মৃত্যুরও প্রবেশ নিষেধ এই শহরে! আইনের ক্ষমতা সেখানে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। ১৯৯৯ সাল থেকে এই নিয়মের নাগপাশেই বেঁধে রয়েছে ছোট্ট জনপদটি। একটি আইনের বলে এখানে মৃত্যুর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কিন্তু জন্মালে তো মরতেই হবে! কী ভাবে ঠেকানো সম্ভব কালের অমোঘ দণ্ডকে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই আইন বলবৎ রয়েছে ইউরোপেরই একটি দেশের ছোট্ট শহরে।
স্পেনের আন্দালুসিয়ার গ্রানাডা প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর লানহারন। সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য মৃত্যুকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল আজ থেকে ২৬ বছর আগে। এই খাপছাড়া নিয়মটি যিনি চালু করেন তিনি এই শহরেরই প্রাক্তন মেয়র হোসে রুবিও।
জানেন কি কেন সিকি শতাব্দী আগে মৃত্যুকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছিল এই বিদেশি ছোট্ট জনপদটিতে? সত্যিই কি মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব বছরের পর বছর?
এর নেপথ্যের কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ জানলে অবাক হবেন আপনিও। এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হল মৃতদেহ কবর দেওয়ার স্থান সঙ্কুলান করা সম্ভব হচ্ছিল না এখানে। শহরের একটি মাত্র কবরস্থানে আর দেহ সমাধি দেওয়ার জায়গাটুকু পর্যন্ত ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তৎকালীন মেয়র এই ফরমান জারি করেন।
সেই সময় কবরস্থানের অবস্থা এতটাই সঙ্গিন হয়ে পড়েছিল যে শীঘ্রই যেন কেউ মারা না যান, সে জন্য নাগরিকদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার অনুরোধ করে প্রশাসন। মৃত্যুর পর কবর দিতে যাতে অসুবিধে না হয় তাই অসুস্থ এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের অন্য শহরে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৯৯ সালে শহরে একটি মাত্র কবরস্থান ছিল। সেখানে নতুন ভাবে কবর দেওয়ার মতো জায়গা ছিল না। তাই উপায়ান্তর না দেখেই হাস্যকর এই নিয়মটি জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তৎকালীন মেয়র হোসে। এই নিয়মটি চালু করে মেয়র বলেছিলেন, “আমি শুধুমাত্র এক জন মেয়র। আমার উপরে ঈশ্বর আছেন, যিনি শেষ পর্যন্ত সব কিছু পরিচালনা করেন।’’
স্পেনের গ্রানাডার আলপুজারা অঞ্চলে অবস্থিত একটি মনোরম শহর লানহারন। শহরে বাস করেন হাজার চারেক বাসিন্দা। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস সমৃদ্ধ এই শহরে রয়েছে স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক উপাদানে পরিপূর্ণ ঝর্না। সেই জলে স্নান করলে শারীরিক নানা সমস্যা দূর হয়ে যায়। এখানকার স্পা-তে বাত এবং হজমের সমস্যার মতো রোগের চিকিৎসার জন্য প্রচুর রোগী ভিড় জমান এই শহরে।
গ্রানাডা থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সিয়েরা নেভাদার পাদদেশে অবস্থিত এই শহরটি আলপুজারার প্রবেশদ্বার। আলপুজারা হল সিয়েরা নেভাদা এবং সংলগ্ন উপত্যকার দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি অঞ্চল, যার ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে।
সেই ঘোষণার পর সত্যি সত্যি কত দিন এই শহরে প্রাণত্যাগ নিষিদ্ধ ছিল তা জানা যায়নি। বাসিন্দাদের একাংশের ধারণা ছিল, মেয়রের এই নির্দেশ মূলত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতেই জারি করা হয়েছিল। শহরের বাসিন্দাদের জন্য যাতে নতুন কবরস্থানের জমি খোঁজা যায়, তাই এই ব্যবস্থা।
মেয়রের এই নির্দেশের পর ২৬ বছর কেটে গেলেও লানহারনের সীমানার মধ্যে বর্তমানে কেবল একটিই কবরস্থান রয়েছে। কবরস্থানের অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা ছাড়া ছোট্ট জনপদটিতে অন্য কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। এই অঞ্চলটির অর্থনীতির ভিত্তি বলতে ঝর্নার সমৃদ্ধ জল, পর্যটন এবং কৃষি।
প্রাকৃতিক উপাদানে পূর্ণ সেই ঝর্নার জল আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। জলপাই, আঙুর এবং বাদাম এই শহরের প্রধান কৃষিপণ্য। স্থানীয় ওয়াইন এবং হ্যামের সুখ্যাতি রয়েছে আশপাশের অঞ্চলগুলিতে।
শুধু স্পেনের লানহারন নয়, বিশ্বে আরও বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে যেখানে মৃত্যু ‘নিষিদ্ধ’। তার মধ্যে একটি হল নরওয়ের লংইয়ারবেন। বরফাবৃত নরওয়ের এই এলাকায় কোনও মৃতদেহই পচেগলে মাটিতে মিশে যায় না। মৃতদেহ থাকে অবিকৃত। এই কারণে লংইয়ারবেনে মৃতদেহ কবর দেওয়ার মতো আর জায়গাই নেই।
আইন প্রণয়ন করে মৃত্যু ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে ইটালির সেলিয়াতেও। যদি কেউ বয়স্কদের অযত্ন করেন তা হলে জরিমানার আইনও প্রচলিত আছে এখানে। গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য হারে জনসংখ্যা কমে গিয়েছে সেখানে।
লানহারনের মতো একই দশা দক্ষিণ ইটালির একটি ছোট্ট শহর ফ্যালসিয়ানো দেল ম্যাসিকোরও। মৃতদেহ কবর দেওয়ার জায়গা নেই সেখানেও। আর সেই কারণে মৃত্যুও নিষিদ্ধ এখানে। কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে পাশের শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। মারা যাওয়ার পর সেই শহরেই কবর দেওয়া হয় তাঁকে।