বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক অ্যাসফল্ট হ্রদের মধ্যে অন্যতম। অন্যান্য খনিজ সম্পদও রয়েছে ভরপুর। এই হ্রদের সঙ্গে রয়েছে বাকিংহাম প্রাসাদ, লিঙ্কন টানেলের যোগসূত্র। তবে স্থানীয়দের মতে, রহস্যময় এই হ্রদেই নাকি রয়ে গিয়েছেন পূর্বপুরুষদের আত্মা। তাঁদের পাপকার্যের ফলেই নাকি ডানাওলা দেবতা অভিশাপ দেন।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর একটি প্রাকৃতিক অ্যাসফল্ট হ্রদ হল লা ব্রিয়া পিচ হ্রদ। এই হ্রদটি ত্রিনিদাদ দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে লা ব্রিয়া শহরে অবস্থিত। এটি প্রায় ১০০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং প্রায় ২৫০ ফুট গভীর।
লা ব্রিয়া পিচ হ্রদটি মূলত পিচ বা অ্যাসফল্ট দিয়ে গঠিত। এই হ্রদটি প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থও ধারণ করে। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থলও বটে। প্রতি বছর বহু পর্যটক এই হ্রদ দেখতে যান। হ্রদের অনতিদূরে একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে। তা ছাড়া পর্যটকদের জন্য আলাদা ট্যুরের আয়োজন করা হয়।
শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য যে লা ব্রিয়া পিচ হ্রদটি আকর্ষণীয় তা নয়। এটি ভূতাত্ত্বিক এবং পরিবেশগত গবেষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা অধ্যয়নের জন্য এই হ্রদটি বিজ্ঞানীদের গবেষণার কাজেও ব্যবহৃত হয়।
লা ব্রিয়া পিচ হ্রদটির উৎপত্তি ক্যারিবিয়ান প্লেটের গভীর চ্যুতির সঙ্গে সম্পর্কিত। বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, হ্রদটি দু’টি চ্যুতির সংযোগস্থলে অবস্থিত, যার গভীরে জমা তেলের হালকা উপাদানগুলি সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হয়ে ভারী অ্যাসফল্টে পরিণত হয়। কম চাপ এবং ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে অ্যাসফল্টের উপর পেট্রোলিয়াম তৈরি হয়।
১৮৪০ সালে আব্রাহাম পিনিয়ো গেসনার হ্রদে বিটুমিনের নমুনা থেকে প্রথম কেরোসিন সংগ্রহ করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে তেল সংগ্রহের জন্য প্রথম কূপ খনন করা হয়েছিল এই হ্রদে। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত হ্রদের পিচ থেকে কেরোসিন পাতন করা হয়েছিল। তবে প্রথম বাণিজ্যিক কূপটি ১৯০৩ সালে হ্রদের পশ্চিম প্রান্তে খনন করা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদদের দাবি, এই হ্রদ আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৫৯৫ সালে। স্যর ওয়াল্টার র্যালি ‘যকের ধন’-এর সন্ধান করতে বেরিয়ে এই হ্রদের খোঁজ পেয়েছিলেন। তাঁর জাহাজ মেরামতের জন্য এই হ্রদ থেকে প্রাকৃতিক অ্যাসফল্টের ব্যবহারও করেছিলেন তিনি।
লা ব্রিয়া পিচ হ্রদটিকে ঘিরে রয়েছে একাধিক রহস্য। স্থানীয়দের মুখে মুখেও বহু বছর ধরে এই হ্রদটিকে ঘিরে নানা ভৌতিক কাহিনিও শোনা যায়। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, এই হ্রদের গভীরে বন্দি রয়েছে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মা। খননকার্যের সময় একটি কঙ্কাল উদ্ধার হওয়ার পর সেই কাহিনি আরও জোরালো হয়ে পড়ে সেই অঞ্চলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সেখানকার প্রাচীন অধিবাসীরা প্রতিদ্বন্দ্বী উপজাতির সঙ্গে লড়াই করে জয় লাভ করেছিলেন। উৎসব পালনের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন সকলে। তাই হামিংবার্ড (এক ধরনের পাখি) মেরে তা রান্না করে খেয়ে ফেলেছিলেন।
নিরীহ পাখিদের হত্যার কারণে নাকি কোনও এক ডানাওলা দেবতা সেখানকার অধিবাসীদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। জাদুবলে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল এই অ্যাসফল্ট হ্রদ। তার পর সেই হ্রদ নাকি সারা গ্রাম গ্রাস করে ফেলেছিল। এখনও নাকি সেই হ্রদের অতলে তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মা বন্দি হয়ে রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
১৮৮৭ সালে ‘দ্য অ্যাসফল্ট কিং’ নামে পরিচিত এক আমেরিকান ব্যবসায়ী ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ৪২ বছরের জন্য হ্রদ ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার পেয়েছিলেন। তিনি ব্যবসা শুরু করলে ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পূর্ব আমেরিকার অন্যান্য শহরের বহু রাস্তাই অ্যাসফল্ট দিয়ে পাকা করা হয়েছিল।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্রাসাদের রাস্তা নির্মাণের সময় লা ব্রিয়া পিচ হ্রদের প্রাকৃতিক অ্যাসফল্ট ব্যবহার করা হয়েছিল।
শুধুমাত্র বাকিংহাম প্রাসাদের রাস্তাই নয়। এক কোটি টনের প্রাকৃতিক অ্যাসফল্টের ভান্ডার থেকে সংগৃহীত অ্যাসফল্ট নিউ ইয়র্কের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দর এবং নিউ ইয়র্ক-নিউ জার্সি সংযোগকারী লিঙ্কন টানেলের নির্মাণের কাজেও ব্যবহৃত হয়েছিল।