US-China Power Straggle in Myanmar

‘মানব-বারান্দা’য় অস্ত্রের ঝনঝনানি? ব্রহ্মদেশের ‘বারুদে’ আগুন দিচ্ছে চিন-আমেরিকা! চিন্তায় ভারত, বাংলাদেশও

রাষ্ট্রপুঞ্জকে সামনে রেখে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে থাকা মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে একটি ‘মানব-বারান্দা’ তৈরিতে জোর দিচ্ছে আমেরিকা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এর ফলে ওই এলাকায় চিনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৫ ১২:৩১
Share:
০১ ২০

গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে সাবেক ব্রহ্মদেশ। সেই আঁচে হাত সেঁকে নিয়ে থাবা বসানোর ফিকির খুঁজছে দুই ‘সুপার পাওয়ার’। শুধু তা-ই নয়, ‘ছায়া-যুদ্ধ’কে আঁকড়ে ধরে নিজেদের আখের গুছোনোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এই লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকা। পাশাপাশি, পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়ার রয়েছে প্রবল আশঙ্কা। আর তাই পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে গিয়ে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে নয়াদিল্লির কপালের চিন্তার ভাঁজ।

০২ ২০

এ দেশের সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের দাবি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হতে চলেছে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। এর মধ্যে দিয়ে ‘মানবিক করিডর’ গড়ে তুলতে উঠেপড়ে লেগেছে আমেরিকা। এর জন্য বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতেও পিছপা নয় ওয়াশিংটন। অন্য দিকে, সাবেক বর্মা মুলুকে ইতিমধ্যেই ঘাঁটি গেড়েছে চিন। ‘মানবিক করিডর’-এর নামে মার্কিন ‘অনুপ্রবেশ’ যে বেজিং মেনে নেবে না, তা বলাই বাহুল্য।

Advertisement
০৩ ২০

মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশটির অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে রয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, তাদের শিখণ্ডী হিসাবে ব্যবহার করে ‘ছায়াযুদ্ধ’র অঙ্ক কষা শুরু করে দিয়েছে আমেরিকা ও চিন। দুই ‘মহাশক্তি’র মাঝে পড়ে ঢাকার যে হাঁসফাঁস দশা হতে চলেছে, তা নিয়ে আগাম সতর্ক করেছেন তাঁরা।

০৪ ২০

অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তারা মনে করেন, ‘মানবিক করিডর’-এর নামে সাবেক বর্মা মুলুকে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে চাইছে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য রয়েছে তাদের। প্রথমত, নিঃশব্দে বঙ্গোপসাগরীয় এলাকায় ঢুকে পড়া। দ্বিতীয়ত, চিনকে মায়ানমার থেকে গলাধাক্কা দেওয়া। তা হলেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাঁকিয়ে বসতে আর কোনও বাধার মুখে পড়তে হবে না ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকাকে।

০৫ ২০

যুক্তরাষ্ট্রের এ-হেন অভিসন্ধি টের পেতেই নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশের সেনা। বিদ্রোহীদের দখলে থাকা রাখাইন প্রদেশের প্রস্তাবিত ‘বারান্দা’টিকে রক্তাক্ত করিডর হিসাবে উল্লেখ করেছেন পূর্বের প্রতিবেশী দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাঁর যুক্তি, সরকার শেষ পর্যন্ত এর অনুমতি দিলে প্রশ্নের মুখে পড়বে দেশের সার্বভৌমত্ব। এ ব্যাপারে বার বার পাকিস্তান ও সিআইএ-র ‘অপারেশন সাইক্লোন’-এর উদাহরণ টেনেছেন তিনি।

০৬ ২০

১৯৭৯ সালে সেনা অভিযান চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। মধ্য এশিয়া হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের দোরগোড়ায় মস্কোর এ-হেন আগ্রাসনে প্রমাদ গোনে আমেরিকা। আর তাই হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে সোভিয়েত ফৌজকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী। তাঁদের অর্থানুকূল্যে অচিরেই সেখানে জন্ম হয় ‘মুজ়াহিদিন’-এর। পশতু ভাষায় এর অর্থ ‘ধর্মযোদ্ধা’। তাঁদের ব্যবহার করে আমু দরিয়ার তীরে মস্কোর বিরুদ্ধে ‘ছায়াযুদ্ধ’ চালাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।

