সত্যিই কি সৌন্দর্যের কোনও নির্দিষ্ট বাঁধাধরা সংজ্ঞা রয়েছে? সৌন্দর্যের সংজ্ঞা জাতিভেদে, দেশভেদে ভিন্ন। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্রের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সৌন্দর্য। আমার-আপনার কাছে যা অদ্ভুত, খাপছাড়া, অন্য দেশের বিশেষ কোনও জাতির কাছে তা সৌন্দর্যের প্রতীক। সেই সৌন্দর্যকে পাওয়ার জন্য চরম কষ্ট পেতেও ভয় পান না তাঁরা।
পূর্ব আফ্রিকার ইথিয়োপিয়ায় বসবাস করেন মুরসি উপজাতির সদস্যেরা। সেখানে বিবাহযোগ্য কন্যার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলেই শুরু হয় হবু কনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির তোড়জোড়। এমনিতেই আফ্রিকার এমন সব উপজাতি রয়েছে যাদের সংস্কৃতি এবং রীতিনীতি বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়।
তেমনই একটি হল মুরসি সমাজ। গোটা বিশ্বের নজর মুরসিরা কেড়েছে মূলত তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন কিছু প্রথার জন্য।
দক্ষিণ ইথিয়োপিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওমো উপত্যকার রুক্ষ ভূখণ্ডে বাস করে মুরসিরা। বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন এবং ভয়ঙ্কর ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটি হল মুরসি উপজাতি। তারা তাদের স্বতন্ত্র চেহারা এবং সংস্কৃতির জন্য পরিচিত। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সাজপোশাক এবং রীতিনীতি ধরে রেখেছে তারা।
প্রান্তিক অঞ্চলে বসবাসকারী এই উপজাতিটি কঠোর ভাবে নিজেদের প্রথা ও সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বহির্জগতের সংশ্রব এড়িয়ে চলতেই ভালবাসে। এই উপজাতির সদস্যেরা বাস করে শতাব্দীপ্রাচীন রীতিনীতি দিয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র জগতে। সেই জগতে অনুপ্রবেশের অধিকার নেই আধুনিকতার।
বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে মুরসি মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে এক বেদনাদায়ক রীতি। এটিকে বর্তমান যুগে প্রচলিত সবচেয়ে বেদনাদায়ক সৌন্দর্যবৃদ্ধির পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। কারণ ১৫-১৬ বছরের কিশোরীদের ঠোঁট কেটে মাটি বা কাঠ দিয়ে তৈরি চাকতি ঢোকানোর একটি রীতি পালন করা হয় এখানে।
বিয়ের বয়স হলেই মুরসি উপজাতির মেয়েদের নীচের ঠোঁট চিরে দেওয়া হয়। কাটা জায়গায় কাঠ বা মাটির টুকরো গুঁজে দেওয়া হয়। পরদিন সেই টুকরো সরিয়ে আকারে একটু বড় টুকরো ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার পরদিন আরও একটু বড় টুকরো। এই ভাবে প্রতিদিন টুকরোর আকার বাড়তে থাকে। ঠোঁটে টান পড়তে পড়তে কাটা অংশটি ধীরে ধীরে ঝুলে পড়তে থাকে।
ক্ষতস্থানের ঘা শুকিয়ে গেলে সেই কাঠের টুকরো বার করে নিয়ে কাঠ বা মাটির তৈরি অন্য চাকতি বসিয়ে দেওয়া হয়। কিছু দিন পর ঠোঁটের সেই খোলা জায়গায় প্রথমে একটি ছোট মাটির চাকতি পরিয়ে দেওয়া হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাকতির আকার বৃদ্ধি পায়। প্রশস্ত, চ্যাপ্টা বৃত্তের মতো ঝুলতে শুরু না করা পর্যন্ত চাকতির আকার বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
এই চাকতির আকারের উপর অনেক সময় নারীদের সামাজিক মর্যাদাও নির্ভর করে। এমনও দেখা যায় এক জন মুরসি নারী ১২ সেমি বা তার চেয়ে বড় মাপের গোলাকার মাটির বা কাঠের চাকতি ঠোঁটে ব্যবহার করছেন। এই প্রথাটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও মুরসি সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি সৌন্দর্য, মর্যাদা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।
অধরের চাকতি যত বড় হবে, নারীর মর্যাদা তত বেশি হবে এবং বিবাহে তিনি তত বেশি যৌতুক পেতে পারেন। এই প্রথা যাঁরা মানতে পারেন তাঁরা সমাজে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। তাঁদের যন্ত্রণা সহ্য করার ইচ্ছাকে শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা হয় ও সমাজে সম্মানিত হন মুরসি মহিলারা। তাই বেদনাদায়ক হওয়া সত্ত্বেও, মুরসি উপজাতির মহিলারা তাঁদের ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য এই ব্যথা সহ্য করতে প্রস্তুত।
গয়না বা অলঙ্কারের মতো চাকতিগুলিকে নানা রকম ভাবে নকশা করতে ভালবাসেন মহিলারা। মাটির প্লেটে নানা রং দিয়ে আঁকা থাকে নকশা। আবার কারও চাকতি নিরেট, কোনও অলঙ্করণ নেই। কারও চাকতির মধ্যে আবার রয়েছে নানা রকম ছিদ্র। প্রত্যেকেই নিজের অধরের অলঙ্কারকে সাজিয়ে তুলতে চান নিজের মতো করে।
উপজাতিটি মনে করে, ঠোঁটের চাকতি নারীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। এই ঠোঁটের চাকতির কারণে বিয়ের সময় পাত্রপক্ষকে বড় অঙ্কের পণ দিতে হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, ঠোঁট যত বেশি ঝুলন্ত হবে, মহিলা তত বেশি সুন্দরী হবেন।
মুরসি মহিলাদের বেদনাদায়ক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পিছনে একটি নির্মম ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে। সেই ইতিহাস আকর্ষণীয়ও বটে। প্রাচীন কালে মুরসি উপজাতির লোকদের প্রায়শই দাস হিসাবে কিনে নেওয়া হত। পুরুষদের শ্রমের জন্য এবং মহিলাদের যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করা হত। তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মেয়েরা নিজেদের কুৎসিত করতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের ঠোঁটে চাকতি লাগিয়ে এবং দাঁত ভেঙে সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছিলেন।
মুরসি উপজাতিটি অন্যান্য উপজাতির তুলনায় বেশ হিংস্র বলে মনে করা হয়। ইথিয়োপিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী এই উপজাতির জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অনন্য ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত এই উপজাতিটি তাদের নিজস্ব রীতিনীতির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। বাইরের লোকজনের কোনও রকমের হস্তক্ষেপ সহ্য করে না মুরসিরা।
বিনা অনুমতিতে মুরসিদের এলাকায় প্রবেশ করলে তারা সেই ব্যক্তিকে হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। ফলে এই উপজাতিরা যেখানে বসবাস করে সেই সমস্ত এলাকায় পর্যটক প্রবেশের অনুমতি মিলত না চট করে। এই উপজাতিটি প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাস করে এবং কড়া পাহারা দিয়ে নিজেদের সীমানা রক্ষা করে।
আজও মুরসি মহিলারা তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে তাঁদের ঠোঁটে গোলাকার চাকতি পরেন। তাঁরা ব্যথা বা বহিরাগতদের কৌতূহল বা প্রশ্নের ভ্রুক্ষেপ করেন না। তবে স্বামী মারা গেলে বিধবা মহিলারা ঠোঁট থেকে চাকতি খুলে ফেলে দেন।