মহিলাদের বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নজির গড়েছে ভারত। এই প্রথম বিশ্বকাপ জিতল ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। হরমনপ্রীত কৌরদের নামের পাশে এখন ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’ তকমা।
রবিবারের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়েছে ভারত। প্রথমে ব্যাট করে ভারত ৭ উইকেট হারিয়ে ২৯৮ রান করে। জবাবে ৪৫.৩ ওভারে ২৪৬ রানে অল আউট হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ফাইনালে ব্যাটে-বলে নজর কেড়েছেন শেফালি বর্মা ও দীপ্তি শর্মা। এই দুই ক্রিকেটারের দাপটে ট্রফি তুলেছেন হরমনপ্রীতেরা।
দীপ্তি শর্মার বলে ফাইনালের শেষ ক্যাচটি নিয়েছেন হরমনপ্রীত। এই কৃতিত্ব হয়তো অধিনায়কেরই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু পুরো বিশ্বকাপে কোচ অমল মুজুমদারের ভূমিকা, বিশেষ করে লিগ পর্বে পরাজয়ের পর দলকে যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিলেন, তা ভোলেননি হরমনপ্রীত।
জয়ের শিরোপা পাওয়ার পরেই অমলের দিকে ছুটে যান হরমন। মাথা নত করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন কোচকে। এর পর অমল তাঁকে তুলে নিয়ে আলিঙ্গন করেন। গুরু-শিষ্য— দু’জনের মুখেই জয়ের চওড়া হাসি।
কিন্তু ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের কোচ এই অমল মুজুমদার কে? ফাইনালে ওঠা থেকে বিশ্বজয়ের মূল কারিগর হওয়ার কৃতিত্ব যাঁকে বার বার দিয়েছেন হরমনপ্রীতেরা। মাঠে যখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল জয় উদ্যাপন করছিল, তখন অমলের চোখেও জল। অমল ভারতীয় ক্রিকেটে নিষ্ঠা, ধৈর্য এবং অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অনুরণিত একটি নাম।
ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ রানের অধিকারী অমল তাঁর কেরিয়ারে ১৭১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। ঝুলিতে রয়েছে ১১,১৬৭ রান এবং ৩০টি সেঞ্চুরি। তবুও তিনি কখনও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাননি।
মার্জিত ব্যাটিং এবং তীক্ষ্ণ ক্রিকেটীয় মনের জন্য পরিচিত অমলকে প্রায়শই তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে অবমূল্যায়িত প্রতিভাদের মধ্যে এক জন হিসেবে গণ্য করা হয়।
রঞ্জি ট্রফিতে মুম্বইয়ের হয়ে অভিষেক ম্যাচে ২৬০ রান করে জাত চিনিয়েছিলেন অমল। ভারতীয় ক্রিকেট দলের পরবর্তী বড় খেলোয়াড় হিসাবে তাঁর নাম উঠে আসতে শুরু করে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, অমল এমন এক সময়ের ক্রিকেটতারকা, যখন ভারতের মিডল অর্ডার পরিপূর্ণ ছিল সচিন তেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বৈগ্রহিক ক্রিকেটারদের দ্বারা। ফলে জাতীয় দলে সুযোগই পাননি অমল।
হ্যারিস শিল্ডের ম্যাচে সচিন এবং বিনোদ কাম্বলির জুটি ৬৬৪ রান করে নজির গড়েছিলেন। শোনা যায়, সেই ম্যাচে নাকি তাঁদের যে কোনও এক জনের আউট হওয়ার পর নামার কথা ছিল অমলের। দু’দিন প্যাড পরে অপেক্ষা করেছিলেন তিনি।
কিন্তু সচিন-কাম্বলির ব্যাটের জাদুতে সেই সুযোগ পাননি অমল। ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সির জন্যও আজীবন অপেক্ষা করে গিয়েছেন অমল।
২১ বছরের বর্ণাঢ্য কেরিয়ারে ইতি টেনে ২০১৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নেন অমল। একসময় মুম্বই দলের ব্যাটিংয়ের দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, অবসর গ্রহণের ১১ বছর পর সেই অমলকেই ২০২৩ সালে দেওয়া হয় ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলকে কোচিং করানোর দায়িত্ব।
হরমনপ্রীত-স্মৃতিরা প্রথম বার বিশ্বকাপ জয়ের পর আবেগে ভেসে যান অমল। তিনি জানান, ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে এই জয়।
অমলের কথায়, ‘‘আমি বাক্রুদ্ধ। গর্বিত। এই বিজয় মুহূর্তের প্রতিটি অংশ দলের প্রাপ্য। কঠোর পরিশ্রম, বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রতিটি ভারতীয়কে গর্বিত করেছে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা। এটি একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। এর প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অনুভূত হবে।’’
অমল আরও বলেন, ‘‘আমরা কখনওই শুরুর দিকের ব্যর্থতার প্রভাব নিজেদের উপর পড়তে দিইনি। বেশির ভাগ ম্যাচেই আমরা আধিপত্য দেখিয়েছিলাম। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।’’
ফাইনালে শিষ্যা শেফালির পারফরম্যান্স নিয়েও গর্বিত গুরু অমল। ২১ বছর বয়সি ব্যাটারের প্রশংসার সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘শেফালির জন্য একটাই শব্দ— জাদুকরি।’’
অমল আরও বলেন, ‘‘সেমিফাইনাল, ফাইনাল, স্টেডিয়ামে দর্শকের ভিড়— সব চাপ উপেক্ষা করে প্রতি বারই ফিরে আসে ও। রান করা, উইকেট নেওয়া— কোনও কিছুতেই পিছিয়ে নেই শেফালি। ওর জন্য প্রচণ্ড গর্বিত।’’
বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস তৈরি করেছেন হরমনপ্রীত-জেমাইমা-স্মৃতি-শেফালিরা। কিন্তু অমলের জীবনের বৃত্ত পূর্ণ হয়েছে। মুম্বইয়ের তারকা ক্রিকেটার, যিনি প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও কখনও ভারতের হয়ে খেলতে পারেননি, তাঁর দেখানো পথেই ক্রিকেটে বিশ্বজয় করেছেন হরমনপ্রীতেরা। ব্যাট হাতে নয়, কোচ হিসেবে ভারতকে গৌরব এনে দিয়েছেন অমল।