৬২ বছরের কর্মজীবনে ইতি। বহু যুদ্ধের নায়ক মিগ-২১ লড়াকু জেটকে এ বার অবসরের গ্রহে পাঠাতে চলেছে ভারতীয় বায়ুসেনা। চলতি বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় ছাউনিতে ‘উড়ন্ত কফিন’ তকমা পাওয়া যুদ্ধবিমানটির বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছে এ দেশের বিমানবাহিনী। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) তৈরি সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটির জন্মকাহিনি কিন্তু কোনও রূপকথার চেয়ে কম নয়। তা ছাড়া দীর্ঘজীবন এবং নির্মাণ সংখ্যার নিরিখে মিগ-২১ যে ইতিহাসে নিজের আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৯৫৫ সালের এক শীতের সকাল। সে দিন হিমাঙ্কের পাঁচ ডিগ্রি নীচে ছিল তাপমাত্রা। সেই প্রবল ঠান্ডাকে উপেক্ষা করেই ঝুকভস্কি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জড়ো হন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা গবেষক এবং বিমানবাহিনীর কর্তা-ব্যক্তিরা। রাজধানী মস্কো থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ওই এলাকায় একটি বিশেষ লড়াকু জেটের সফল পরীক্ষা চালান তাঁরা। যুদ্ধবিমানটির নমুনাটির নাম রাখা হয়েছিল ‘ইয়ে-২’, যা কিছু দিনের মধ্যেই মিগ-২১ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এ (কোল্ড ওয়ার) জড়িয়ে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওই সময় আমেরিকার উপর গুপ্তচরবৃত্তি এবং দরকারে আক্রমণ শানানোর মতো তীব্র গতি সম্পন্ন লড়াকু জেটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মস্কোর সেনাকর্তারা। সেই লক্ষ্যে তৈরি হয় মিগ-২১-এর নকশা। সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির উৎপাদন শুরুর সালটি ছিল ১৯৫৯। লড়াকু জেট নির্মাণকারী সংস্থা ‘মিকোয়ান-গুরেভিচ’কে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন সোভিয়েতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট মিগ-২১ ছিল ওই সময়ের সবচেয়ে হালকা যুদ্ধবিমান। শব্দের প্রায় দু’গুণ গতিতে ছুটতে পারত সোভিয়েতের এই জেট। আর তাই একে ‘সুপারসনিক’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান বললে অত্যুক্তি হবে না। এতে তুলনামূলক ভাবে কম শক্তি সম্পন্ন আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন লাগিয়েছিলেন সোভিয়েতের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। ওজন কম হওয়ায় মাঝ-আকাশে অনায়াসে ডিগবাজি খেতে পারত মিগ-২১। এই গুণ তৎকালীন যুগের মার্কিন লড়াকু জেটগুলির চেয়ে একে অতিরিক্ত শক্তি জুগিয়েছিল।
‘ঠান্ডা লড়াই’-এর (কোল্ড ওয়ার) যুগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নজরদারি করতে ‘ইউ-২’ নামের একটা গুপ্তচর বিমান তৈরি করে আমেরিকা। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে মস্কোর হাঁড়ির খবর জোগাড় করতে অন্য রকম ধাঁচে ফেলে এর নকশা এঁকেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। তাতে ছিল রেডারকে ফাঁকি দেওয়ার অদ্ভুত কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের সেই পরিকল্পনা অবশ্য বেশি দিন চাপা থাকেনি। মাঝ-আকাশে তাদের গুপ্তচর বিমানকে ধরে ফেলতে তড়িঘড়ি মিগ-২১কে বায়ুসেনায় শামিল করে মস্কো।
প্রথম পর্যায়ে মার্কিন গুপ্তচর বিমানকে চিহ্নিত করা এবং মাঝ-আকাশে শত্রু জেটের সঙ্গে যুদ্ধ চালানো— এই দুই লক্ষ্যে মিগ-২১ তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে রাজধানী মস্কোর তুশিনো বিমানঘাঁটিতে সর্বপ্রথম সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটিকে জনসমক্ষে আনেন তারা। লড়াকু জেটটির সক্ষমতা দেখে যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই পশ্চিমি দুনিয়াও চমকে গিয়েছিল। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, মিগ-২১ ছিল বিশ্বের প্রথম মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান।
