্পেশ্যালিটি এবং সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতাল রয়েছে ভারতে। প্রতিবেশী দেশ বাদ দিয়ে পশ্চিম এশিয়া, মরিশাস, মলদ্বীপ ও আফ্রিকার মতো দেশগুলি থেকে আসা রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র ঘুরতে আসা নয়, স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার জন্যও এ দেশে আসতে শুরু করেছেন অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা।
ভারতে বিশ্বমানের চিকিৎসা ও সুস্থতার সুযোগসুবিধা সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। এই পরিষেবা বিদেশিদের আকৃষ্ট করার প্রধান কারণ। একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৪ সালে ভারতে প্রায় ৭০ লক্ষ বিদেশি রোগী চিকিৎসা পরিষেবা নিতে হাজির হয়েছিলেন।
মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লি-সহ দেশের অনেক শহরই বিভিন্ন চিকিৎসার জন্য জনপ্রিয়। এই সব শহর ঘিরে ভারতে ‘চিকিৎসা পর্যটন’-এর রমরমা। প্রকাণ্ড ঘরে চোখধাঁধানো অন্দরসজ্জা। হোম থিয়েটার, ওয়াইফাই, ল্যাপটপ, রেফ্রিজারেটর, গদিআঁটা সোফা— কোনও কিছুরই অভাব নেই। এমনকি রোজকার কাজকর্মে সহায়তা করার জন্য লোকও থাকেন। গুরুগ্রামের একটি হাসপাতালে জাকুজ়ি, স্পা, ৪০ আসনের সিনেমাহল, শপিং মল পর্যন্ত আছে।
এ পরিষেবা বিলাসবহুল হোটেলের নয়, হাসপাতালের। দেশের বিভিন্ন কর্পোরেট হাসপাতাল এখন এমন বিলাসবহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হাজির। দিল্লি-মুম্বইয়ের মতো শহরে মোটা টাকার বিনিময়ে বিলাসবহুল স্বাস্থ্য পরিষেবা কেনা যায়। চিকিৎসা পরিষেবার কাজের সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, ‘মেডিক্যাল টুরিজ়ম’ চাঙ্গা করতেও এই ‘বিলাসবহুল পরিষেবা’ জরুরি।
পরিসংখ্যান বলছে, যে দশটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসা করাতে আসেন, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। এ ছাড়া ওই তালিকায় রয়েছে ইরাক, ইয়েমেন, ওমান, মলদ্বীপ, সুদান, কেনিয়া, নাইজ়েরিয়া, তানজ়ানিয়া, মায়ানমার। অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসার জন্য উন্নত দেশগুলিও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারছে না ভারতের থেকে। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে উড়ে আসছেন রোগীরা।
খরচ ছাড়াও ভারতে উন্নত ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর ভরসা করতে শুরু করেছেন বিদেশিরা। হাসপাতালগুলিতে আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং সাম্প্রতিক রোগ নির্ণয়ের সরঞ্জাম থাকার কারণে অস্ত্রোপচারে সাফল্যের হারও যথেষ্ট। অস্ত্রোপচারে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। জটিল অস্ত্রোপচার করার জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে রোবটকে।
চিকিৎসায় এআই ও রোবোটিক সার্জারির ব্যবহার এক বিপ্লবই বলা চলে। চিকিৎসাপদ্ধতিকে দ্রুত, নির্ভুল ও আরও কার্যকরী করে তুলেছে এটি। এআই মডেল দ্রুত ও নির্ভুল ভাবে টিউমার, হাড় ভাঙা বা অন্যান্য অসঙ্গতি ধরে ফেলছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালগুলিতে রোবোটিক সার্জারি ইউনিট রয়েছে।
ভারতের প্রধান শহরগুলির প্রায় সমস্ত সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত সরঞ্জাম রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ভারত যে পরিষেবা প্রদান করে তা বিশ্বের সেরাগুলির মধ্যে অন্যতম। সাফল্যের হারও যথেষ্ট। ডাক্তার, নার্স এবং প্যারামেডিক্যাল কর্মীরা অত্যন্ত দক্ষ। আধুনিক যন্ত্রপাতি, রোবোটিক সার্জারি এবং আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসকেরা বিশ্ব জুড়ে রোগীদের আস্থা অর্জন করেছেন।
একটি আন্তর্জাতিক মানের মেডিক্যাল হাব গড়ে তোলার সম্ভাবনা থাকলেও, বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ভারতকে। তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হল চিকিৎসকের অপ্রতুলতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতি ১ হাজার মানুষের জন্য কমপক্ষে ১ জন চিকিৎসক থাকা উচিত। ভারতে সেই অনুপাত মেনে চলা হয় না।
ভারতের জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে প্রায় ১৩ লাখ চিকিৎসক রয়েছেন। তার মধ্যে আনুমানিক ১০ লাখ চিকিৎসক সক্রিয় ভাবে পেশার সঙ্গে যুক্ত। সেই অনুপাতে হিসাব করলে দেখা যাবে ভারতে প্রতি ১৪০০ রোগীর জন্য গড়ে ১ জন চিকিৎসক নিযুক্ত আছেন।
বিদেশি মুদ্রার জন্য দেশের বাইরে থেকে আসা রোগীদের পর্যাপ্ত আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা দিলেও নাগরিকদের পরিষেবা নিয়ে প্রচুর খামতি রয়ে গিয়েছে। গ্রাম ও ছোট শহরে এখনও চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল। ডলারের নিরিখে বিলাসবহুল হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় দুঃসাধ্য না হলেও সাধারণ নাগরিকদের কাছে সেই ব্যয় এখনও পাহাড়প্রমাণই।
চিকিৎসা-পর্যটন স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি হোটেল, পরিবহণ, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং স্থানীয় অর্থনীতির উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও এর নেতিবাচক দিকটিও অস্বীকার করা যায় না। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা তাঁদের একাংশ মনে করছেন, চিকিৎসা-পর্যটনের কারণে স্থানীয় মানুষেরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর অযথা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
দেশীয় নাগরিক, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল ও ন্যায়সঙ্গত চিকিৎসা ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বজায় রাখাই কাম্য বলে মনে করছেন তাঁরা। নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা গন্তব্য হয়ে ওঠার ধারাবাহিক উন্নয়ন বজায় রাখতে হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সার্বিক মানোন্নয়ন, নৈতিকতা রক্ষা ও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে মত স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের।