৩০০ ডলারের লোভ দেখিয়ে রেভ পার্টিতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তিন তরুণীকে। তার পর থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তিন জন। পরে একটি বাড়ির উঠোনে তিন জনের দেহ উদ্ধার করা হয়। তিন জনকে নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাটি ইনস্টাগ্রামে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল বলেও দাবি। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে উত্তাল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা।
শনিবার বুয়েনাস আইরেসের রাস্তায় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর, বুধবার বুয়েনাস আইরেসের দক্ষিণ উপশহরের একটি বাড়ির উঠোনে ২০ বছর মোরেনা ভার্দি এবং ব্রেন্ডা দেল ক্যাস্টিলো এবং ১৫ বছর বয়সি লারা গুতেরেসের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
হত্যার তদন্তে নেমে পুলিশ আধিকারিকেরা জানতে পেরেছেন, মাদকচক্রের সঙ্গে জড়িতরা ইনস্টাগ্রামে লাইভে এসে নৃশংস হত্যাগুলি সংঘটিত করেন। একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের ৪৫ জন সদস্য এটি দেখেছিলেন বলেও জানা গিয়েছে। অভিযোগ, ১৯ সেপ্টেম্বর টাকার লোভ দেখিয়ে তিন জনকে একটি ভ্যানে তোলা হয়।
রাজধানী বুয়েনাস আইরেসের উপকণ্ঠে একটি বাড়িতে সেক্স পার্টিতে অংশ নেওয়ার জন্য ৩০০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে তিন জনকে ডেকে আনা হয়। টাকা দেওয়ার পরিবর্তে মাদক পাচারকারীরা তাঁদের ধরে রেখে নির্যাতন চালায়। তরুণীদের চরম শাস্তি দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য।
তদন্তকারী আধিকারিকদের মতে, মাদক পাচারকারীরা শাস্তি এবং প্রতিশোধ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল। অভিযোগ, মৃত তিন জনের এক জন মাদক চুরি করেছিলেন। ভিলা ১-১১-১৪ নামে পরিচিত একটি এলাকার কুখ্যাত মাদক পাচারকারী গোষ্ঠীর নেতা ও ডিলারের থেকে এক প্যাকেট কোকেন চুরি করে এনেছিলেন ওই তিন জনের এক জন।
বুয়েনাস আইরেসের নিরাপত্তা মন্ত্রী হাভিয়ের আলোনসো সাংবাদিকদের জানান, এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মাদক পাচারকারীরা একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সেই বার্তাটি হল, মাদক চুরির দুঃসাহস দেখালে ভবিষ্যতে এই দশাই হবে। একটি ফুটেজে সেই কথাই বলতে শোনা গিয়েছে মাদক পাচারকারী দলের এক নেতাকে।
আর্জেন্টিনার গণমাধ্যম জানিয়েছে, নির্যাতনকারীরা তিন তরুণীর নখ উপড়ে, আঙুল কেটে ফেলেছে। তাঁদের উপর অকথ্য নির্যাতন ও মারধরের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার পর বাড়ির বাইরে প্লাস্টিকের ব্যাগে পুঁতে ফেলেছিল। হত্যাকাণ্ডের পর প্রমাণ লোপাটের জন্য কয়েক জনকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয় বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।
ফরেনসিক পরীক্ষায় হিংস্রতার মাত্রা অবাক করেছে পুলিশকেও। লারাকে হত্যার আগে তার বাঁ হাতের পাঁচটি আঙুলই কেটে ফেলা হয়েছিল। ব্রেন্ডার খুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। পেট কাটা অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁকে। মোরেনার মাথার উপর একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ শক্ত করে আটকে দেওয়া হয় যাতে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যান তিনি।
সেই ভাড়া করা পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মধ্যে মোট পাঁচ জনকে পুলিশ আটক করেছে। এঁদের মধ্যে দু’জন মহিলাও রয়েছেন। এক জন সন্দেহভাজনকে মৃতদেহ বহন করার জন্য গাড়ি দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয়েছে। এই হত্যার নেপথ্যে মূল চক্রীকে শনাক্ত করেছে আর্জেন্টিনা পুলিশ। ২৭ বছর বয়সি অভিযুক্ত পেরুর বাসিন্দা এবং দলটির নেতা।