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে কোরীয় যুদ্ধে প্রথম বার অংশ নিয়েই নিজের ক্ষমতা তুলে ধরতে সক্ষম হয় মিগ-২১। ১৯৬৭ সালের ৩১ অগস্ট এই লড়াকু জেটের সাহায্যে মার্কিন গুপ্তচর বিমান আরএফ-৪সিকে গুলি করে নামায় উত্তর কোরিয়ার (ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা ডিপিআরকে) বিমানবাহিনী। এর পাঁচ মাস পর, ১৯৬৮ সালের ১৪ জানুয়ারি ফের তাদের সঙ্গে যুদ্ধে একটি এফ-১৫০ডি যুদ্ধবিমান হারায় আমেরিকা। এর নেপথ্যেও ছিল সোভিয়েত জেট মিগ-২১।
১৯৬৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মিগ-২১ থেকে ছোড়া গুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৪বি লড়াকু জেটকে মাঝ-আকাশেই উড়িয়ে দেয় উত্তর কোরিয়ার বায়ুসেনা। ১৯৬৮ সালের ২৩ জানুয়ারি মার্কিন নজরদারি রণতরী ইউএসএস পুয়েবলোতে হামলা চালায় পিয়ংইয়ংয়ের নৌসেনা। সেই লড়াইতেও যুক্ত ছিল সোভিয়েতের যুদ্ধবিমান। ১৯৬৯ সালে ইসি-১২১ উড়োজাহাজকে ধ্বংস করে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেট। ওই ঘটনায় ৩১ জন আমেরিকান সৈন্যের মৃত্যু হয়েছিল।
পরবর্তী কালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের হিসাব পাল্টে দিতে বড় ভূমিকা নেয় মিগ-২১ লড়াকু জেট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাওয়া ভিয়েতনামিদের সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করে উত্তর কোরিয়া। এতে তাঁদের শক্তি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর জন্য ভিয়েতনামের লড়াইয়ে অংশ নেন পিয়ংইয়ঙের ৮৭ থেকে ৯৬ জন যোদ্ধা পাইলট। তাঁদের হাতে ধ্বংস হয় ২৬টির কাছাকাছি মার্কিন যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া আরও ১৪টির বড় ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল মিগ-২১।
১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় মিশর এবং সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন আরব জোট। ইতিহাসে এটি ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। সেই লড়াইতেও মিগ-২১ লড়াকু জেট নিয়ে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন কায়েরো এবং দামাস্কাসের যোদ্ধা পাইলটরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন উত্তর কোরিয়ার বেশ কিছু বায়ুসেনা অফিসার। গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত সিরিয়ার আকাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সোভিয়েতের তৈরি ওই যুদ্ধবিমান।
১৯৬৩ সালে ভারতীয় বায়ুসেনায় মেগা এন্ট্রি নেয় মস্কোর ওই লড়াকু জেট। এর প্রথম সংস্করণটির নাম ছিল ‘মিগ-২১ এলএফ’। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিনের হাতে বাজে ভাবে পরাজিত হওয়ার পর বিমানবাহিনীকে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কেন্দ্র। সেই তাগিদ থেকেই সোভিয়েতের থেকে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটি আমদানি করেছিল নয়াদিল্লি।
এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক নির্মিত ফাইটার জেটের শিরোপা রয়েছে মিগ-২১-এর মুকুটে। সেই সংখ্যাটা হল ১১ হাজার ৪৯৬। তবে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির সব ক’টি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মাটিতে তৈরি হয়েছে এমনটা নয়। মস্কোর থেকে মোট ৮৭৪টি মিগ-২১ কেনে ভারত। এর মধ্যে ক্রেমলিনের প্রযুক্তিগত সহায়তার ৬৫৭টি ঘরের মাটিতেই তৈরি করেছিল প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল। একই ভাবে সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ায় (বর্তমানে যা চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া) তৈরি হয় ১৯৪টি মিগ-২১।
২০০০ সালে ‘মিগ-২১’-এর আধুনিকীকরণ করে ভারত। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন) এবং হ্যালের সহায়তায় তৈরি হয় ‘বাইসন’ মডেল। বর্তমানে তার ১.৫ স্কোয়াড্রন কর্মরত রয়েছে। রাজস্থানের বিকানেরের নাল বায়ুসেনা ঘাঁটিতে সেগুলিকে মোতায়েন রেখেছে বিমানবাহিনী। সংশ্লিষ্ট স্কোয়াড্রনের পোশাকি নাম ‘প্যান্থার্স’। এতে মোট ৩৫টি জেট রয়েছে, যার সবগুলি সেপ্টেম্বরে অবসরে যেতে চলেছে।
