সমুদ্রের গভীরে বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক বিস্ফোরণ! এর মাধ্যমে উড়িয়ে দেওয়া যাবে কার্বন-শোষণকারী শিলা। পৃথিবীকে বাঁচাতে সেটাই নাকি একান্ত ভাবে প্রয়োজন। এমনই বিস্ফোরক পরামর্শ দিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছেন অ্যান্ডি হ্যাভার্লি। তাঁর গবেষণা-তত্ত্ব ‘আরএক্সআইভি’ নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয়েছে হইচই।
বছর ২৫-এর অ্যান্ডি পেশায় সফ্টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বহুজাতিক মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থা মাইক্রোসফ্টে কর্মরত। তাঁর দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হুমকির দ্রুত সমাধান না হলে পৃথিবীর অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর সেই কারণেই সমুদ্রতলে বিশ্বের বৃহত্তম পরমাণু বোমাটি ফাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
কী ভাবে এই আণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে, নিজের গবেষণাপত্রে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন সফ্টঅয়্যার ই়ঞ্জিনিয়ার অ্যান্ডি। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘সমুদ্রতলে বিস্ফোরণের জন্য সুনির্দিষ্ট জায়গাটি ঠিক ভাবে শনাক্ত করতে হবে। তবেই আমরা পরমাণু বোমার ধ্বংসক্ষমতা এবং আণবিক বিকিরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। পাশাপাশি, বাতাসের কার্বন স্তরকেও অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’’
অ্যান্ডির গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর ৩৬ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়। ৮১ গিগাটনের পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থার ওই সফট্অয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর দাবি, সব কিছু ঠিক থাকলে ৩০ বছরের জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমন আটকে ফেলতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
‘শীত যুদ্ধের’ (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) সময়ে ৫০ মেগাটনের ‘জ়ার বোমা’র সফল পরীক্ষা চালায় রাশিয়া তথা তৎকালীন সোভিয়েত সরকার। সালটা ছিল ১৯৬১। বোমাটির ধ্বংসক্ষমতা দেখে ওই সময় শিউরে ওঠে গোটা দুনিয়া। সমুদ্রের তলদেশে সংশ্লিষ্ট ‘জ়ার বোমা’র চেয়ে হাজার গুণ বড় পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা নিজের গবেষণাপত্রে লিখেছেন অ্যান্ডি।
পরমাণু বোমার জনক হলেন জার্মান-ইহুদি বংশোদ্ভূত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে আমেরিকার জন্য আণবিক বোমা তৈরি করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওই গুপ্ত গবেষণার প্রকল্পের নাম ছিল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। ওপেনহাইমার ছিলেন তাঁর অধিকর্তা বা ডিরেক্টর।
১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই আমেরিকার নিউ মেক্সিকোর জর্নাডা দেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে পরমাণু বোমার প্রথম সফল পরীক্ষা করেন এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা। গোটা বিষয়টির তত্ত্বাবধানে ছিলেন ওপেনহাইমার। এর এক মাসের মাথায় ৬ এবং ৯ অগস্ট জাপানের হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে আণবিক হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র। ধুলোয় মিশে যায় দ্বীপরাষ্ট্রের ওই দুই শহর।
জাপানে মার্কিন পরমাণু হামলার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর সাফল্যের জেরে ওই সময়ে রাতারাতি আমেরিকাবাসীর চোখে নায়কের সম্মান পান রবার্ট ওপেনহাইমার। ২০২৩ সালে তাঁর বায়োপিক তৈরি করেন হলিউডের জনপ্রিয় ব্রিটিশ-আমেরিকান চিত্রপরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। দর্শকের মন জয়ের পাশাপাশি ওই সিনেমা জিতে নেয় অস্কারও।
সফ্টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হ্যাভার্লি জানিয়েছেন, ওপেনহাইমারের বায়োপিক দেখার পরই কার্বন নিঃসরণ আটকানোর জন্য সমুদ্রের তলদেশে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরমাণু বিস্ফোরণের ভাবনা আসে তাঁর মাথায়। জলবায়ু বিজ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও এই তত্ত্ব তুলে ধরেছেন তিনি। ‘আরএক্সআইভি’ তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন হ্যাভার্লি। তাঁর কথায়, ‘‘ম্যানহাটন প্রজেক্টের পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণের নাম ছিল ‘ট্রিনিটি’। সেটা কিন্তু হিরোসিমা বা নাগাসাকিতে ফেলা আণবিক বোমার মতো শক্তিশালী ছিল না। তা হলে সমুদ্রের গভীরে কেন নিয়ন্ত্রিত পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে না? আমাদের লক্ষ্য হবে সেই বস্তুগুলিকে ধ্বংস করা, যার জন্য বাতাসে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড।’’
জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমানোর জন্য এই ধরনের পরিকল্পনা যে প্রথম, এমনটা নয়। সূর্যালোকের তেজ কমানোর জন্য বিশেষ একটি পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছে ব্রিটিশ সরকার। এর জন্য ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করবে আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্র। ভারতীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কটি ৫৬৭ কোটি বলে জানা গিয়েছে।
সূর্যরশ্মির তীব্রতা কমানোর পরীক্ষা করার দায়িত্ব ‘অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন এজেন্সি’কে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এর জন্য বিজ্ঞানীরা বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সামুদ্রিক লবণের কণা স্প্রে করবেন বলে জানা গিয়েছে। দুনিয়ার তাবড় গবেষকেরা এই পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
ব্রিটিশ গবেষকদের দাবি, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষায় সাফল্য পেলে সাময়িক ভাবে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমাতে সক্ষম হবেন তাঁরা। তবে ‘অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ইনভেনশন এজেন্সি’র বিজ্ঞানীদের দাবি, বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণকে এখনই উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দেওয়া মোটেই সহজ নয়। এর জন্য আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।
পরমাণু বিস্ফোরণকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর উদ্ভট পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না রাশিয়া তথা সাবেক সোভিয়েত ইঞ্জিনিয়ারেরা। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে পেচোরা নদীর অববাহিকাকে ভলগার উপনদী কামার অববাহিকার সঙ্গে যুক্ত করতে এক বিরাট খাল কাটার পরিকল্পনা করে মস্কো। এই কাজের জন্য ২৫০টি আণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর ইচ্ছা ছিল তাদের।
১৯৬১ সালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের ছাড়পত্র দেন সোভিয়েত নেতারা। এর পোশাকি নাম ছিল ‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’। এর মাধ্যমে উত্তরের নদীর জল বিপরীতমুখে বইয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন রুশ গবেষকেরা। মস্কোর গদিতে তখন নিকিতা সর্গেইভিচ ক্রুশ্চেভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’ (পড়ুন কোল্ড ওয়ার) নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
‘নর্থ রিভার রিভার্সাল’-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চেরডিনস্কি জেলার ভাসিউকোভো গ্রামের কাছে তিনটি ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণ ঘটান রুশ গবেষকেরা। এগুলির প্রতিটি ছিল ১৫ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন। বিস্ফোরণের জেরে ৭০০ মিটার লম্বা এবং ৩৮০ মিটার চাওড়া খালের মতো জায়গা তৈরি হয়। এই প্রকল্পের নাম ‘টাইগা’ রেখেছিলেন তাঁরা।
পরমাণু বিস্ফোরণে তৈরি খালের আকার দেখে প্রাথমিক ভাবে খুশিই হন সোভিয়েত গবেষক এবং ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁরা পরবর্তী পর্যায়ের বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কিন্তু, তত দিনে ওই খালের মতো অংশ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। সেটা শুধু রাশিয়ার মধ্যেই থেমে ছিল না। বিকিরণের প্রভাব আশপাশের দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মস্কোর বিরুদ্ধে তৈরি হয় প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ।
এ দিকে ৮০-র দশক আসতে আসতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে মার্কিন প্রভাব কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এককাট্টা হতে থাকে তারা। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে ১৯৮৬ সালে এই প্রকল্প পুরোপুরি বাতিল করে দেয় মস্কো। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের অভিযোগ কখনওই সরাসরি স্বীকার করেনি ক্রেমলিন।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, হ্যাভার্লির পরিকল্পনার দু’টি বিপজ্জনক দিক রয়েছে। প্রথমত, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আটকানো আদৌ সম্ভব কি না, তা স্পষ্ট নয়। খাল কাটার সময় ঘটানো বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ব্যর্থ হন মস্কোর গবেষকেরা। দ্বিতীয়ত, এতে সমুদ্রের তলদেশের জীববৈচিত্রে বড় আঘাত লাগার আশঙ্কা প্রবল। তা ছাড়া ‘সুপার পাওয়ার’ দেশগুলি এ ব্যাপারে অনুমতি দেবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।