ঘটনার আঁচ ছড়াতেই গা ঢাকা দেন মাদক পাচারকারী দলের ওই চাঁই। অভিযোগ, চুরির শাস্তি কী হতে পারে তা দলের সদস্যদের দেখানোর জন্য লাইভস্ট্রিমের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। কর্তৃপক্ষের ধারণা, হত্যাকাণ্ডের পরপরই তিনি আর্জেন্টিনা থেকে পালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে তাঁর সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে নজরদারি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ব্রেন্ডা এবং মোরেনার তুতো ভাই ফেডেরিকো সেলেবন সংবাদসংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, তরুণীরা মাঝে মধ্যেই আনন্দ উপভোগ করার জন্য মাদক সেবন ও যৌনকর্মে লিপ্ত হতেন। সব কিছু চলত তাঁদের পরিবারের অজান্তেই। তাঁদের দুর্ভাগ্য, ভুল সময়ে ভুল সংসর্গে পড়ে যাওয়া। অন্য দিকে ১৫ বছরের মৃতার মাসি ভ্যালে গ্যালভান মাদক সেবন ও যৌনবৃত্তির সঙ্গে লারার যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটিতে মাদক মাফিয়াদের দাপাদাপি প্রবল। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একাংশ বুঁদ হয়ে থাকেন কোকেন, চরস, মারিজুয়ানায়। মাদকের কারবার ও নেশায় ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। তাই মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চেয়ে শনিবার আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনাস আইরেসের পথে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। এই হত্যার নৃশংসতা দেখে শিউরে উঠেছেন নাগরিকেরা।
মেক্সিকো, কলম্বিয়া এবং ইকুয়েডরের মতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যে মাত্রায় মাদক মাফিয়াদের অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সঙ্গে আর্জেন্টিনার মতো দেশ অভ্যস্ত নয় বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও মাদক বিরোধী সংগঠনগুলি। এর অর্থ হল সে দেশের অন্ধকার জগতে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে এবং অপরাধীগোষ্ঠীর নেতারা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করছে, যা খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা।
ক্রমবর্ধমান দারিদ্র এবং সরকারি পরিষেবা হ্রাসের ফলে মেসি-মারাদোনার দেশের তরুণ প্রজন্মকে বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করতে হচ্ছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে মাদকের চোরাকারবারিরা। বিশাল এলাকা জুড়ে ছোট-বড় মাদক মাফিয়ার করুণার উপর বেঁচে রয়েছেন আর্জেন্টিনার তরুণ তরুণীরা। এমনকি শিশু এবং কিশোরদের জীবনে অনুপ্রবেশ করে তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে মাদক মাফিয়ারা, এমনটাই দাবি মানবাধিকার সংগঠনের।
মৃত দুই তরুণীর দাদা আন্তোনিও দেল ক্যাস্টিলো কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, মাদক পাচারকারীরা তাঁর বোনদের সঙ্গে যা করেছে তা ভয়ঙ্কর বললেও কম বলা হয়। ব্রেন্ডার বাবা লিওনেল দেল ক্যাস্টিলো বিক্ষোভে এসে জানান, তাঁর মেয়ের উপর এতটাই নির্যাতনের করা হয় যে তিনি মেয়ের মৃতদেহ শনাক্ত পর্যন্ত করতে পারেননি। ব্রেন্ডার মা বলেন, ‘‘ওরা আমার মেয়ের সঙ্গে যা করেছে, আমি চাই সবাই এর প্রতিশোধ নিক।’’
ইনস্টাগ্রামের মূল সংস্থা মেটা অবশ্য তাদের প্ল্যাটফর্মে লাইভস্ট্রিম হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়নি। সমাজমাধ্যমটির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইনস্টাগ্রামে লাইভস্ট্রিম হওয়ার কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। এই ভয়াবহ অপরাধের তদন্তে মেটা ও ইনস্টাগ্রাম আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে তদন্তে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে এএফপিকে জানিয়েছেন তিনি।