১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বড় ভূমিকা নেয় ‘মিগ-২১ বাইসন’। তবে বিশ্লেষকদের কথায়, রুশ জেটটি সর্বাধিক সাফল্য পেয়েছে ২০১৯ সালে। সে বার এর সাহায্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পাক বিমানবাহিনীর একটি ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয় ভারতীয় বায়ুসেনা। ‘মিগ-২১ বাইসন’-এর ককপিটে ছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান।
ধারে ও ভারে আমেরিকার ‘এফ-১৬’ অনেক উন্নত যুদ্ধবিমান। ‘মিগ-২১’-এর মতো বুড়ো লড়াকু জেটের সাহায্যে তাকে ধ্বংস করার ঘটনাকে তাই ‘অবিশ্বাস্য’ বলে উল্লেখ করেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। অভিনন্দনের যুদ্ধবিমানটি অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল। ফলে তাঁকে গ্রেফতার করে পাক সেনা। কিন্তু পরে নয়াদিল্লির চাপে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ইসলামাবাদ।
চলতি বছরের অগস্টে শেষ বার মিগ-২১ ওড়ান ভারতীয় বায়ুসেনাপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল অমরপ্রীত সিংহ। ককপিট থেকে নেমে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। বলেন, ‘‘সোভিয়েত আমলের এই জেট যাঁরা উড়িয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই এর কথা মনে রাখবেন। কিন্তু একটা সময় আসে যখন সব কিছুই ফুরিয়ে যায়। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এটা অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছে। তাই মিগ-২১-এর রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’’
একটা সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর শিরদাঁড়া ছিল মিগ-২১। বর্তমানে সেই জায়গা নিয়েছে রাফাল, তেজ়স এবং এসইউ-৩০এমকেআইয়ের মতো লড়াকু জেট। এ ছাড়া পঞ্চম প্রজন্মের রুশ স্টেল্থ যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৬ ফেলন কেনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে নয়াদিল্লি। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে এখনও কোনও তথ্য দেয়নি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
৬০ বছরের বেশি কর্মজীবন শেষ করে অবসরের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মিগ-২১-এর ‘পুনর্বহাল’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সেটা নব রূপে এবং নতুন আঙ্গিকে। সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটগুলিকে ড্রোনে বদলে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে বিমানবাহিনী, ডিআরডিও এবং হ্যালের। এগুলি দিয়ে দু’-তিন ধরনের মানববিহীন উড়ুক্কু যান তৈরি করতে চাইছেন তাঁরা।
সেই তালিকায় প্রথমেই থাকছে ‘টার্গেট’ ড্রোন। উচ্চ গতির ওই উড়ুক্কু যানকে মূলত যুদ্ধাভ্যাসের জন্য ব্যবহার করতে পারবে বায়ুসেনা। লড়াকু জেটের পাইলটদের মহড়ায় প্রায়ই এই ধরনের ড্রোনের প্রয়োজন হয়ে থাকে। এগুলিকে শত্রুর যুদ্ধবিমান হিসাবে গণ্য করে লড়াইয়ের অনুশীলন করে থাকেন তাঁরা। এ ছাড়া লড়াকু জেটের ‘আকাশ থেকে আকাশ’ (পড়ুন এয়ার টু এয়ার) ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্যেও এটি ব্যবহার হতে পারে।
এ ছাড়া নজরদারি এবং আত্মঘাতী ‘কামিকাজ়ে’ ড্রোনে ‘মিগ-২১ বাইসন’কে বদলে ফেলার পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার। শেষেরটির ক্ষেত্রে শত্রু দেশে অনেকটা বিস্ফোরক নিয়ে হামলা করার সক্ষমতা পাবে বিমানবাহিনী। যুদ্ধের সময় শত্রুর গোলা-বারুদের ডিপো উড়িয়ে দিতে এগুলি ব্যবহার করতে পারে তারা। ‘মিগ-২১ বাইসন’কে তাই কামিকাজ়ে ড্রোনে বদলে ফেলার পরিকল্পনাকে ‘খেলা ঘোরানো’ সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।