লাশের পাহাড়! প্রায় ৪০০টি মৃতদেহ স্তূপীকৃত করে রাখা। একটির উপর একটি শবদেহ ডাঁই করে রাখা। গত রবিবার উত্তর মেক্সিকোর সিউদাদ জুয়ারেজ শহরের একটি ‘বেসরকারি শ্মশান’ থেকে বিপুল পরিমাণ মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
একটি বেনামি ফোন পেয়ে চিহুয়াহুয়া রাজ্যের প্রশাসনিক দফতরের আধিকারিকেরা হানা দেন বেসরকারি মালিকানাধীন ওই ‘শ্মশানে’। তল্লাশি চালাতেই চোখ কপালে উঠে যায় চিহুয়াহুয়া রাজ্যের প্রশাসনিক দফতরের কর্মীদের। চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা শয়ে শয়ে মৃতদেহ। মৃতদেহগুলি এমন ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, যাতে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
জুনের শেষ সপ্তাহে আমেরিকার টেক্সাস ও মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত এই ‘শ্মশানে’ ৩৮৩টি দেহ এবং ৬টি দেহাবশেষ খুঁজে পান তদন্তকারীরা। চিহুয়াহুয়া প্রদেশের প্রসিকিউটর অফিসের যোগাযোগ সমন্বয়কারী আধিকারিক এলয় গার্সিয়া সংবাদসংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের কাছে ৩৮৯টি মৃতদেহ উদ্ধার করার খবর এসেছে। বেআইনি ভাবে সেগুলি জমা করা হয়েছিল। কিন্তু দাহ করা বা কবর দেওয়া হয়নি।
চিহুয়াহুয়া রাজ্যের প্রসিকিউটর সিজার জাউরেগুই গত ৩০ জুন সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, এই দেহগুলি কমপক্ষে তিন বা চার বছরের পুরোনো। শ্মশানটিতে মরদেহগুলি যথাযথ ভাবে সৎকার করা হয়নি। বিভিন্ন কক্ষে সেগুলিকে স্তূপ করে ফেলে রাখা ছিল, অনেক দেহ মেঝেতেও ফেলে রাখা হয়েছিল।
কর্তৃপক্ষের মতে, বেশির ভাগ মৃতদেহকে রাসায়নিক দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। জাউরেগুই জানিয়েছেন, এতগুলি দেহ নিয়ে এখানে কী চলছিল তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। উদ্ধার হওয়া দেহের সংখ্যা বিচার করলে এটি স্পষ্ট যে এখানে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভূত বেনিয়ম চলছিল।
তদন্তকারী আধিকারিকেরা জানিয়েছেন যে, অনেক মৃতদেহই সীমান্তবর্তী এই শহরটির ছ’টি ভিন্ন এলাকা থেকে এনে এখানে জড়ো করা হয়েছিল। মৃতদেহ দাহ করা হয়ে গিয়েছে এই আশ্বাস দিয়ে আত্মীয়দের দেহাবশেষের (ছাই) বদলে ‘অন্য কিছু’ সরবরাহ করা হয়েছিল। মৃতের পরিজনেরা বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁদের প্রিয়জনদের দেহ সঠিক ভাবে দাহ করা হয়েছে।
ফরেন্সিক কর্তারা জানিয়েছেন যে, উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের মধ্যে ২১৮টি পুরুষের, ১৪৯টি মহিলার। ১৬টি দেহের পরিচয় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনায় সৎকারকেন্দ্রের মালিক এবং এক জন কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান শুরু হওয়ার অনেক আগেই সেখানকার কিছু কর্মী পালিয়ে গিয়েছিলেন। এক জন আত্মসমর্পণ করেছিলেন বলেও খবর।
বিষয়টি তদন্তকারীদের কাছে আরও অদ্ভুত ঠেকে যখন তাঁরা খেয়াল করেন যে, সমস্ত মৃতদেহকে এমন ভাবে সাজিয়ে করা হয়েছিল যেন সেগুলিকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। কালো ব্যাগের মধ্যে দেহগুলি রাখা হয়েছিল।
গার্সিয়া অনুমান করেছেন, শ্মশানের মালিক ক্ষমতার থেকে বেশি মৃতদেহ নিয়ে এসে জমিয়ে রাখতেন। অবহেলা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে সেই মৃতদেহগুলি দীর্ঘ দিন ধরে এখানে জমা হয়েছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংস্থাগুলিকে ভুল বুঝিয়ে ক্রমাগত মৃতদেহ গ্রহণ করেই যেত শ্মশানটি। কিন্তু দাহ করত না।
মালিকের কাছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরিচালনার জন্য তিনটি অনুমতিপত্র ছিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল। তবে স্পষ্ট ছিল না যে সেগুলি মেয়াদ উত্তীর্ণ কি না। চিহুয়াহুয়ার গভর্নর সাংবাদিকদের জানান, শ্মশানটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। মালিক ও কর্মীরা এই অনুমতিপত্র এবং পারমিটের অপব্যবহার করেছিলেন বলেও অভিযোগ তাঁর।
কেন মৃতদেহগুলিকে কবর দেওয়া হয়নি বা পুড়িয়ে ফেলা হয়নি তা এখনও স্পষ্ট নয়। মালিক হোসে লুই আরেলানো কুয়ারন এবং এক জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে মৃতদেহ নিয়ে বেনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। খুন করে মৃতদেহ এখানে রাখা হত কি না তা জানার জন্য দেহাবশেষগুলি পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এই ভয়াবহ ঘটনার পর শহরের শত শত নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের মধ্যে আশার আলো দেখা দিয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, তাঁদের প্রিয়জনের দেহের অবশিষ্টাংশ ফেরত পাওয়া গেলেও যেতে পারে। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে বৈধ প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা অনেক অভিবাসী প্রায়শই অপহৃত বা নিখোঁজ হয়েছিলেন। এই তালিকায় তাঁরাও থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
যাঁরা বিশ্বাস করেন যে তাঁদের প্রিয়জনকে এই মৃতদেহের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে, তাঁদের জন্য প্রশাসন একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে। পরিবারগুলিকে একটি বৈধ পরিচয়পত্র আনতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁদের প্রিয়জনের শেষ পোশাক কী ছিল এবং তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ কোন শ্মশানে রেখে এসেছিলেন তার বিবরণও জমা দিতে বলা হয়েছে।