০৭ ২০

সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে সিআইএ-র এই গোপন অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন সাইক্লোন’। এতে খোলাখুলি ভাবে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনীকে সাহায্য করে পাকিস্তান। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে আর কখনওই ইসলামাবাদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। অন্য দিকে, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে ফিরে গেলে ধীরে ধীরে রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের সঙ্গে শত্রুতা বাড়তে থাকে আফগানদের। সেই ক্ষত আজও মেরামত করতে পারেনি পাকিস্তান।

০৮ ২০

জেনারেল ওয়াকার মনে করেন, মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে ‘মানবিক করিডর’ তৈরি হলে ঢাকার অবস্থাও হবে ইসলামাবাদের মতো। তাঁর আশঙ্কা, মায়ানমার থেকে চিনকে উৎখাত করতে পুরনো ‘আফগান তাস’ খেলতে চাইছে ওয়াশিংটন। সেই কারণে প্রস্তাবিত ‘মানব-বারান্দা’টির বিরোধিতা করে আসছেন তিনি। এ ব্যাপারে আমজনতার একাংশের সমর্থনও রয়েছে তাঁর দিকে।

০৯ ২০

২০১৯ সালে ইয়াঙ্গনে (আগে নাম ছিল রেঙ্গুন) বিপুল লগ্নি করে বেজিং। বর্তমানে সেখানে চলছে ‘চিন-মায়ানমার অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিএমইসির (চায়না মায়ানমার ইকোনমিক করিডর) কাজ। এর আওতায় চলতি বছরে কিয়াকফিউ বন্দরের উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। কৌশলগত দিক থেকে ড্রাগনের কাছে সংশ্লিষ্ট এলাকাটির গুরুত্ব পরিসীম।

১০ ২০

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তাটির নাম হল মলাক্কা প্রণালী। সেখান দিয়েই বিদেশ থেকে আমদানি করা খনিজ তেলের ৮০ শতাংশ ঘরের মাটিতে নিয়ে যায় চিন। এ ছাড়া পশ্চিম এশিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওই রাস্তা ছাড়া বেজিঙের কাছে যাতায়াতের দ্বিতীয় কোনও পথ নেই। ড্রাগনের আশঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের সঙ্গে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে মলাক্কা প্রণালী বন্ধ করতে পারে তারা।

১১ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সে ক্ষেত্রে রাতারাতি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে বেজিঙের অর্থনীতি। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বন্ধ হতে পারে চিনা নৌসেনা বা মালবাহী জাহাজের প্রবেশ। সেই বিপদ আঁচ করে দীর্ঘ দিন ধরে বিকল্প রাস্তার খোঁজ চালাচ্ছে ড্রাগন। কিয়াকফিউ বন্দর হাতে থাকলে মান্দারিনভাষীদের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনী যে অনেকটাই স্বস্তিতে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

১২ ২০

সাবেক সেনাকর্তাদের অনুমান, কিয়াকফিউকে বঙ্গোপাসাগরের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসাবে ব্যবহার করতে চায় চিন। সেই কারণে পর্দার আড়ালে থেকে মায়ানমারের জুন্টা সেনা সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে বেজিং। রাখাইন এলাকায় আবার ড্রাগনের নীরব সমর্থন রয়েছে আরাকান আর্মির দিকে। বিদ্রোহীরা যাতে তাদের প্রকল্প বা নির্মীয়মাণ বন্দরকে নিশানা না করে, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

১৩ ২০

মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে লগ্নি রয়েছে ভারতেরও। সেখানে চলছে নয়াদিল্লির কালাদান প্রকল্প। এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্বের বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে সাবেক বর্মা মুলুকের ওই এলাকা দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত রাস্তা পাবে এ দেশের ‘সেভেন সিস্টার্স’। ফলে বিশ্বের বাজারে পণ্য নিয়ে যেতে আর কোনও সমস্যা হবে না সেখানকার উদ্যোগপতিদের।

১৪ ২০

চলতি বছরের এপ্রিলে হঠাৎ করে খবরের শিরোনামে চলে আসে প্রস্তাবিত ‘মানবিক করিডর’। মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে ২৭১ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত। এর প্রায় পুরোটাই রয়েছে সাবেক বর্মা মুলুকের রাখাইন প্রদেশে। এলাকাটির সিংহভাগ বাসিন্দা আবার রোহিঙ্গা মুসলমান, যাঁদের ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ঢাকা। কারণ, প্রায়ই আরাকান আর্মির হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

১৫ ২০

বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরবাহিনীকে মায়ানমারে পা জমানোর সুযোগ করে দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জকে সামনে রেখে রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে একটি করিডর বা বারান্দার জিগির তুলেছে ওয়াশিংটন। এর প্রায় পুরোটাই থাকবে বাংলাদেশের মাটিতে। গৃহযুদ্ধের কারণে রাখাইনের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের ঠিকমতো দু’বেলা খাবার জুটছে না। নেই মাথার উপর ছাদ বা চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা।

১৬ ২০

এর কিছু দিন পর বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব অ্যান্টনিয়ো গুতারেজ়। বাংলাদেশের কক্সবাজারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘সঙ্কটের সময়ে মানবিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়াটা অপরাধ।’’ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এতে ঢাকার অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের উপর প্রস্তাবিত করিডরটি তৈরির ব্যাপারে চাপ বেড়েছে। যদিও এ ব্যাপারে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।

১৭ ২০

সূত্রের খবর, গত এপ্রিলে ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন মার্কিন বিদেশ দফতরের তিন কর্তা। সেখানে হাজির ছিলেন মায়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়াও আরাকান আর্মি এবং কুকি-চিন বিদ্রোহী বাহিনীর প্রতিনিধিরা সেখানে হাজির ছিলেন বলে জানা গিয়েছে। প্রায় ওই একই সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন পাক বিদেশ সচিব আমনা বালোচ। ওই বৈঠকে তিনি ছিলেন কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়।

১৮ ২০

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এক বার ‘মানবিক করিডর’ তৈরি হয়ে গেলে সেই রাস্তা দিয়ে মায়ানমারে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ ঢোকানোর সুযোগ পেয়ে যাবে আমেরিকা। এর পর বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে চিনা বিনিয়োগকে নিশানা করা তাদের পক্ষে বেশ সহজ হবে। ইতিমধ্যেই সাবেক বর্মা মুলুকের সিএমইসিতে নিরাপত্তারক্ষীদের বাহিনী মোতায়েন শুরু করেছে বেজিং। তাঁদের উপর আক্রমণ নেমে এলে আরও তীব্র হবে গৃহযুদ্ধের আগুন।

১৯ ২০

মায়ানমারে মার্কিন-চিনের দড়ি টানাটানিতে দু’রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে ভারত পড়তে চলেছে বলে স্পষ্ট করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণ। ‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’কে তিনি বলেন, ‘‘চিনের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। তা ছাড়া ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকেই লাদাখের আকসাই চিন অংশটি দখল করে রেখেছে বেজিং। ফলে সাদা চোখে মনে হতে পারে নয়াদিল্লির খোলা মনে আমেরিকার পাশে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই এতটা সহজ নয়।’’

২০ ২০

লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভয় কৃষ্ণ মনে করেন, বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে রাখাইন প্রদেশে ‘মানব-বারান্দা’ তৈরি হলে তার সর্বাধিক প্রভাব পড়বে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির উপর। তাঁর কথায়, ‘‘ওই রাস্তা মাদক এবং হাতিয়ার পাচারের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠলে সেটা যে শুধু মায়ানমারের বিদ্রোহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এমনটা নয়। মণিপুর, মিজ়োরাম বা অসমের বিচ্ছিন্নবাদীদের কাছেও পৌঁছোতে পারে ওই হাতিয়ার। তাই এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।’’

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement