রাজস্থানের যুবরাজ মারমাট এবং তেলঙ্গানার পি মৌনিকা। দু’জনেই দেশসেবার কাজে নিযুক্ত করেছেন নিজেদের। উভয়েই সচ্ছল। তবুও তাঁরা বিয়ে সেরেছিলেন মাত্র দু’হাজার টাকায়।
) না ছিল এলাহি আয়োজন, না ছিল দামি পোশাক। নিজেদের জীবনের বিশেষ মুহূর্ত খুব অল্প খরচের মধ্যেই সেরে ফেলেন এই দু’জন।
যুবরাজ উত্তরপ্রদেশের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অফ টেকনোলজি (বিটেক) পড়েছেন। বরাবরই প্রশাসনিক স্তরে কাজ করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেইমতো প্রস্তুতিও নিয়েছেন ছোট থেকেই।
প্রথম বার ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় বসেন ২০১৬ সালে। প্রথম বারে ব্যর্থ হন, দ্বিতীয় বারেও সুযোগ মেলেনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। অবশেষে আরও তিন বার প্রচেষ্টার পর ষষ্ঠ বারে, অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশের মধ্যে ৪৫৮ র্যাঙ্ক হয় তাঁর।
অন্য দিকে পি মৌনিকা বড় হয়েছেন দক্ষিণ ভারতের সাধারণ পরিবারে। ফার্মাকোলজি নিয়ে স্নাতক হয়েছেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ফার্মাসি নিয়ে পড়লেও এই বিষয়কে পেশা হিসাবে বাছাই করেননি তিনি। প্রশাসনিক স্তরে কাজ করার তাগিদে ইউপিএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন স্নাতক হওয়ার পরই।
যুবরাজের মতো মৌনিকাও ২০২১ সালে উত্তীর্ণ হন ইউপিএসসি। তিনিও ষষ্ঠ বারে সফলতা পান। সারা ভারতের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল ৬৩৭-এ। পড়াশোনা ছাড়া মৌনিকার আগ্রহের জায়গা খেলাধুলা এবং সঙ্গীত।
ইউপিএসসি–তে যাঁরা নির্বাচিত হন তাঁদের সকলকে প্রথমে কিছু মাসের জন্য ‘ফাউন্ডেশন কোর্স’ করতে হয়। সেইমতো ইউপিএসসি উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২২ সালে যুবরাজ ও মৌনিকা দু’জনের প্রশিক্ষণ শুরু হয় মুসৌরির ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে’ (এলবিএসএনএএ)।
আইএএস অফিসারদের সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণই এলবিএসএনএএ চলে। তবে একটা পর্যায়ের পর আইপিএস অফিসার হতে গেলে অন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চলে যেতে হয়। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর আইপিএস অফিসারদের হায়দরাবাদের ‘সর্দার বল্লভভাই পটেল ন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমি’তে বাকি প্রশিক্ষণ চলে।
প্রশিক্ষণ চলাকালীনই দেখা হয় যুবরাজ এবং মৌনিকার। পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে তিন মাস ধরে চলে প্রশিক্ষণ। কখনও ক্লাসরুমের মধ্যে ভারতীয় সংবিধান, আইন, অর্থনীতি পড়তে হত। কখনও আবার সাংস্কৃতিক নানা কার্যক্রমও চলত প্রশিক্ষণের মধ্যে।
এ ছাড়াও প্রশিক্ষণে থাকত ট্রেকিং। সেখানে প্রত্যেককেই একসঙ্গে পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পথে চলতে হত। যুবরাজ এবং মৌনিকাও এই সমস্ত ক্লাস একসঙ্গে করতেন। সে সময়ই প্রথমে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই ধীরে ধীরে পরিণতি পায় প্রেমে। একে অপরের প্রতি সম্মান তাঁদের প্রেমকে আরও দৃঢ় করেছিল। কিন্তু বেশি দিন কাছাকাছি থাকতে পারেননি তাঁরা। কাজের তাগিদে তিন মাস পরেই যুবরাজকে ছেড়ে অন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রে চলে যেতে হয় মৌনিকাকে।
যুবরাজ আইএএস অফিসার হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। মৌনিকা চেয়েছিলেন আইপিএস অফিসার হতে। ফলত প্রথম তিন মাস একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আইপিএসের প্রশিক্ষণ নিতে হায়দরাবাদ পাড়ি দেন মৌনিকা।
দূরত্ব থাকলেও একে অপরের প্রতি ভালবাসা ছিল অটুট। আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে দু’জনের দেখা হওয়া সম্ভব হত না। অগত্যা ভরসা ছিল মুঠোফোন, ইমেল। এক সাক্ষাৎকারে তাঁরা জানিয়েছিলেন, প্রশিক্ষণের ব্যস্ততা মাঝেমধ্যে এতটাই ছিল যে তাঁরা ফোনে কথা বলারও সুযোগ পেতেন না।
প্রশিক্ষণের শেষে ছত্তীসগঢ়ে কাজে যোগ দেন যুবরাজ। সেই সময় তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর পদে কাজ করতেন। অন্য দিকে তেলঙ্গানা ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত হন মৌনিকা। যদিও বিয়ের পর দু’জনেরই তেলঙ্গানায় পোস্টিং হয়ে যায়।
চাকরিজীবনের শুরুর দিকেই এই জুটি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত ছিল সকলের চেয়ে একেবারে অন্য রকম। তাঁদের কাছে বিয়ে মানে বিলাসিতা নয়। তাই অতি সাধারণ ভাবে হায়দরাবাদের এক রেজিস্ট্রি অফিসে সই করেই আইনত বিয়ে সারেন তাঁরা।
কোনও ব্যান্ডের বাজনা বাজা তো দূর অস্ত, কোনও অতিথিও আমন্ত্রিত ছিলেন না তাঁদের বিয়েতে। শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যেরাই উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গতি থাকলেও মাত্র দু’হাজার টাকা দিয়েও যে বিয়ে করা যায়, তাই-ই প্রমাণ করে দিয়েছেন এই আইএএস এবং আইপিএস অফিসার দম্পতি।
যদিও বিয়ের কিছু দিন পরই বিতর্কে জড়ান এই দম্পতি। সূত্রের খবর, বিয়ের কয়েক মাস পর যুবরাজ এক মহিলার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ ছিল, ওই মহিলা নাকি তাঁকে ‘হানি ট্র্যাপ’ ও ‘ব্ল্যাকমেইল’ করার চেষ্টা করেছেন।
যুবরাজ অভিযোগ করেছিলেন, ওই মহিলা নাকি ধর্ষণের মামলায় জড়ানোর হুমকিও দিয়েছিলেন। যদি যুবরাজ তাঁকে বিয়ে না করেন অথবা দেড় কোটি টাকা না দেন, তা হলে ধর্ষণ ও আত্মহত্যার কারণ হিসাবে যুবরাজকে দায়ী করা করা হবে বলেও নাকি হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এই সব কারণেই তিনি রাজস্থানের জয়পুর শহরের মুহানা থানায় ওই মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন।
যদিও মহিলার অভিযোগ অনুযায়ী, যুবরাজ তাঁকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সহবাস করেছিলেন। ওই মহিলার আরও দাবি, যুবরাজ তাঁর গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দিয়েছিলেন এবং তাঁকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছিলেন।
যুবরাজ পুলিশে অভিযোগ দায়ের করার পর ওই মহিলা পাল্টা অভিযোগ করেন দিল্লির পটেল নগর থানায়। এখনও পর্যন্ত এই ঘটনা বিচারাধীন। উপযুক্ত কোনও প্রমাণ এখনও মেলেনি বলেই সূত্রের খবর। তবে এই ঘটনায় চিড় ধরেনি যুবরাজ ও মৌনিকার সংসারে। যুবরাজের চাকরিও বহাল রয়েছে এখনও।